বর্বরতা থেকে সামাজিকীকরণের যাত্রায় বাণিজ্যিকভাবে সফল সর্বধর্মসহিষ্ণু কুষাণ অধীশ্বর কনিষ্ক, Stay Curioussis

সুযোগ পেলেই বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে আমি বেশ ভালোবাসি। ভারতের উত্তর প্রদেশের মথুরায় এসেছি এবার। মথুরার সরকারি জাদুঘরে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটি মূর্তির ওপর চোখ পড়তেই মাথাটা বনবন করে ঘুরে উঠলো। চার-পাঁচ বছর ধরে মাঝে মাঝেই আমার এ ধরনের অনুভূতি হচ্ছে। কিছু কিছু মানুষ দেখলেই মনে হয় যে তাকে আমি আগে থেকে চিনি। কিছু কিছু গল্প, কিছু ঘটনা আমার খুব পরিচিত মনে হয়। কিছু কিছু জায়গায় গেলেই মনে হয় যেনো বহুবার আমি এখানে এসেছি। এমন সব অভিজ্ঞতায় আমি ক্রমেই দ্বিধান্বিত হয়ে যাচ্ছিলাম। তবে আজকের অভিজ্ঞতাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কনিষ্কের এই মাথাবিহীন মূর্তিটাকে দেখে মুহূর্তেই যেনো কোথাও হারিয়ে গিয়েছিলাম। মনে হলো, এই শরীরটাতো আমারই ছিলো, এই তলোয়ারটাও আমার। হঠাৎ-ই যেনো ২০০০ বছর আগের কিছু স্মৃতি চোখের সামনে একদম জীবন্ত হয়ে উঠলো।

বর্বরতা থেকে সামাজিকীকরণের যাত্রায় বাণিজ্যিকভাবে সফল সর্বধর্মসহিষ্ণু কুষাণ অধীশ্বর কনিষ্ক, Stay Curioussis

কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক, খ্রিস্টাব্দ ১ম শতাব্দী, সরকারী যাদুঘর, মথুরা।

পাকিস্তান থেকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্কের পথ ধরে এগিয়ে মথুরায় প্রবেশ করছি। এই মথুরাকেই তো বেছে নিয়েছিলাম আমার একটি ব্যবসায়িক জনপদ হিসেবে। এই মুহূর্তে মথুরার একটি জনবহুল পথেই আমি দাঁড়িয়ে আছি। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি এক দৃশ্যপট। রমরমা ব্যবসা চলছে, দোকানে বসে আছে উন্নত নাসিকার ধবধবে ফর্সা একজন ক্রেতা। এসেছে সুদূর গ্রীস থেকে; মুক্তা, গোলমরিচ এবং মসলিন সংগ্রহ করতে। কেনা শেষ করে খুব দ্রুতই আবার সাগর পাড়ি দিয়ে ফিরে যেতে হবে তাকে নিজের দেশে। যতক্ষণ পর্যন্ত সমুদ্র তার প্রতিকূল থাকে, ততক্ষণই ভরসা। চীন থেকে আরেকজন ব্যবসায়ী এসেছেন, যিনি এই সময়ে সিল্ক ব্যবসা কিভাবে হচ্ছে তা শুনছেন। সিল্ক রোডের এবং সমুদ্র বাণিজ্যের সহজলভ্যতার জন্যই দুই দেশের মধ্যকার ব্যবসায়িক লেনদেন চলছে বিপুল বেগে। একজন রোমান ইতিহাসবিদ ঠিকই বলেছিলেন যে, এই সময়টি সারা পৃথিবীর জন্য ছিলো সবচেয়ে আনন্দময় ও সুখী জীবনযাপনের উল্লেখযোগ্য একটি পর্যায়। আর এটি তো ছিলো সম্রাট কনিষ্কের সময়, অর্থাৎ আমার সময়। আমি দিতে পেরেছিলাম এক অদ্ভূত ধর্মনিরপেক্ষতার কাল, সমৃদ্ধির কাল, পরস্পরকে ভালোবাসার কাল। আমার সময়েই তো একই পথে হেঁটে গিয়েছে আরব, চীন, গ্রীস, সিরিয়ার ব্যবসায়ীরা। লাভ নিঃসন্দেহে ভীষণ ছিলো রাজ্যে; তা না হলে এতো উন্নতি, এতো উৎকর্ষ কি করে সম্ভব হতো!

