৭১১ সাল। উমাইয়া সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ তার ৭ হাজারের বাহিনী নিয়ে স্পেনের উপকূলে প্রবেশ করলেন। সাথে আছে মাত্র ৪ টি যুদ্ধজাহাজ। মুসলিম সৈন্যরা কিছুটা চিন্তিত৷ এই ছোট্ট বাহিনী দিয়ে স্পেন জয় করা কি আদৌ সম্ভব? একটু দূরেই সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ ভাবনায় মশগুল। স্পেনরাজকে হয়তো কঠোর কোন শিক্ষা দেয়ারই ফন্দি আঁটছেন তিনি। ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা সৈন্যদের সামনে তারিক গুটি গুটি পায়ে হাজির হলেন। সবাইকে পিলে চমকে দিয়ে ৪ টি যুদ্ধজাহাজ পুড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি। সৈন্যরা হতভম্ব! সেনাপতি এ কি করলেন। 

তারিক সামনে এসে দৃঢ় কন্ঠে বক্তৃতা রাখলেন। “বন্ধুগণ! আমাদের পশ্চাতে বিশাল জলরাশি। সামনে শত্রুদের অভয়ারণ্য। শত্রুদের হটিয়ে দিয়ে বিজয় অর্জন ছাড়া গত্যন্তর নাই। সবাই প্রস্তুত হও এবং এগিয়ে চলো” ৭১১ সালের এমনি এক দিনে তারিক তার এই সৈন্যবল নিয়ে স্পেন জয় করে বসেন। আর এরই সাথে ইউরোপে মুসলমানদের আগমনের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়।

ইউরোপে উমাইয়া সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ

উমাইয়া সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইউরোপে মুসলমানদের আগমন সর্বপ্রথম ঘটে ৭১১ সালে, তারিক বিন জিয়াদ ও মুসা নুসাইরের স্পেন বিজয়ের মাধ্যমে। হিস্পানিয়া (স্পেন ও পর্তুগাল (উত্তরাঞ্চলের উচ্চভূমি বাদে) বিজয়ের পর মুসলমানরা এই অঞ্চলের নাম দেয় আন্দালুস। দশম শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল এই আন্দালুস। সেখানকার বাসিন্দারা দলে দলে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল।

সেই থেকে শুরু হওয়া স্রোত নানান বাঁক বদল নিতে নিতে আজকের প্রাসঙ্গিক বিশ্বে বলা হচ্ছে ইউরোপের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। ইউরোপে মুসলমানদের বিস্তার মূলত ঘটেছে মুসলিম সেনানায়ক দ্বারা। বিশেষ করে অটোমান সুলতানগণ ইউরোপে ব্যাপকভাবে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে একের পর এক নতুন নতুন অঞ্চল দখল করে নিতে থাকেন। আর সেসব দখলীকৃত অঞ্চলগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়। সাথে করে নিজেদের কৃষ্টি কালচারও সম্পূর্ণ ভিন্ন নতুন অঞ্চলে প্রভাব কায়েম করতে সক্ষম হয়। তবে ইউরোপে ইসলামের বিস্তারে মুসলমান শাসকদের পাশাপাশি সূফি উলামাদেরও অবদান স্বীকার্য৷ মুসলমান শাসকদের তরবারি দিয়ে ভৌগোলিক এলাকা দখল আর সূফি দরবেশের আধ্যাত্মিক প্রচারণায় ইউরোপে মুসলমানদের বসতি পাকাপোক্ত হয়ে যায়।

অষ্টম শতকে মুসলিম সেনানায়ক তারিক বিন জিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইরের আন্দালুসিয়া বিজয়ের পর সিসিলি ও ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ ক্রীট মুসলমানদের দখলে আসে৷ স্পেনের পর ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ তুরস্কে ইসলামের আগমন ঘটে মুসলিম শাসকদের দ্বারা। ১৩৫৩ সালে অটোমান তুর্কিরা কনস্টান্টিনোপল দখল করলে তুরস্কের তৎকালীন রাজধানী আড্রিয়ানোপল হয়ে উঠে ইউরোপের নতুন রাজধানী। সুলতান বায়েজিদের (১৩৮৯-১৪০২) শাসনামলে ইসলাম এজিয়ান সাগর থেকে দানিয়ূবের তীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এর পরই মেসিডোনিয়া, বুলগেরিয়া, থেসালি ও থ্রেসে মুসলিমরা নিজেদের দখল পাকাপোক্ত করে। সুলতান বায়েজিদ যে বিজয়াভিযান শুরু করেছিলেন তা মহামতি সুলায়মানের সময়ে গিয়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ (১৪২১-১৪৫১) ইউরোপের চালকিডাইক দখল করে আড্রিয়াটিক সাগর পর্যন্ত নিজের আধিপত্য অটুট রাখেন। 

ইউরোপে উসমানীয় অভিযান

১৫৬৬ সালে ইউরোপে অঞ্চল সম্প্রসারণের জন্য উসমানীয় অভিযান, অগ্রগামী সৈন্যরা ক্রিমীয় তাতার।

