‘ রুটি শেষ হবে, সূরা ফুরিয়ে আসবে, প্রিয়ার চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে কিন্তু বই, তা পুরানো হয় না,সে অনন্ত যৌবনা’’।
মূল ফারসি—
‘’তাঙ্গি মা’ইয়ে লাল খোয়াহাম উ দিওয়ানি
সাদ-এ রামাকে বয়াদ ও নিস্ফ-এ না’নি
ওয়া আংগাহ মান উ তু নিশাস্তা দর বিরানি
খুশতার বুওয়াদ আজ মামলাকাত-এ-সুলতানি’’।
রুবাইয়াৎ মানে চার লাইনের কবিতা।
এখানে ওমর খৈয়াম এক সোরাহী সূরা, সাকি, একটু রুটির ছিলকে আর একটি কবিতার বই পেলে সারা জাহানের বাদশাহর সিংহাসন ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ তাঁর কাছে সারা দুনিয়ার বাদশাহির চেয়ে সামান্য সূরা, সাকি ও বই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
ওমর খৈয়াম ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে পারস্যের বিখ্যাত বাণিজ্যিক শহর নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইব্রাহিম খৈয়াম ছিলেন সে শহরের বিখ্যাত চিকিৎসক। তার মায়ের নাম জানা যায় না। ওমর খৈয়ামের পুরো নাম ‘ঘিয়াথ আদ দীন আবু ফাতাহ ওমর ইবনে খৈয়াম নিশাপুরি’। নামের প্রথম অংশ ‘ঘিয়াথ আদ দীন’ অর্থ বিশ্বস্ত কাঁধ বা যাকে বিশ্বাস করা যায়।
ওমর খৈয়াম একজন দার্শনিক, কবি, গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ। রসকষহীন গণিত নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। আবার তিনিই লিখেছেন মধুর সব কবিতা। কখনো বর্ষপঞ্জিকা নিয়েও কাজ করেছেন। আবার কখনো চতুষ্পদী কবিতার অমর সংকলন ‘রুবাইয়াত’ রচনা করেছেন। আধুনিক বীজগণিতের ভিত্তি তৈরি হয়েছে তার হাতে, কাজ করেছেন ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নিয়েও। ভূগোল, বলবিদ্যা, খনিজবিজ্ঞান, আইন, এমনকি সঙ্গীতও বাদ যায়নি তার জ্ঞানপিপাসার তালিকা থেকে। জীবনের শেষ দিকে এসে হয়েছেন শিক্ষক; শিক্ষাদান করেছেন ইবনে সিনার দর্শন ও গণিত বিষয়ে। তিনি সত্যি অসাধারণ, অতুলনীয়, অনুপম, তিনি ওমর খৈয়াম।
ওমর খৈয়াম ভাগ্যবান ছিলেন,কারণ তিনি ইসলামের স্বর্ণযুগে জন্মগ্রহণ করেন। সে যুগে ইসলাম ছিল সব ধরনের গোঁড়ামি, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা বিবর্জিত। আর মুসলমানরাও ছিল মুক্তমনা ও জ্ঞানপিপাসু।
‘’আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা”- উনিশ শতকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এই কবিতা লিখেছেন। আর ওমর খৈয়াম প্রায় হাজার বছর আগেই এই কবিতার বাণী নিজের জীবনে প্রতিফলিত করেছিলেন। পিতা এবং পিতৃতুল্য শিক্ষকের মৃত্যুতেও ভেঙে না পড়ে সংসারের হাল ধরেন তিনি এবং সংসার নামের তরিঠিকমতো চালিয়ে নিয়ে যান।
যুবা বয়সে তিনি সমরখন্দে চলে যান এবং সেখানে শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এর পর বুখারায় নিজেকে মধ্যযুগের একজন প্রধান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
প্রায় হাজার বছর আগে ওমর খৈয়ামের মতো এত বড় একজন কবি বিশেষ করে ইরানের মতো একটি অনুভূতিপ্রবণ দেশে কি করে জন্মালো, এখন তা ভাবলে অবাক লাগে৷
তাঁকে দেখে মনে হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিও বুঝি এতোটা আধুনিক হতে পারে না ৷
তার জন্য ওমরকে লাঞ্ছনাও ভোগ করতে হয়েছিল অনেক, সেটা বুঝি তাঁর ঐ হাজার বছর আগে জন্মাবার জন্যই।
তবুও খেজুর গাছের মতই তিনি এ-রস দান করেছেন, এ রস মিষ্টি হলেও এতে অশ্রুজলের লবণ মেশা ৷ খেজুর গাছের রস যেমন তার মাথা চেঁছে বের করতে হয়, ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতও তেমনি বেরিয়েছে তার মস্তিষ্ক থেকে ৷
আজকাল পৃথিবীর কোন কবিই তাঁর মত আধুনিক বা তরুণ নন ৷ বিংশ শতাব্দীর জ্ঞান প্রলুব্ধ লোকও তার মত সবকিছু হজম করতে পারবে না।
ওমর এখনও প্রচুর শ্রদ্ধা পাচ্ছেন তবুও মনে হয় আরো চার-পাঁচ শতাব্দি পরে তিনি আরো বেশি শ্রদ্ধা পাবেন ৷ যা পেয়েছেন তার চেয়ে অনেকগুন বেশি৷
এবারে আসি রুবাইয়াৎ এর কথায়——