সম্প্রতি মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে উপমহাদেশে। ওদিকে সুদূর চীনে চলছে গোত্রে গোত্রে হানাহানি। ‘ইউ-চি’ নামক এক গোত্র পদে পদে ধরাশায়ী হয়ে একটু একটু করে অগ্রসর হতে থাকে ভারতবর্ষের দিকে। আমার শুরুটাও কিন্তু সেখান থেকেই। আমিও তো একজন ‘ইউ-চি’-ই ছিলাম আদিতে, যদিও ‘ইউ-চি’ নামটি আমার পূর্বপুরুষেই মিটে গিয়েছিলো।

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের সুযোগেই অনেক বিদেশী জাতি ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলো এবং আমরা ছিলাম তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রথমে আমার পূর্বপুরুষরা বাস করতেন চীনের উত্তর-পশ্চিমে কান-সু ও নিং-শিয়া প্রদেশের তৃণভূমি অঞ্চলে, টুনহুয়াং ও সিলিয়েন পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে। আমরা ছিলাম এক যাযাবর জাতি। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৫ সালে ‘হিউং-নু’ জাতির আকস্মিক আক্রমণে আমরা আশ্রয়ের খোঁজে সিরদরিয়া নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে যাই এবং সেখানে বসবাসরত ‘শক’-দেরকে বিতাড়িত করি। ‘শক’-রা আমাদের তাড়া খেয়ে ব্যাক্ট্রিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু ‘হিউং-নু’-রা আবারও আমাদের উপর আক্রমণ চালালে আমরা ‘শক’-দেরকে ব্যাক্ট্রিয়া থেকেও উৎখাত করতে বাধ্য হই। আমরা ব্যাক্ট্রিয়ায় বসবাস করা শুরু করলে ‘শক’-রাও বাধ্য হয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণ করে বসে।

এদিকে ‘ইউ-চি’ জাতি, অর্থাৎ আমরা, ব্যাক্ট্রিয়ায় বসবাস করতে করতে বর্বর, যাযাবর জীবন পরিত্যাগ করে একসময় কৃষিজীবী জাতিতে পরিণত হই এবং কালের পরিক্রমায় ও বিভিন্ন কারণে আমরা পাঁচটি আলাদা গোষ্ঠীতে (কুই-সাং/কিউই-শাং/কুষাণ, কাও-ফু, হি-থুম, চুং-মো, হিউ-মি) বিভক্ত হয়ে যাই। এই পাঁচ ভাগের মধ্যেই একটি হলো ‘কুষাণ’ গোত্র। ধারণা করা হয়, ‘কিউই-শাং’ নামক কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম থেকে ‘কুষাণ’ নামটি এসেছে। কুষাণরাই সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলো অন্যদের তুলনায়। আমাদের মধ্যকার অন্যতম ব্যক্তিত্ব কুজুল কদফিসেস (প্রথম কদফিসেস) খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে পাঁচ ভাগে বিভক্ত ‘ইউ-চি’-দেরকে আবারো ঐক্যবদ্ধ করেন এবং ভারতবর্ষের কাবুল ও কাশ্মীর দখল করেন। আর এরই মাধ্যমে গড়ে ওঠে শক্তিশালী কুষাণ সাম্রাজ্য।

বর্বরতা থেকে সামাজিকীকরণের যাত্রায় বাণিজ্যিকভাবে সফল সর্বধর্মসহিষ্ণু কুষাণ অধীশ্বর কনিষ্ক, Stay Curioussis

কণিষ্কের স্বর্ণমুদ্রা

কুষাণ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর কুজুল কদফিসেস ‘ওয়াং (রাজা)’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং নিজের নামে মুদ্রা প্রণয়ন করেন। তিনি ৮০ বছরের বেশি সময় জীবিত ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর তার ছেলে বীম কদফিসেস (দ্বিতীয় কদফিসেস) ৬৫-৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কুষাণ সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন। কুজুল কদফিসেস কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হলেও ভারতে এই বংশকে প্রতিষ্ঠিত করেন শৈব ধর্মের অনুসারী বীম কদফিসেস।

