খ্রিস্টপূর্ব ১৩ শতকের প্রথম দিকে উনিশতম রাজবংশের প্রথম ফারাও প্রথম রামেসিসের ছেলে প্রথম সেটি ফারাও হবার পর পরই উপকূলীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য আমুরু জয়ের জন্য অগ্রসর হন। তার সঙ্গে তার ছেলে দ্বিতীয় রামেসিস বা রামেসিস দ্য গ্রেটও ছিলেন। তারা একত্রে কেনান ও কাদেশ জয় করেন এবং আমুরু রাজ্যকে পদানত করতে সমর্থ হন। এটি ছিলো মিশরের জন্য একটি বিশাল জয়। প্রথম বার কাদেশ জয়ের পর কিছু সংখ্যক সেনাবাহিনীর ঘাঁটি রেখে প্রথম সেটি ও দ্বিতীয় রামেসিস মিশরে ফিরে আসেন। কিন্তু শক্তিশালী শত্রুপক্ষ হিট্টাইট বাহিনীর কাছে সেই ঘাঁটি মোটেও শক্তিশালী ছিলো না। হিট্টাইটরা আবারো পূর্ণ শক্তি দিয়ে কাদেশ দখল করে নেন।
এরই মধ্যে প্রথম সেটি মৃত্যুবরণ করেন এবং মিশরের দীর্ঘতম ফারাও হিসেবে দ্বিতীয় রামেসিসের অভিষেক ঘটে। কেনানের ভূমি বরাবরের মতোই হিট্টাইট এবং মিশর উভয়ের জন্যই ছিলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য প্রতিযোগিতা বিদ্যমান ছিলো। আর এ প্রবণতাই তাদেরকে কাদেশের যুদ্ধের পথে ধাবিত করেছিলো।
হিট্টাইট রাজ্য তাদের সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য সিরিয়া ও কেনানের মধ্য দিয়ে চলমান বেশ কয়েকটি বাণিজ্য রুটের উপর নির্ভর করতো। মেসোপটেমিয়ার সাথে বাণিজ্য তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, কারণ এটি ছিলো হিট্টাইট পণ্যের একটি প্রধান বাজার। এই বাণিজ্য পথগুলো হিট্টাইটদেরকে তাদের বন্ধুভাবাপন্ন অঞ্চলগুলোর সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতে এবং তাদের শত্রুদেরকে বাধা দেবার জন্য অপরিহার্য ছিলো। এই অঞ্চলে প্রথম সেটির পরিচালিত মিশরীয় অভিযান হিট্টাইট সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছিলো।
অন্য দিকে, প্রাচীন মিশরের সার্বিক নিরাপত্তা ও মঙ্গলের জন্যও কেনান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ সালে হিক্সোসদেরকে বিতাড়িত করবার পর মিশরীয় উনিশতম রাজবংশের ফারাওরা আরও আক্রমণাত্মকভাবে কেনানে অভিযান পরিচালনা করেন। তারা তাদের প্রভাবশালী ক্ষেত্রগুলো পুনরুদ্ধার করতে ও একটি বাফার জোন তৈরী করতে চেয়েছিলেন, যা আক্রমণকারী শত্রুদেরকে মিশরে প্রবেশে বাধা দেবে এবং এই বাফার জোনকে আরও প্রসারিত করবার প্রচেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, যতোক্ষণ না পর্যন্ত তারা হিট্টাইটদের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করে আরও শক্তিশালীভাবে কাদেশের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন তার রাজত্বের পঞ্চম বছরে। আমুরু রাজ্যের শাসকেরা প্রথম সেটির অনুগত ছিলেন বলে কেনান পর্যন্ত পুনরায় মিশরীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা রামেসিসের জন্য কঠিন ছিলো না। বাকি ছিলো শুধু কাদেশের সীমানা পেরোনো।
হিট্টাইট এবং মিশরীয় উভয় পক্ষই আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য বিশাল সেনাবাহিনী সংগ্রহ করেছিলেন। প্রতিটি সেনাবাহিনীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ছিলো। রামেসিসের নেতৃত্বে ২০ হাজার মিশরীয় সেনাবাহিনীর একটি দলকে সমান চার ভাগে বিভক্ত করে কাদেশ দখলের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিলো। পাঁচ হাজার সৈন্যসংখ্যার দলগুলোর নাম ছিলো যথাক্রমে ‘আমুন’, ‘রা’, ‘তাহ’ ও ‘সেঠ’।
