স্পেনের আল-আন্দালুস: মুরসদের স্বর্ণ যুগ

১৪৯২ সালের ১৭ই এপ্রিল, গ্রানাডা, স্পেন। রাজকীয় সভা চলছে আল-আন্দালুসের (Al-Andalus) আলহাম্বরা (Alhambra) রাজপ্রাসাদে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস উপস্থিত হয়েছেন স্পেনের রাজা ফার্দিনান্ড এবং রানী ইসাবেলার আমন্ত্রনে। আলহাম্বরা রাজপ্রাসাদের এই সভাতেই কলম্বাসের আমেরিকা অভিযান এবং তার জন্য অর্থ বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়। আজকের এই লেখা অবশ্য কলোম্বাস বা রানী ইসাবেলাকে নিয়ে নয়। এটি আসলে এই অতিথিরা যে প্রাসাদটিতে বসে এর সৌন্দর্য উপভোগ করছেন, তার নির্মাণের নেপথ্যে যারা, তাদের উত্থানের বিস্ময়কর উপাখ্যান নিয়ে। স্পেনের তখনকার মুরস শাসকরা আলহাম্বরা রাজপ্রাসাদটি ইউরোপের বুকে প্রথম নির্মাণ করেছিল ৮৮৯ সালের দিকে অত্যন্ত ছোট আকারে। পরবর্তীতে, চৌদ্দশো শতাব্দীতে এটাকে পরিপূর্ণ রাজপ্রাসাদ হিসেবে রূপান্তরিত করে স্পেনের মুরস শাসকরাই। তখনকার নাসরিদ (Nasrid Dynasty) রাজত্বের শাসক মোহাম্মদ ইবনে ইউসুফ বেন নাসের (আলহাম্বরার নামেই বেশী পরিচিত) এই প্রাসাদকে প্রথম রাজকীয় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন। সৌন্দর্য, সৃজনশীলতা, এবং নির্মাণ কৌশলের দিক থেকে এটি সন্দেহাতীতভাবে এখনও বিশ্বের একটি বিস্ময়।

এই প্রাসাদের সার্বিক ডিজাইন দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো সুদৃঢ় জ্যামিতিক সূত্রের উপর। নীচ থেকে উপর পর্যন্ত প্রাসাদের স্থাপত্য সুবিন্যাস্থ করা হয়েছে কতগুলো সুনির্দিষ্ট আনুপাতিক পরিমাপের (proportional ratio) উপর নির্ভর করে। প্রাসাদের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ডিজাইন একটি পুংখানুপুংখ আনুপাতিক হিশেবের নিয়ন্ত্রণে। এটির সৌন্দর্যের মূল রহস্য হলো কতগুলো যাদুগরী পরস্পরা অনুক্রমিক (sequence) পরিমাপ এবং নিখুঁত জ্যামেতিক গণনা। এই গাণিতিক হিসেব-নিকেশের একবিন্দু নড়চড় হয়নি প্রাসাদটির কোথাও। আলহাম্বরা প্রাসাদের নির্মাণ কৌশল এবং সৃজনশীলতা এখনো অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য।
এই অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্যকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের মননকে প্রথমে সম্পৃক্ত করতে হবে উত্তর আফ্রিকা তথা ইসলামিক জ্ঞান, সংস্কৃতি এবং দর্শনের গভীর মর্মার্থের সাথে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসে যায় আমাদের সবার মনে, যারা এই চমৎকার নিদর্শনটি নির্মাণ করেছিলেন আসলে তাঁরা কারা, কি তাঁদের পরিচয়? কোথা থেকে এসেছিলেন এই বুদ্ধিদীপ্ত জনগোষ্ঠী ইউরোপকে সাতশো বছরের উপর শাসন করে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে? এই স্মার্ট প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী মুরস (Moors) নামেই পরিচিত। মুরসরা আসলে উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলের কিছু উপজাতির সমন্বয়ে একটি মুসলিম জাতি গোষ্ঠী। এদের ইউরোপ বিজয় এবং শাসনের রোমাঞ্চকর ইতিবৃত্ত জানতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে অষ্টম শতাব্দীর উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায়।
