বাংলা বিজয়ের পর মোঘল কোষাগারে এই বাংলা থেকে প্রচুর পরিমানে শুল্ক পাঠানো হতো। বাংলা সুবাহ ছিল সব থেকে সমৃদ্ধশালী সুবাহ। সেই কারণে সম্রাট পরিবারের কাউকে না কাউকে বাংলা সুবাহর পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হতো। শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা ২০ বছর বাংলা সুবাহর দায়িত্বে ছিলেন। এই শাহ সুজারই শ্যালক পুত্র মির্জা সাফসি খান ১৬৪৯ সালে যশোরের ফোজদার হিসেবে নিযুক্ত হন। কপোতাক্ষ ও বুড়ি ভদ্রা নদীর মোহনায় ত্রিমোহনী এক জায়গায় তিনি বসবাস করতেন। তারই নাম অনুসারে সেই জায়গার নাম রাখা হয় মির্জানগর। ত্রিমোহনী কেশবপুর রাস্তার পাশে মির্জানগরের নবাববাড়ির ধ্বংসস্তূপ এখনো পড়ে আছে। উত্তরাধিকার যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের কাছে শাহ সুজার পরাজয়ের পর আওরঙ্গজেব নুরুল্লা খাকে নতুন ফৌজদার হিসেবে নিযুক্ত করেন। বিশাল পরিখা খনন করে উঁচু প্রাচীর দিয়ে একটি কিল্লাবাড়ি নির্মাণ করেন নুরুল্লা খা, যার নাম রাখা হয় মতিঝিল। এখানে একটি সদর তোরোণও নির্মাণ করা হয়। দুর্গ শত্রু থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য কামান ও রাখা ছিল, যা যশোরের মনিহার রোডে সুরক্ষিত আছে। এই কিল্লা বাড়িতে বৈঠকখানা ও জেনানা সহ হাম্মামখানা ছিল।

হাম্মামখানা বলতে বোঝায় গোসল বা গোসল করার জায়গা। এটি একটি ফারসি শব্দ। এর অর্থ hammam-hu-mamneat বা তাপ। অন্য আর এক ব্যাখ্যায় বলা হয়,at- hamim থেকে এর উৎপত্তি যার অর্থ গ্রীষ্মের তাপ। সাধারণত পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা হাম্মাম খানা ছিল l বেশ কিছু মানুষ একসাথে যাতে গোসল করতে পারে সে কথাটি মাথায় রেখেই হাম্মাম খানা গুলো তৈরি করা হয়েছিলো। এই গোষ্ঠিবদ্ধভাবে গোসলের ব্যবস্থা বহু প্রাচীন কাল থেকে হয়ে আসছে । বস্তুতপক্ষে হাম্মামখানা শুধুমাত্র গোসলের জায়গা নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় শুদ্ধিকরণ এবং ঐতিহ্যের ধারা চলমান রাখার ক্ষেত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশের প্রাপ্ত হাম্মাম সমূহের মধ্যে মোঘল নির্মাণশৈলী ও স্থাপত্য কৌশল দেখা যায়। সাধারণত, এই হাম্মাম গুলো সাধারণ মানুষের ব্যাবহারের জন্য তৈরি করা হতো না। আর এই কারণেই বাংলাদশে খুব একটা বেশী সংখ্যক হাম্মামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই মোগল স্থাপত্যিক ধারা স্থানীয় জলবায়ু ভাবধারা ও কৌশলগত দিক একসঙ্গে মিশে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের মির্জানগরের হাম্মামখানাটি এখন পর্যন্ত সুরক্ষিত হাম্মামখানা হিসেবে চিহ্নিত। চার গম্বুজবিশিষ্ট এই ইমারতটির রয়েছে চারটি খোলা কক্ষ ও পশ্চিম দিকে পাথর চুন সুরকির তৈরি একমাত্র প্রবেশ পথ। এর সাথে যে ঘরটি আছে সম্ভবত সেই ঘরটিকে প্রসাধন কক্ষ বলা হত। সেই ঘর থেকে খিলানযুক্ত ধনুককার পথ দিয়ে বর্গাকৃতি আরেকটি ঘরে প্রবেশ করা যায়। সেই ঘরটি পোশাক পরিবর্তনের কাজে ব্যবহার করা হতো। সেখানে ছোট জলাধার বা ট্যাঙ্ক রয়েছে। এই ঘরেরই পূর্ব দিকে গম্বুজাকৃতি যে ঘরটি সেটাই মূল গোসলখানা। এই ঘরে বড় কোনো জানালা নেই।

তবে শুধুমাত্র একটি ছোট অর্ধগোলাকার জানালা দিয়ে আলো ঢোকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর বাইরে পূর্ব দিকের চারটি খোলা কক্ষ আছে যা সম্ভবত পানি ধরে রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো। সেখান থেকে মাটির পাইপ এর মাধ্যমে ভেতরের গোসলখানায় পানি সরবরাহ করা হতো। এই হাম্মামখানাটির মাঝ বরাবর একটি পানি গরম করার চুলি­ রয়েছে যা মাটির নীচ থেকে টানা পাইপ দিয়ে সংযুক্ত।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, হাম্মামখানা ছাড়া আজ আর কিছুই অক্ষত নেই। চারটি ঘর এবং একটি কূপসহ হাম্মামখানাটি মোগল স্থাপত্য শৈলীর অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। কূপ হতে পানি টেনে তুলে এর ছাদের দু’টি চৌবাচ্চায় জমা করে রৌদ্রে গরম করে দেয়াল অভ্যন্তরে গাথা পোড়ামাটির নলের মাধ্যমে গোসলখানায় সরবরাহ করা হতো। স্থাপনাটির দক্ষিণ দিকে একটি চৌবাচ্চা এবং একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে যা একসময় তোষাখানা ছিল বলে অনুমান করা হয়। ১৯৯৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং সংস্কার করে। বাংলাদেশের এই মোঘল স্থাপত্য আজ ধ্বংসপ্রায় কিন্তু আজও মোঘল অস্তিত্ব হিসেবে টিকে আছে।