রুবাইয়াৎ গ্রন্থটি ইরানের জীবনবাদী কবি ওমর খৈয়ামের রুবাই বা কবিতা নিয়ে লেখা।বাংলা ভাষায় এই কবির অমর কাব্য রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম অনুবাদ করতে শুরু করেন নজরুল। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম বইটি প্রকাশিত হয়।
কাল ও ভাষাগত দিক থেকে ওমর খৈয়াম আমাদের একটু দূরের মানুষ ছিলেন বটে তবে তাঁর নানান উক্তি আমাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে গেছে। নজরুলই বলতে গেলে দারুণভাবে তাঁকে আমাদের কাছের মানুষ করে দিয়েছেন।
নিজের অনুবাদ করা ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’-এর ভূমিকায় স্বয়ং নজরুল লিখেছেন, ‘ওমরের রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা, চতুষ্পদী হলেও তার চারটি পদই ছুটেছে আরবি ঘোড়ার মতো দৃপ্ত তেজে সম-তালে।ভণ্ডামি, মিথ্যা বিশ্বাস, সংস্কার, বিধি-নিষেধের পথে ধূলি উড়িয়ে তাদের বুক চূর্ণ করে।’
কথিত আছে, কান্তি ঘোষের রুবাই অনুবাদেই প্রথম জোয়ার তৈরি হয়, নরেণ দেব তা আরও জনপ্রিয় করে তোলেন।তারপরও কোথায় যেন একটু অভাব থেকেই যাচ্ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, ‘ওমরই ওমরের সর্বশ্রেষ্ঠ মল্লিনাথ এবং কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী’।
খৈয়ামের প্রায় এক হাজার রুবাই থেকে দু শর কাছাকাছি রুবাই তিনি অনুবাদ করেছেন, মানে মোট ১৯৭টি। তাঁর অনূদিত ১ থেকে ৩১ রুবাই ১৩৪০ কার্তিকের, ৩২ থেকে ৪৬–সংখ্যক রুবাই ১৩৪০ অগ্রহায়ণের এবং ৪৭ থেকে ৫৯–সংখ্যক রুবাই পৌষের মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়। আমরা এই দুজন কবির মেজাজ–মর্জি খেয়াল করলে দেখব, দুজনেই যাঁর যাঁর যুগের ‘বিদ্রোহী ভৃগু’।সামাজিক অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই ছিল প্রখর ও অপ্রতিরোধ্য। ওমর খৈয়াম লড়েছেন তাঁর সময়ের মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নজরুলও তা–ই। তবে নজরুলের আরেক বিরুদ্ধ শক্তি ছিল বিদেশি সরকার। এ ছাড়া হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অসংস্কৃতবান-মোল্লা-পুরুতদের বিরুদ্ধে, জাতপাতের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
নজরুলের হাতেই ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ-এর সার্থক অনুবাদ হবে, সেটিই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নজরুলের নিজস্ব ভাষ্য হলো, ‘ওমর খৈয়ামের ভাবে অনুপ্রাণিত ফিটসজেরাল্ডের কবিতার যাঁরা অনুবাদ করেছেন, তাঁরা সকলেই আমার চেয়ে শক্তিশালী ও বড় কবি। কাজেই তাঁদের মতো মিষ্টি শোনাবে না হয়তো আমার এ অনুবাদ। যদি না শোনায়, সে আমার শক্তির অভাব-সাধনার অভাব। কেননা কাব্য-লোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিণী-দ্বীপে আমার দীপান্তর হয়ে গেছে।
সঙ্গীত-লক্ষ্মী ও কাব্য-লক্ষ্মী দুই বোন বলেই বুঝি ওদের মধ্যেই এত রেষারেষি। একজনকে পেয়ে গেলে আরেক জন বাপের বাড়ি চলে যান। দুই জনকে খুশি করে রাখার শক্তি রবীন্দ্রনাথের মতো লোকেরই আছে। আমার সেই সম্বলও নেই, শক্তিও নেই। কাজেই আমার অক্ষমতার দরুন কেউ যেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওমরের উপর চটে না যান।’
উদ্ধৃত অংশে কয়েকটি বিষয় খেয়াল করার মতো, বিদ্রোহী কবির বিনয় তো বটেই, কবিতা ও সংগীত নিয়ে নিজের মত, সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সামর্থ্যের প্রতি বিপুল আস্থা, আর জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে ওমর খৈয়ামকে উল্লেখ করা।
নজরুল লিখেছেন, ‘ওমরের কাব্যে শারাব-সাকির ছড়াছড়ি থাকলেও তিনি জীবনে ছিলেন আশ্চর্য রকমের সংযমী। তাঁর কবিতায় যেমন ভাবের প্রগাঢ়তা, অথচ সংযমের আঁটসাঁট বাঁধুনী, তাঁর জীবনও ছিল তেমন।…তিনি মদ্যপ লম্পটের জীবন (ইচ্ছা থাকলেও) যাপন করতে পারেননি। তাছাড়া ও-ভাবে জীবনযাপন করলে গোঁড়ার দল তা লিখে রাখতেও ভুলে যেতেন না। অথচ, তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও তা লিখে যাননি।