হিট্টাইট সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন রাজা দ্বিতীয় মুওয়াতাল্লিস। তিনিও রামেসিসের মতোই একজন দক্ষ সেনাপতি ছিলেন। মুওয়াতাল্লিস তার শাসনামলে অসংখ্য রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সামরিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। একই সাথে তিনি একজন দক্ষ কূটনীতিবিদও ছিলেন এবং সফলভাবে প্রতিবেশীদের সাথে চুক্তিও গড়ে তুলতেন, যার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য চুক্তি ছিলো ট্রয়ের একটি রাজ্য উইলুসার সাথে। মিশরের সাথে আসন্ন সংঘর্ষের আশঙ্কার কারণে মুওয়াতাল্লিস হিট্টাইট রাজধানীকে হাত্তসা থেকে দক্ষিণের শহর তারহুনতাসাতে স্থানান্তরিত করেছিলেন, যা সিরিয়ার কাছাকাছি ছিলো। হিট্টাইট সেনাবাহিনীতে কাদেশ, আলেপ্পো, উগারিট, মিতান্নি, কারচেমিশ, উইলুসা এবং উত্তর ও পশ্চিম অ্যানাটোলিয়ার বেশ কিছু অংশের মিত্রবাহিনীও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। মিশরীয়রা হিট্টাইট সেনাবাহিনীতে উনিশটি মিত্রবাহিনীর একটি তালিকা রেকর্ড করেছিলো।
কাদেশের এই যুদ্ধে হিট্টাইট ও মিশরীয়দের প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার রথ অংশগ্রহণ করেছিলো। এ কারণে এই যুদ্ধকে ‘রথ যুদ্ধ’-ও বলা হয়। তবে হিট্টাইট রথগুলো থেকে মিশরীয় রথগুলো কিছুটা উন্নত ছিলো। হিট্টাইট রথগুলো তুলনামূলক ভারী, ধীরগতিসম্পন্ন এবং তিন জন যাত্রী বহনে সক্ষম ছিলো। অন্য দিকে, মিশরীয় রথগুলো ছিলো তুলনামূলক হালকা, দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং দুই জন যাত্রী বহনে সক্ষম।
খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৪ সালে রামেসিস ‘আমুন’, ‘রা’, ‘তাহ’ ও ‘সেঠ’ সেনাবাহিনী নিয়ে এক বিপদসংকুল ও বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে কাদেশ জয়ের জন্য অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে দুই জন হিট্টাইট সেনা আসলেন তাদের কাছে এবং জানালেন যে কাদেশের পথে মিশরের আর কোনো বাধা নেই, কারণ হিট্টাইট রাজা মুওয়াতাল্লিস রামেসিসের আসার খবর শুনে ভয়ে পালিয়ে গেছেন। রামেসিসের নিজস্ব ক্ষমতা ও প্রভাব নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিলো না। তার গৌরব তাকে সে সময় অন্য কোনো আশঙ্কার কথা ভাবায় নি। তিনি মুওয়াতাল্লিসের পালিয়ে যাবার কথা শুনে শুধুমাত্র ‘আমুন’ সেনাদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হলেন, পিছিয়ে রইলেন ‘রা’, ‘তাহ’ ও ‘সেঠ’। রাত হয়ে গেলে রামেসিস তার অল্প সংখ্যক সেনাবাহিনী নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করলেন এবং সেই ক্যাম্পে থাকাকালীন দুই জন হিট্টাইট গুপ্তচর ধরা পড়লেন রামেসিসের বাহিনীর কাছে। তাদেরকে ক্রমাগত টর্চার করবার এক পর্যায়ে রামেসিসের কাছে তারা মুওয়াতাল্লিসের আসল ষড়যন্ত্রের কথা ব্যক্ত করলেন। আসলে মুওয়াতাল্লিস নিজের পালিয়ে যাবার খবর প্রচার করে রামেসিসকে ফাঁদে ফেলেছিলেন এবং চল্লিশ হাজার সেনা নিয়ে তিনি আশ্বস্ত রামেসিসের আসার অপেক্ষায় বসে ছিলেন। ইতিমধ্যেই আড়াই হাজার হিট্টাইট রথ জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলো। তাই রামেসিসের এই ষড়যন্ত্র হজমের জন্য তখন ভীষণ দেরী হয়ে গিয়েছিলো।