ইতিহাস বলে, মুসলিমদের ইউরোপ শাসনের প্রথম গোড়াপত্তন হয় ৬৫২ সালে বাইজান্টাইন সিসিলী (Byzantine) জয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই বিজয় ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাদেরকে বিতাড়িত হতে হয় ইউরোপ থেকে সহসাই। পরবর্তীতে, ৭১১ খীষ্টাব্দে সাত হাজার উত্তর আফ্রিকার মুরস অশ্বারোহী স্পেন এবং মরক্কোর মধ্যকার জিব্রাল্টার জলপথ অতিক্রম করে স্পেনের দক্ষিণাংশ দখল করে ফেলে। এই জিব্রাল্টারকে এক সময় ইউরোপ মনে করতো এটি আফ্রিকার সাথে তাদের একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা। কিন্তু মুসলিম তথা মুরসরা এই প্রতিরক্ষা-জলপথকে বানিয়ে ফেললো তাদের জন্য ইউরোপ প্রবেশের সহজ একটি হাইওয়ে! শুরু হলো বুদ্ধিদীপ্ত শক্তিশালী এক নতুন সভ্যতার ইউরোপ শাসনের সাতশো বছরের বর্ণীল উপাখ্যান। এই নতুন সভ্যতার মূল উৎপত্তি স্থল আরবের মরুভুমি। এই সভ্যতার মূলশক্তির ভিত্তিস্তম্ভ ঈশ্বর অনুপ্রাণিত একশ্বরবাদের উপর স্থির বিশ্বাস এবং আস্থা। মুরসরা ইউরোপের দক্ষিণাংশে আইবেরিয়া (Iberia) অঞ্চলে এমন একটি সমাজ তৈরি করেছিল, যা ছিল অত্যন্ত সম্পদশালী, শক্তিশালী, বৌদ্ধিকভাবে কৌতুহলী, জ্ঞানের প্রতি উৎসুক, সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং প্রগতিশীল। জানতে ইচ্ছে করছে না খুব, এই রোমাঞ্চকর ইতিহাসের যাত্রা কোথা থেকে? কে সে এই ইতিহাসের প্রথম সাহসী রচয়িতা?
আব্দাল রহমান-১ (Abd al-Rahman I) ছিলেন বৃহত্তর আইবেরিয়ার মুসলিম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। মূলত পর্তুগাল এবং স্পেনের বিশাল এলাকাকে বলা হতো আইবেরিয়া। মুরসরা এই এলাকার নতুন নামকরণ করে আল-আন্দালুস (Al-Andalus)। আব্দাল রহমান ছিলেন দামেস্কের শাসক উমাইয়া রাজবংশের এক রাজপূত্র। তাঁর বয়স যখন উনিশ, ৭৫০ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী আব্বাসীয়রা এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উমাইয়াদের দামেস্কের ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে। আব্দাল রহমান তাঁর ভাই ইয়াহিয়া, চার বছরের ছেলে সুলায়মান, তাঁর মুক্ত দাস বেদর, আর বোনদের নিয়ে দামেস্ক থেকে পালিয়ে যান। আব্বাসীয়রা আব্দাল রহমানকে খুঁজতে সব জায়গায় অভিযান চালাতে লাগলো। সর্বস্ত লেলিয়ে দেওয়া হলো অসংখ্য অশ্বরোহী ঘাতক। আব্দাল রহমান বেদরকে নিয়ে ফিলিস্তান, সিনাই মরুভুমি, এবং মিশর হয়ে অনেক বিপদ-সংকুল পথ এবং চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ৭৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পৌঁছে যান স্পেনের আল-আন্দালুস এলাকার আলমুনেসে। স্পেনের মাটিতে আগে কখনো কোন উমাইয়া বংশের সদস্য পা ফেলেন নি।