ওমর কবিতা লিখেছেন। আমরা সেই কবিতা পড়ে আনন্দ পাই। নিজেকে তিনি যতই ‘তত্ত্ব-গুরু’ বলুন, নজরুলেরও রস-পিপাসা মিটেছে এসব কবিতা পড়ে। কবিতায় শব্দ প্রচলিত অর্থ ছেড়ে বিচিত্রমাত্রায় দেখা দেয়। জমে ওঠে রহস্য। ওমর খৈয়াম সুরা, সাকি, শারাবসহ আরও যেসব শব্দ ব্যবহার করেছেন, এসবের শাব্দিক অর্থ করতে যাঁরা যাবেন, তাঁরা আদতে সাহিত্যের লীলা থেকে বঞ্চিতই হবেন।
সাহিত্য জীবনের অকপট ভাষা নয়, আবার কপট ভাষাও নয়, এ হলো লীলালাস্যে পরিপূর্ণ জীবনরহস্যের আধার। যে কারণে একে অবলীলায় পড়ার কথা যাঁরা ভাবেন, বুঝিবা গোড়াতেই গলদ ঘটিয়ে ফেলেন তাঁরা।
যখন বলা হয়, ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও/ বাকির খাতা শূন্য থাক/ দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে/ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’ একালে দূরের বাদ্যকে যদি দূরের সাহিত্য ধরে এগোই, তাহলে ফাঁকের বদলে লাভের কথাটাই ভাবতে হয়।
একে ইহকাল-পরকালের ব্যাখ্যায়, কী বস্তুগত ও অবস্তুগত চাওয়া-পাওয়ার ব্যাখ্যায়ও নেওয়া যায়। এই যে একই কথার অনেক দিকে নেওয়ার, অনেক দিকে যাওয়ার ক্ষমতা, সামর্থ্য—এই-ই তো সেই সাহিত্যের লীলা।
অবলীলায় যা পড়া যায় ও লেখা যায়, তাতে লীলা থাকে না। ফলে সাহিত্য-রসও পাওয়া যায় না ততটা। যা স্পষ্ট—সরাসরি, যাতে কোনো রাখঢাক নেই, তা কতটা সাহিত্য, তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। সেই তর্ক রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম পড়তে গিয়ে আরও বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। তাতে নজরুল অনূদিত ওমর খৈয়ামের রুবাইগুলো কেবল রসেরই নয়, বোধেরও বৈদূর্যমণি হয়ে ওঠে।
প্রচলিত একটি কথা আছে, ‘যদি তুমি এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে পড়ো। আর এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে লেখো।
তিনি প্রায় ১,২০০ এর মতো চতুষ্পদী কবিতা লিখেছেন। তার এই কবিতার সংকলন ১৯ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অবহেলিতই ছিল। ১৮৫৯ সালে এডওয়ার্ড ফিটজগেরাল্ড এই কবিতা সংকলনের ইংরেজি অনুবাদ ‘রুবাইয়াত অব ওমর’ প্রকাশ করলে ওমরের কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তার কবিতাগুলো পশ্চিমা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। এমনকি তার নিজ দেশের চেয়েও বেশি!
ওমর খৈয়ামের জীবনের অনেক দিকই আমাদের অজানা। তার অনেক কাজও দুর্ভাগ্যজনকভাবে হারিয়ে গিয়েছে কালের স্রোতে। তার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং তার একটি সন্তানও ছিল। ১১৩১ সালের ৪ ডিসেম্বর ওমর খৈয়াম তার জন্মস্থান নিশাপুরে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মৃত্যুর আগে এমন একটি বাগানে তাকে সমাহিত করার কথা বলে গিয়েছিলেন, যেখানে বছরে দু’বার ফুল ফোটে। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। দীর্ঘকাল তার কবরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৯৬৩ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে তার কবর খুঁজে পাওয়া যায় এবং তা নিশাপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে সে স্থানটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। শুরু করা হয়েছিল তার একটি কবিতা দিয়ে, শেষও হচ্ছে তার আরো একটি অসাধারণ কবিতা দিয়ে। উভয় কবিতাই কবি নরেন্দ্র দেবের অনুবাদ থেকে নেয়া হয়েছে।
গড়লে যখন আমায় তাতে,
হাত ছিল কি আমার কভু?
পড়াও যা এই বেশভূষা নাথ
আমার সেকি ইচ্ছা প্রভু
করাও যে সব মন্দ ভালো
দয়াল সে কি আমার কাজ!
মোর ললাটের লিখন,
সে তো তোমার হানা কঠিনবাজ!
মৃত্যুর এত বছর পরেও দোর্দণ্ড প্রতাপে বেঁচে আছেন ওমর খৈয়াম। আর এই বইয়ের মাধ্যমেই বাঙালিরা পরিচিত হয় পারস্যের এই কবির সঙ্গে।