হিট্টাইট সেনাবাহিনী ততোক্ষণে রামেসিসের পিছিয়ে পড়া অপ্রস্তুত সেনাদলের উপর হামলে পড়লে তারা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেন। তবে রামেসিসও হাল ছাড়েন নি। তিনি আবারো তার বেঁচে থাকা সেনাবাহিনীকে উৎসাহ যোগালেন এবং পাল্টা আক্রমণ করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। হিট্টাইটদের অতর্কিত আক্রমণে মিশরীয় বাহিনী সংখ্যায় অনেক কমে গেলেও হিট্টাইটদের তুলনায় মিশরীয় সেনা ছিলো অধিক পারদর্শী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সেই সাথে মিশরীয় রথগুলো তো তুলনামূলক উন্নত ছিলোই। তাই সেদিনের মতো কোনো পক্ষই যুদ্ধে জয়ী হতে পারে নি। জানা যায়, মিশরীয় ও হিট্টাইটরা সেই যুদ্ধে সাময়িক সন্ধি করে ফিরে গিয়েছিলেন। তবে মিশরে ফিরে রামেসিস কাদেশের এই যুদ্ধে নিজের জয়ী হবার প্রচারণা চালিয়েছিলেন। একই প্রচারণা হিট্টাইটরাও চালিয়েছিলেন। দুই পক্ষেরই দাবী ছিলো কাদেশের যুদ্ধে বিজয় তাদের। তবে সত্যি বলতে সেই যুদ্ধে দুই পক্ষই বীরের মতো লড়াই করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত কেউই জয়ী হতে পারেন নি।
দ্বিতীয় রামেসিসের কাদেশের যুদ্ধ জয়ের এই প্রোপাগান্ডা তাকে মিশরের দীর্ঘতম ফারাও এর খ্যাতি এনে দিয়েছিলো। প্রায় সত্তর বছর রাজত্ব করেছিলেন তিনি। তবে শক্তিশালী এই রামেসিসের কঠোর মনোভাব একটা সময় পরিবর্তিত হয়েছিলো। তিনি কাদেশের যুদ্ধে চিরবিরতি দিয়ে হিট্টাইটদের সাথে স্থায়ী সন্ধি গড়ে তুলতে রাজি হয়েছিলেন। ইতিহাসে এই সন্ধিই ছিলো বিশ্বের প্রথম শান্তি চুক্তি।
কাদেশের যুদ্ধের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। এটিই ইতিহাসের একমাত্র যুদ্ধ, যার বর্ণনার দলিল মিশর ও হিট্টাইট উভয় জায়গাতেই মিলেছে এবং উভয় পক্ষই এই যুদ্ধ জয়ের প্রচারণা চালিয়েছে। কাদেশের শান্তিচুক্তিই সর্বপ্রথম নারীর ক্ষমতায়ন ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো, কেননা চুক্তিটিতে হিট্টাইট রাজার পাশাপাশি হিট্টাইট রাণী পুদুহেপারও স্বাক্ষর ছিলো, যা রাণীর মতামতের গুরুত্বকেই ফুটিয়ে তোলে। হিট্টাইট রাজকুমারীর সাথে ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের বিয়ের মাধ্যমে কাদেশের এই শান্তিচুক্তি স্থায়িত্ব লাভ করেছিলো।
বিশ্বের এই প্রথম লিখিত সন্ধিটি আজও ইস্তাম্বুলের প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। হিট্টাইট ও মিশরীয়দের তত্ত্বাবধানে অবশ্য আলাদা চুক্তিপত্র তৈরী হয়েছিলো। হিট্টাইটরা চুক্তিটি লিখেছিলেন কাদামাটির ট্যাবলেটে। আর মিশরীয়রা রূপার ট্যাবলেটে দুটি চুক্তিপত্র তৈরী করেছিলেন; একটি লেখা ছিলো কিউনিফর্ম লিপিতে, অন্যটি ছিলো হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে। বাকি দুটো চুক্তিপত্রের মধ্যে একটি ইউনাইটেড ন্যাশনসের দেয়ালে টাঙানো আছে।
রেফারেন্সঃ
- Battle of Kadesh: Ancient Egypt vs The Hittite Empire
- ‘মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত’ –এস এম নিয়াজ মাওলা