ঐ সময়টাতে আল-আন্দালুসের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল? আল-আন্দালুসের আমির ছিলেন ইউসুফ আল-ফিহরী। তাঁর সাথে আল-সুমাইল আল-কিলাবীর ছিল মারাত্মক দ্বন্দ্ব, যদিও তারা ছিলেন পরস্পরের আত্মীয়। আমির ইউসুফ আল-ফিহরীর সমর্থক ছিল দক্ষিণ আরবের উপজাতীয়রা। অন্যদিকে, আল-সুমাইলের মূল শক্তি ছিল সিরীয় ও উত্তর আরবের উপজাতীয়রা। এদিকে উমাইয়া রাজপুত্র আব্দাল রহমানের স্পেন আগমন সংবাদ বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পরে পুরো আল-আন্দালুস এলাকা। স্পেনের মাটিতে শুরু হলো রাজনৈতিক কম্পন। শুধু তাই নয়, আমির ইউসুফ আল-ফিহরী এবং আল-কিলাবী আব্দাল রহমানের উপস্থিতিতে চিন্তিত হয়ে পড়ে সাংঘাতিকভাবে। তাঁরা বিভিন্নভাবে আব্দাল রহমানকে বশে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু আব্দাল রহমানের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। তিনি ধীরে ধীরে তার একটি শক্তিশালী সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তোলেন আল-আন্দালুস এলাকায়। উমাইয়া সমর্থকদের নিয়ে সংগঠিত করতে থাকেন একটি সৈন্য বাহিনী। আল-আন্দালুসের বিভিন্ন জায়গায় তখন বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিলো। আমির ইউসুফ এবং আল-কিলাবীর দ্বন্দ্বও তখন চরমে। এই সুযোগে ৭৫৬ সালের মার্চ মাসে আব্দাল রহমান স্পেনের সেভিল (Seville, Spain) দখল করে ফেলেন বিনা রক্তপাতে। তারপর দীর্ঘ যুদ্ধের পর আব্দাল রহমান আমির ইউসুফ এবং আল-কিলাবীকে পরাজিত করে জয় করেন কর্ডোবা। তিনি হন আল-আন্দালুসের নতুন আমির। আব্দাল রহমানের নেতৃত্বে মুরসদের শুরু হয় আল-আন্দালুসের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের এক অনন্য অধ্যায়।
তিনি তাঁর শাসনকে দক্ষ এবং কার্যকর করার জন্য এক আধুনিক প্রশাসন ব্যবস্থা প্রচলন করেন। ধর্মীয় স্বাধীনতা, বিশেষ করে ইহুদী এবং খ্রীস্টানদের নির্ভয়ে ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা দেন। তাঁকে বলা হয় আল-আন্দালুসের ত্রাণকর্তা। তিনি ধীরে ধীরে একটি নতুন সমাজ গড়ে তুলেন, যার ভিত্তি রচিত হয় পারস্পরিক সৌহার্দ্যতা, সহ-অবস্থান এবং আধুনিক নগর ব্যবস্থার উপর। আব্দাল রহমান স্হাপন করেন বাস্তবধর্মী প্রগতিশীল এক সমাজ যার মূল স্তম্ভ ছিল ইসলামিক দর্শন। সর্বনাগরিক কস্মোপলিটান শহর হিসেবে গড়ে তুলেন কর্ডোবাকে। যখন ইংল্যাণ্ডে মানুষের বসবাস ছিল কাঠের বাড়ীতে, তখন কর্ডোবার বেশীরভাগ ঘরবাড়ী ছিল ইট এবং মার্বেলের। তিনি কর্ডোবাকে রূপান্তরিত করেন একটি আধুনিক শহরে।