বীম কদফিসেসের পরেই সিংহাসনে আরোহণ করি আমি, যদিও কদফিসেসদের সাথে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিলো না। আমিই হলাম প্রথম কনিষ্ক, গড়ে তুলেছিলাম সবচেয়ে বিস্তৃত কুষাণ সাম্রাজ্য এবং আর্যাবর্তে রাজনৈতিক অনৈক্যের অবসান ঘটিয়ে তথা রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করে পরিণত হয়েছি কুষাণ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ও শ্রেষ্ঠ সম্রাটে।

সম্রাট অশোক কোনো যোগ্য উত্তরাধিকারী তৈরী করে যেতে পারেন নি। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছেন আমার পূর্বসূরীরা এবং এরই ধারাবাহিকতায় আমিও পেয়েছি এক অনন্য সাম্রাজ্য বিস্তারের অমোঘ সুযোগ। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যেই মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন হয়। শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে বসেন তারই সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। শুঙ্গরা মগধ শাসন করে খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫-৭৩ সাল। এরই মধ্যে উত্তর ভারতে চরম রাজনৈতিক অরাজকতা শুরু হয়। আস্তে আস্তে মগধের অধীন রাজ্যগুলো স্বাধীন হয়ে যেতে থাকে। দক্ষিণে সাতবাহনরা মগধ থেকে স্বাধীন হয়ে আলাদা রাজ্য গড়ে তোলে। চেতবংশের নেতৃত্বে কলিঙ্গ আবার স্বাধীন হয়ে যায়। আর এই অরাজকতার সুযোগে ব্যাক্ট্রিয় গ্রীকরা পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের বিশাল জায়গা দখল করে নেয় এবং শক, পহ্লব, কুষাণ ইত্যাদি বিদেশী জাতিরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজ্য স্থাপন করে।

৭৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করি আমি এবং এই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ‘শকাব্দ’ নামে একটি নতুন বর্ষরীতির প্রচলনও করেছিলাম। আমি সক্ষম হয়েছিলাম কুষাণ সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ বিস্তৃত করতে। গান্ধার ও কাশ্মীর থেকে বেনারস পর্যন্ত আমার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিলো। পুরুষপুর বা বর্তমান পেশোয়া এবং মথুরা –এই দুই স্থানকে রাজধানী করেছিলাম আমি। আমি পার্সিয়ান ও চীনাদের পরাজিত করেছিলাম এবং কাশগড়, ইয়ারখন্দ ও খোটান অধিকার করেছিলাম। চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পূর্ব তুর্কিস্থান দখল করেছিলাম আমি, যদিও পরে চীনাদের কাছে পরাজিত হতে হয়েছিলো আমাকে। আমি পারি নি চীনে আমার আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। এই ব্যর্থতা আমৃত্যু আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। চীনা সেনাপতি প্যান চাও এর কাছে পরাজয়ের অপমান ভুলতে না পেরেই চীন আক্রমণ করেছিলাম আমি এবং সন্ধির জামিন হিসেবে সম্রাট হো-তি এর এক ছেলেকে নিজের দরবারে এনেও রেখেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই অপমানের প্রতিশোধ আমি নিতে পারি নি। তবু দমে যাওয়ার পাত্র আমি কখনোই ছিলাম না।

আমি ছিলাম সামরিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক কার্যকলাপের জন্য বিখ্যাত। আমি গ্রীক ভাষার পরিবর্তে ব্যাক্ট্রিয় ভাষার প্রবর্তন করেছিলাম। আফগানিস্তানের রবাতকে আমার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত ব্যাক্ট্রিয় ভাষার একটি গ্রীক শিলালিপি স্থাপন করেছিলাম। এটিই পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে খুঁজে পাওয়া ‘রবাতক শিলালিপি’।

‘বুদ্ধচরিত’ রচয়িতা অশ্বঘোষ, স্বনামধন্য চিকিৎসক চরক, গ্রীক স্থপতি এজিসিলাস, রাজনীতিবিদ মাথর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব আমার সময়েই হয়েছে।