ইউরোপ বিজয়ে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব আরেক অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের (১৪৫১-১৪৮১)।  তার আমলেই মুসলমানদের পরম আরাধ্য কনস্টান্টিনোপল শহর বিজয় সম্পন্ন হয়৷ এই ঐতিহাসিক বিজয়ই ইউরোপে মুসলমানদের প্রভাবের প্রশ্নে সব হিসেব নিকেশ পালটে দেয়। মধ্যযুগের ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ শহর ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সঙ্গমস্থলে অবস্থানের কারণে এ নগরের ভৌগোলিক গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি৷ যার ফলে এই শহরকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয় এবং ধীরে ধীরে পুরো ইউরোপে তাদের বিচরণ শুরু হয়। এ সময়ই আলবেনিয়া, বসনিয়া ও সার্বিয়ায় ইসলাম পৌঁছে। দ্বিতীয় সুলায়মান হাংগেরি পর্যন্ত ইসলামের বিস্তার ছড়িয়ে দেন। তিনি এজিয়ান সাগরের নাম দেন ওসমানীয় সাগর। বসনিয়া, সার্বিয়া, ক্রিমিয়া, হার্জেগোভিনা, ভেনিস, পূর্ব ইতালি সহ বলকান উপকূলীয় বিরাট অঞ্চল অটোমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। মহামতি সুলতান সুলেমানের (১৫২০-১৫৬৬) আমলে বেলগ্রেড, রোডস, হাংগেরি বিজয় চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হয়। ভিয়েনা দখল করতে অস্ট্রিয়ার রাজা পঞ্চম চার্লসের বিরুদ্ধে সুলেমান এক অভিযান পরিচালনা করেন। দুই সপ্তাহ অবরোধের পর ভিয়েনা জয় করে নেন সুলতান সুলেমান।

মধ্যযুগীয় বুলগেরিয়া বিশেষত সোফিয়া শহর

বলকান অঞ্চলে প্রায় সব উসমানীয় আমলের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল, যা রুমেলিয়া নামেও পরিচিত ছিল।[

ইউরোপে মুসলমানদের বিজয়ের যে ধারা সেটি চলমান ছিল। যদিও খ্রিস্টানদের প্রতিরোধের মুখে কখনো কখনো পিছু হটে যেতে হয়েছে, কখনোবা নতুন করে আক্রমণ করে জয় করে নিতে হয়েছে। তবে এ কথা সত্য যে, ইউরোপে অটোমানদের অনেক আগেও ইসলামের বিস্তার ঘটেছিল। দশম ও একাদশ শতকের হাংগেরির সংখ্যালঘু মুসলমান ইউরোপে শিক্ষাবিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল। আর ওদিকে পূর্ব ইউরোপে ইসলাম প্রসারে সূফি দরবেশরাও কম ভূমিকা পালন করেনি। ঔপনিবেশিক শাসনে পশ্চিম ইউরোপের মুসলমানরা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হয়ে উঠে। আর সাথে করে পুরো ইউরোপে নতুনভাবে মুসলমানরা ছড়িয়ে পড়ে। ১৪৯২ সালে গ্রানাডার মুসলিম রাজ্যের পতন ঘটলে মুসলমানদের একটা অংশ উত্তর আফ্রিকায় অভিবাসী হয়। তা সত্ত্বেও এই অঞ্চলে মুসলমানদের একটা অংশ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাস করতে থাকে। ৮২৭ সালে মুসলমানদের  সিসিলি জয় করার পর এগারো শতাব্দীতে নরম্যানদের হাতে সিসিলির পতনের আগ পর্যন্ত এই দ্বীপরাষ্ট্রে ইসলামের পতাকা উড্ডীন থাকে। ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমাঞ্চলের ইউরোপীয় অংশে মুসলমানদের উপস্থিতি কমতে শুরু করলে পূর্ব অংশে মুসলমানদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। তেরো শতকের দিকে যখন মোঙ্গল সাম্রাজ্য রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয় তখন এমন এক সময় মোঙ্গল অধিপতি চেংগিস খানের মৃত্যু হয়। তার পরবর্তী মোঙ্গল-তাতার রাজারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাতার সাম্রাজ্যগুলোতে মুসলমানদের নতুন করে উত্থান হয়। তাতার রাজ্য কাজান ১৫৫০ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। এরপর রাশিয়া এসে রাজ্যটির দখল নেয়। এর আগে ১৪৭৫ সালে ক্রাইমিয়ান তাতার অঞ্চল উসমানীয়দের অধীনে আসে। এই অঞ্চলগুলোতে বাস করা মুসলমানরা পরবর্তীতে রুশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে কেউ সৈন্য হয়ে, কেউ হস্তশিল্পী আর কেউবা বণিকের ভূমিকায় ইউক্রেন থেকে সুইডেন, ফিনল্যান্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩০-৪০ সালের দিকে জোসেফ স্ট্যালিনের গ্রেট মাইগ্রেশনের আগ পর্যন্ত এসব অঞ্চলে মুসলমানরা তেমন কোন বাঁধা ছাড়াই বাস করতে থাকে। ১৯৩০ এর দশকে স্ট্যালিন এই ইউক্রেন, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মুসলমানদের সোভিয়েতের আওতাধীন মধ্য এশিয়ায় নিয়ে যান।

পারগালি ইব্রাহিম পাশা

১৫২৯ সালে উসমানীয় সুলতান সুলেইমান বুদায় গ্রিক মুসলমান উজিরে আজম পারগালি ইব্রাহিম পাশার আগমনের অপেক্ষা করছেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর গ্রিস ও তুরস্কের জনতাত্ত্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ইসলাম ও মুসলমানরাও এসময় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। ইউরোপের আকাশে মুসলমানদের পতাকা প্রথমবারের মত উড়িয়েছিল মুসলিম বীর সেনানীরা। আর স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপে এই মুসলিম ডায়াসপোরা গড়ে উঠেছিল শুধুমাত্র সামরিক শক্তির সাহায্যে নয়। মুসলিম বণিক, সূফীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও প্রভাবের পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ের মাইগ্রেশন ইউরোপে মুসলমানদের অবস্থান পোক্ত করতে সহায়তা করেছিল।