আল-আন্দালুসের জনগণ তখন ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে থাকলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কারণ? আব্দাল রাহমানের নতুন ইসলামিক সমাজ ছিল প্রগতিশীল। এই সমাজের ছিল জ্ঞান, আর্থিক সম্মৃদ্ধি, আধুনিক সামাজিক নীতিমালা, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা। তিনি কর্ডোবাতে প্রবর্তন করেন আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা। এই কৃষিই আমূল পরিবর্তন করে ফেলে আল-আন্দালুসের আর্থিক অবস্থা, এনে দেয় অসীম ধন-সম্পদ। কৃষির অভূত উন্নয়নের জন্য উদ্ভাবন করা হয় নতুন নতুন সব অভিনব কারিগরী কৌশল। ইউরোপে প্রথমবারের মতো শুরু হয় কাগজের উৎপাদন। কাগজ তো প্রথম আবিষ্কার করেছিল চীন, তাহলে তখনকার মুসলিমরা কাগজ উৎপাদনের জ্ঞান পেলো কোথা থেকে? স্পেনের মুসলিমরা কাগজ তৈরির কৌশল শিখেছিল চীনাদের কাছ থেকে, কারণ চীনের সাথে তাদের ছিল দীর্ঘ বাণিজ্যিক সম্পর্ক । এই অভূতপূর্ব আর্থিক উন্নয়নের অপরিসীম প্রভাব পরে জ্ঞান চর্চায়ও। নবম শতাব্দীতে ফ্রান্সের লাইব্রেরীগুলোতে যেখানে বইয়ের সংখ্যা ছিল ৯০০, ঠিক একই সময়, শুধুমাত্র কর্ডোবার একটি লাইব্রেরীতেই পাঁচ লক্ষের উপর বই ছিল। শুধু তাই নয়, কর্ডোবাতে গড়ে উঠেছিল ৭০টি লাইব্রেরী। প্রতি বছর লেখা হতো ষাট হাজারের মতো পুস্তক।

ঐ সময় এই শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট। চিকিৎসা বিদ্যায় ইউরোপের অন্যান্য দেশ কর্ডোবা থেকে পিছিয়ে ছিল কমপক্ষে চারশো বছর। সে সময়ের কর্ডোবার বিখ্যাত সার্জন আবু কাসিসের চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতার সংগৃহীত চিকিৎসার লিখিত বর্ণনা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে বিশ্বব্যপী। কর্ডোবার বিখ্যাত মার্বেলের ৬০০ স্থম্ভবিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করেন আব্দাল রহমান ৭৮৬ সালে তাঁর মৃত্যুর দু’বছর আগে। পরবর্তীতে আল-আন্দালুসের মুসলিম শাসকরা এই এলাকাকে নিয়ে যায় সভ্যতার চরম এক শিখরে। বিশেষ করে আব্দুর রহমান-৩ মাত্র একুশ বছর বয়সে ৯১২ সালে কর্ডোবার শাসনভার নিয়ে স্পেনের উন্নয়নকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান।
প্রায় তিনশো বছর স্পেনকে উন্নয়নের এক স্বর্ণ যুগে নিয়ে আব্দাল রহমানের মুরস শাসনের দুঃখজনক ইতি ঘটে একাদশ শতাব্দীতে। ১০৯৫ সালে স্পেনের খ্রীষ্টান সম্প্রদায় ইসলামের বিরুদ্ধে প্রথম ক্রুসেড ঘোষণা করে। খ্রীষ্টানরা আল-আন্দালুস আক্রমন করে স্পেনের উত্তর দিক থেকে। ধ্বংস করতে থাকে একের পর এক মুসলিম কীর্তি, পুড়িয়ে ফেলতে লাগলো সভ্যতার সব নিদর্শন, ভেঙে ফেলতে লাগলো কৃষির আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, শুরু হলো মুসলিমদের প্রতি জোরপূর্বক অন্যায় চাঁদাবাজি। তাদের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ালো “আমাদেরকে অর্থ দাও, নতুবা আমরা ধ্বংস করে ফেলবো তোমাদের সব।” এই অত্যাচার চললো পুরো একাদশ শতাব্দী ধরে।