আমি ছিলাম সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল। ধর্মনিরপেক্ষতা তো আমার মাধ্যমেই এসেছে। আমার পরিবারই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাকে। আমাদের সময়ের মুদ্রাগুলোই এর প্রমাণ। ভারতবর্ষে আমিই প্রথম ব্যাপকভাবে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলাম। আমার প্রণীত মুদ্রায় ভারতীয়, গ্রীক, ইরানীয়, সুমেরীয় ও ইলেম সংস্কৃতির পৌরাণিক চরিত্রগুলো স্থান পেয়েছে। এর মাধ্যমেই তো স্পষ্ট হয় যে, সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত ছিলাম আমি।

বৌদ্ধ ধর্মকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলাম ও গ্রহণ করেছিলাম। অশ্বঘোষের কাছেই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলাম আমি। একটি যাযাবর জাতি হিসেবে আমাদের তো ধর্মচেতনা বলতে কিছুই ছিলো না। সুতরাং ধর্মের মর্ম সে-ই সবচেয়ে ভালো বোঝে, যে আগে ধর্মহীন বিশৃঙ্খল জীবনযাপনের শেকলে আটকা পড়ে ছিলো। সম্রাট অশোকের পরে আমার আমলেই বৌদ্ধ ধর্ম রাজ অনুগ্রহ লাভ করে। আমার রাজত্বকালে বৌদ্ধ ধর্ম গান্ধার থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিলো। হীনযান ও মহাযানে বিভক্ত হওয়া বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে আমিই সংহতি এনেছিলাম। আমিই কুন্ডলবন বিহার নির্মাণ করেছিলাম এবং সেখানেই হয়েছিলো চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলন।

বর্বরতা থেকে সামাজিকীকরণের যাত্রায় বাণিজ্যিকভাবে সফল সর্বধর্মসহিষ্ণু কুষাণ অধীশ্বর কনিষ্ক, Stay Curioussis

কণিষ্কের স্বর্ণমুদ্রায় গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি

শিল্প ও সাহিত্যে আমার অনুরাগ কিছু কম ছিলো না। ভারতবর্ষ অনেকেই শাসন করেছেন বিভিন্ন সময়ে, কিন্তু কেউই এই ভূমি ও এর সংস্কৃতিকে ভালোবাসে নি। আমরা যেহেতু বর্বর-যাযাবর জাতি ছিলাম, সেহেতু আমরা কখনো শিল্প-সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাই নি। তাই ভারতবর্ষে এসে আমরা সহজেই মিশে গিয়েছিলাম এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে, পরম ভালোবাসায় নিজেদের ভেতর লালন করেছি তা।

কাশ্মীরের কনিষ্কপুর নগরী আমিই নির্মাণ করেছিলাম। আমার আমলেই ভারতবর্ষের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ‘তক্ষশীলা’ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছিলো। আমার সময়েই গ্রীক, রোমান ও ভারতীয় শিল্পের সমন্বয়ে গঠিত ‘গান্ধার শিল্প’ চরম উন্নতি লাভ করে। ‘সারনাথ শিল্প’, ‘মথুরা শিল্প’, ‘গান্ধার শিল্প’ ও ‘অমরাবতী শিল্প’ –এই চারটি শিল্পরীতির আবির্ভাব হয়েছিলো আমার আমলে। মথুরা শিল্প ও গান্ধার শিল্পের মাধ্যমে আমিই তো দিয়েছিলাম বুদ্ধের দৃশ্যমান অবয়ব। গ্রীক শিল্পী এজিসিলাসের পর্যবেক্ষণে রাজধানী পুরুষপুরে একটি বিশাল বহুতল চৈত্য নির্মান করিয়েছিলাম আমি।

‘মাল্টিকালচারাল’ বা ‘গ্লোবালাইজেশন’ আমার জন্য কোনো নতুন শব্দ নয়। কেননা আমার সময়েই তো রূপ লাভ করেছে এরা। আমার আমলেই ভারত-চীন ও ভারত-রোম সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো। ব্যবসা-বাণিজ্য ও ধর্ম প্রচারের সূত্রে রোমান সম্রাট ট্রজানের সঙ্গে দূত বিনিময় হতো আমার। ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম এক অন্য মাত্রায়।

