নাজীর আহমদ নামটি চেনা চেনা মনে হচ্ছে ! ঢাকার এই ভূমিপুত্র বাঙালি সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র । দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা আন্তর্জাতিক বেতার ব্যক্তিত্ব । শিল্পী ছিলেন একাধারে বহুমুখী সৃষ্টিশীলতার উৎস মুখ । বাংলার সংস্কৃতিকে দিয়েছিলেন অসংখ্য কবিতা-গান-গল্প -প্রবন্ধ। তৈরি করেছিলেন প্রথম স্বল্প-দৈর্ঘ্য ছবি ; প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এফডিসি। সরকারি পর্যায়ে এ দেশে চলচ্চিত্রে ষ্টুডিয়ো তথা এফডিসি প্রতিষ্ঠার স্থপতি ; নাজীর আহমদ।
মরহুম নাজীরআহমদ জন্মেছিলেন এক বনেদী ঢাকাইয়া পরিবারে ১৯২৫ সালে। মা জামিলা খাতুন-বাবা মীর্জা এফ মোহাম্মদ ছিলেন সঙ্গীত অনুরাগী। ঢাকা চেম্বারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বড় ভাই নাসির আহমদের ঘর হতেই পথচলা শুরু হয় দেশের সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের। আরেক ভাই হামিদুর রাহমান, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি । যে মিনারের প্রতিবাদী আলোর পথ বেয়ে আমাদের বাংলাদেশ। ছোট ভাই সাঈদ আহমদ বরেণ্য নাট্যকার। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক চাচা মীর্জা আবদুল কাদের সরদার ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শক।
নাজীর আহমদ ১৯৯০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি মারা যান লন্ডনের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
প্রথম মুসলমান ঘোষক হিসেবে কোলকাতা অল ইন্ডিয়া রেডিওতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৪২ সালে ; ১৪ই আগস্ট রাত ১২ টায় শিল্পী নাজীর আহমদের কণ্ঠে প্রথমবারের মতো দেশবাসী শুনতে পেয়েছিল ” পাকিস্তান ব্রড কাস্টিং সার্ভিস-ঢাকা “। তৈরি করেছিলেন দেশের প্রথম স্বল্প-দৈর্ঘ্য ছবি সালামত ; পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা করলেন এফডিসি। সাতচল্লিশ পরবর্তীতে এ দেশে শিল্পকলার প্রাথমিক শূন্যতা পূরণে দিয়েছিলেন নেতৃত্ব।
” নজরুল গীতি ” নামে রেডিওতে গান প্রচার শুরু হয়েছিল চল্লিশ দশক থেকে । কবি নজরুল ইসলামের মিষ্টি গানকে নজরুল গীতি স্বতন্ত্র নামকরণ করেন আন্তর্জাতিক বেতার ব্যাক্তিত্ব নাজীর আহমদ। নজরুল গীতি কলকাতা রেডিও পর্যন্ত ব্যাবহার করছে । যদিও আমাগো সংস্কৃতি থেকে নজরুল গীতি নামটি নির্বাসিত অনেক দিন হলো। সম্প্রতি বিটিভিতে পুনঃ প্রচারিত প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের এইসব দিনরাত্রি নাটকের সংলাপে নজরুল গীতি নামটি শুনে আমাগো শিল্প সংস্কৃতির গোড়া পত্তনে মরহুম নাজীর আহমদের ভূমিকা মনে পড়ে গেল।
এ প্রসঙ্গে সুরকার সংগীত পরিচালক আবদুল আহাদ- এর স্মৃতিচারণ : আগে নজরুলের গানকে – নজরুল ইসলামের গান বলে রেডিও থেকে ঘোষণা করা হতো। নাজীর তুমিই প্রথম ব্যাক্তি যে বললে এটা ভালো শোনায় না। একটা নামকরণ করা হোক । তখন তুমি বললে ” নজরুল গীতি ” বলা হোক। নজরুল গীতি নামটি নাজীরের দেওয়া । আজ অনেকেই জানেন না কেউ জানবেও না। ইতিহাসতো এ দেশে থাকে না মুছে যায়, এটাই দুঃখ ।
চলচ্চিত্র দিবসে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুকেও।
সেদিনের তরুণ বানিজ্য মন্ত্রী শেখ মুজিব রহমানের সাহসী উদ্যোগে স্বল্প সময় পাশ হয়েছিল চলচ্চিত্র বিল ; সহায়ক হয়েছিল নাজীর আহমদের স্বপ্ন এ দেশে চলচ্চিত্র শিল্প প্রতিষ্ঠার।
শিল্পীর জীবনী পড়ছিলাম আর ভাবছি আমাদের অসহায়ত্ব। রাজনৈতিক বৈষম্য, যোগাযোগ ঘাটতি, প্রযুক্তির স্বল্পতা আর পৃষ্ঠপোষকহীনতার মাঝেও কি অসাধারণ জীবনীশক্তি দিয়ে, অসংখ্য সৃষ্টি করে গেছেন বাংলাদেশের জন্য । কি সুন্দর জীবনের রঙ ; বাঁচার আকাঙ্ক্ষা ; আর সংগ্রামে টিকে থাকার অসীম চেষ্টার অনুপ্রেরণার আলোক ঝর্নাধারা নাজীর আহমদ জীবনভর বেঁচে থাকবেন ; আমাদের বাঁচিয়ে রাখবেন।
তথ্য কৃতজ্ঞতা
■ চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ, বঙ্গবন্ধু ও চলচ্চিত্র
■ মতিউর রহমান ” এ শহর এখন আরও বেশি ধূসর ” প্রথম আলো
■ সুকুমার বিশ্বাস ‘ নাজীর আহমদ’।