পরের দুই শতাব্দী আল-আন্দালুসের দুর্বল মুসলিম শাসকরা টিকে থাকলো খ্রীষ্টান ক্যাথলিকদেরকে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে। এ থেকে রক্ষা পেতে মুসলিম শাসকরা মরক্কো থেকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসলো নতুন এক মুসলিম বাহিনী। এই নতুন বাহিনীর ভিত্তি ছিল কট্ট্রর ইসলামিক চিন্তা ধারা। তারা আল-আন্দালুসের অভূতপূর্ব বিজ্ঞান এবং কৃষ্টির উন্নয়ন ভালোভাবে গ্রহণ করলো না। শুরু হলো আবার নতুন ভাবে ধ্বংসলীলা। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের লুন্ঠন এবং ধ্বংস চললো মুসলিমের উপর মুসলিমের।
এই লেখাটি আরম্ভ করা হয়েছিল ১৪৯২ সাল দিয়ে, ফিরে যাই আবার সেই ১৪৯২ সালে। খ্রীষ্টান ক্যাথলিকরা স্পেন সম্পূর্ণভাবে তাদের দখলে নেয় ১৪৯২ সালেই। দীর্ঘ বিরোধ এবং যুদ্ধবিগ্রহের পর, ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারী মুসলিমরা বাধ্য হয় আলহাম্বরা প্রাসাদ খ্রীষ্টানদের হাতে তুলে দিতে। শুরু হয় স্পেনে জাতিগত ধ্বংসের (Ethnic cleansing) এক অকল্পনীয় পরিকল্পনা। শুধু তাই নয়, ১৪৯২ সালে ৩১ মার্চে রানী ইসাবেলা ইহুদীদের স্পেন থেকে বিতাড়িত করার ডিক্রী জারি করে। পরের শতাব্দীতে তিন লক্ষ মুসলিমকে স্পেন থেকে বিতাড়িত করা হয়, দশ লক্ষেরও বেশী আরবী মূল্যবান বই পুড়িয়ে ফেলা হয়। মুসলিমদের সাতশো বছরের গৌরবময় অধ্যায়কে এক এক করে মুছে ফেলা হয় ইচ্ছাকৃত ভাবে। স্পেনে মুসলিম সভ্যতার অস্তিত্ব এমনভাবে বিলুপ্ত করা হয় যাতে তাদের কোনো কীর্তি স্পেনে না থাকে। স্পেনের গল্প-উপন্যাস-সিনেমা মুরসেরকে উপস্থাপনা করা হয় ভিলেন রূপে। স্পেনে এখনো চলছে ইতিহাসকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার সিস্টেম্যাটিক অপচেষ্টা! দুঃখজনক!
তথ্য সূত্র:
* “When The Moors Ruled In Europe,” Channel 4 (UK), A documentary presented by Bettany Hughes, Directed by Timothy Copestake (2005).
* Irwin, Robert (2004). The Alhambra. Cambridge, MA: Harvard University Press.
* Alhambra Wikipedia.
ছবি:
* প্রথম দুটো ইমেজ ছাড়া, বাকী সবগুলো ইমেজ লেখকের।

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

হিন্দু দেব-দেবীর ধারণা প্রাচীন মধ্য এশীয় বিশ্বাসেরই প্রতিরূপ নয় তো?

সিংহবাহনের ওপর এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য নিয়ে চার হাতবিশিষ্ট এক দেবী যুদ্ধবাজ ভঙ্গিমায় আসীন নিজের সন্তানদের প্রতিরক্ষার জন্য। খুব পরিচিত লাগছে তাই না? নিশ্চয়ই দেবী দুর্গার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এ তো দুর্গা নয়, ব্যাক্ট্রিয়ান মাতৃদেবী ‘নানায়াহ’ বা ‘ননা’...

মহাবীর কর্ণের অন্তিম যাত্রা

সূর্যদেব অস্তে চলে যাচ্ছেন। গোধূলিবেলার লালচে আলোতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার এই জন্মের শত্রুকে। তার গান্ডিব ধরা উদ্ধত হাতে চকচক করছে অঞ্জলিক বাণ, যা আমার মস্তক ছেদ করার জন্য একটু পরেই ছুটে আসবে।পান্ডব বীর অর্জুন, যে আমার চরম শত্রু আবার আমার সহদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।ওই...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...