যে ভারতবর্ষের প্রতি আমি এতো নিবেদিত ছিলাম, তাকে বেশিদিন শাসন করা আমার ভাগ্যে জোটে নি। আমার নিজের সৈন্যরাই হত্যা করেছিলো আমাকে। আমার মৃত্যুর পরই শুরু হয় কুষাণ সাম্রাজ্যের অবক্ষয়। আমার পরে আরও অনেকেই এই সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। এরা হলেন যথাক্রমে বিশিষ্ক, হুবিষ্ক, দ্বিতীয় কনিষ্ক, প্রথম বাসুদেব, তৃতীয় কনিষ্ক এবং দ্বিতীয় বাসুদেব। তৃতীয় কনিষ্ক ও দ্বিতীয় বাসুদেবের আমলে কুষাণ সাম্রাজ্য বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। পারস্যের সাসনীয় সম্রাটদের হাতে কুষাণরা ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়। অবশেষে উত্তর ভারতে নাগ বংশের আবির্ভাবের পর তিলে তিলে গড়ে তোলা আমার প্রাণের কুষাণ সাম্রাজ্য সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

আমি কুষাণ সম্রাট কনিষ্ক; ভারতীয়দের ‘মহারাজা’, পারসিকদের ‘রাজাধিরাজ’ এবং চীনাদের ‘দেবপুত্র’ উপাধির অধিকারী। মৌর্য পতনের পর ও গুপ্তযুগের আগে ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নরপতি বলা হয় আমাকে। আমি এতো সুযোগ ও পথ গড়ে তুলেছিলাম বলেই ‘গুপ্ত’-রা এতো উৎকর্ষ সাধন করতে পেরেছিলো।

আমার একটিমাত্র প্রতিকৃতিই তৈরী হয়েছিলো, যার সামনে এই মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এটি মাথাবিহীন কি করে হলো তা অবশ্য আমার জানার সুযোগ হয় নি। হয়তো আমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত কোনো শত্রু ক্ষোভে ভেঙে ফেলেছে তা, অথবা কালের প্রবালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই হয়তো নিজ থেকেই ভেঙে গেছে সেটা। তবে মাথাবিহীন হলেও এতে নাম লেখা আছে আমার। আর চমৎকার এই মূর্তিটিই তো আমার হাজার বছর পুরনো স্মৃতিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

কষ্ট কিন্তু কম করতে হয় নি আমাদের। ছিলাম যাযাবর জাতি। শুধু মিশে গিয়ে, মিলে গিয়ে এতোগুলো বছর রাজত্ব করে গিয়েছি বহাল তবিয়তে। মৌর্যরা তো পারে নি তাদের উত্তরসূরী তৈরী করে যেতে। সেই শূন্যস্থান পূরণ হলো আমারই পূর্বপুরুষদের দ্বারা।

বর্বরতা থেকে সামাজিকীকরণের যাত্রায় বাণিজ্যিকভাবে সফল সর্বধর্মসহিষ্ণু কুষাণ অধীশ্বর কনিষ্ক, Stay Curioussis

কনিষ্ক স্তূপের অবশিষ্টাংশ।

ভারতবর্ষের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ শাসনামল ছিলো কুষাণ সাম্রাজ্যের শাসন। কুষাণ আমলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিলো। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক কুষাণ মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায, হয়তো কুষাণরা বাংলাদেশেও এসেছিলো। তবে ড. আবদুল মমিন চৌধুরীর মতে, বাংলা যেহেতু তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল ছিলো, তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্র ধরেই হয়তো মুদ্রাগুলো বাংলাদেশে এসেছে। ড. শাহনাজ হুসনে জাহানের মতে, কুষাণ যুগে ইন্দো-রোমান লেনদেন খুব বেশি ছিলো বিধায় লেনদেন সংক্রান্ত কারণে মুদ্রাগুলো এ দেশে আসতে পারে। শরীফুল ইসলামের মতে, সাভারের সন্দীপ গ্রাম থেকে পাওয়া কুষাণ মুদ্রা প্রমাণ করে যে কুষাণ যুগে সাভার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ছিলো এবং মহাস্থান থেকে পাওয়া মুদ্রা ও সীলগুলো প্রমাণ করে যে মহাস্থানগড় সে সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো।