গিলগামেশ ছিল মেসোপটেমীয় পুরানের একটি চরিত্র। তার গল্প মানবিক ইতিহাসের প্রথম মহাকাব্যে বর্ণনা করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে গিলগামেসের মহাকাব্য নামে পরিচিত। এটিকে সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্যকর্ম হিসেবে ধরা হয়। গিলগামেশের কাহিনী প্রথমে পাঁচটি সুমেরীয় কবিতার মাধ্যমে শুরু হয় যা বিলগামেশ (গিলগামেশের সুমেরীয় নাম), এই মহাকাব্যের প্রথম টিকে থাকা সংস্করণ যা “পুরনো ব্যাবিলনীয়” সংস্করণ নামে পরিচিত যা খ্রিস্টপূর্ব আঠারো শতকে তৈরি।

আক্কাদীয় ভাষায় গিলগামেশ মহাকাব্যের মহাপ্লাবন ফলক; Image source: wikipedia

এর মাত্র কিছু ফলক টিকে রয়েছে। এর পরবর্তি পাওয়া সংস্করণ খ্রিস্টপূর্ব ১৩ থেকে ১০ শতকের। ১২ ফলকের এই সংস্করণের দুই-তৃতীয়াংশ উদ্ধার হয়েছে। গিলাগামেস মহাকাব্যের জন্মস্থান মেসোপটেমিয়া – টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস এর মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে,বর্তমানের ইরাক। সুমেরীয়-আক্কাদ ভাষায় লেখা সেই মহাকাব্যের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্ট – পূর্ব ১৮০০। কিন্তু ইতিহাস মনে রাখেনি গিলগামেশ কাব্যের কবির নাম। গিলগামেশের মহাকাব্য বহু সাহিত্য, শিল্প এবং সঙ্গীত সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে যা থিওডোর জিলকোস্কি তার “গিলগামেশ এমং আস: মডার্ণ এনকাউন্টার উইথ দ্য এনসিয়েন্ট এপিক” বইয়ে তুলে ধরেছেন। মেসোপটেমিয়ার পুরনো সেই দিনের কথা চারণদের গানে গানে ভেসে বেড়াত। এপিক অফ গিলগামেশ” এর  origin বা উৎপত্তিতেও জড়িয়ে আছে সেই সব উপাদানের প্রভাব।

গিলগামেশ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরই গিলগামেশের মহাকাব্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি বিভিন্ন মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। আক্কাদীয় ভাষায় মাটির তৈরি চাকতিতে কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা এই অসম্পূর্ণ মহাকাব্যটি উদ্ধার করা হয়েছে ১৮৪৯ সালে সম্রাট আসুরবানিপালের নিনেভের ( খ্রীঃ পূঃ ৭ম শতাব্দী) রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ থেকে, প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে।আসুরবানিপাল ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী।এগুলি তিনি তার গ্রন্থাগারে সংরক্ষন করে রেখেছিলেন। মিডিয়া ও কালডিয়ার যৌথ আক্রমণে পতন হয় আসিরীয় সাম্রাজ্যের, কাব্যটির মোট চরণ সংখ্যা ৩ হাজার। জনশ্রুতি আছে গিলগামেশ ছিলেন উরুক রাজ্যের রাজা। দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার উরুক এর প্রথম রাজবংশের পঞ্চম রাজা। লগানবান্দা ও দেবী নিনসানের পুত্র। এই কাব্যে গিলগামেশের দুঃসাহসীক স্বর্গাভিযানের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে।

গিলগামেশের মহাকাব্যের দ্বিতীয় টুকরো, ইরাকের সুলায়মানিয়াহ জাদুঘর; Image source: Wikimedia

মাটির চাকতিগুলি উদ্ধার করার পর জার্মান স্কলার George Smith কিউনিফর্ম ও হায়ারোগ্লিফিক্স বিশেষজ্ঞ লেগে রইলেন এর পাঠোদ্ধারের কাজে। সাফল্যও পেলেন। পরে আরো কিছু চাকতি আবিষ্কার করা হয়। মোট ৭৩ টি মাটির- চাকতিকে জোড়া লাগিয়ে হয়েছে গিলগামেশ কাব্য। আকৃতিতে অবশ্য ব্যাস-বাল্মিকী বা হোমারের রচনার মতো নয় এই মহাকাব্য কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এক বাক্যে মেনে নেন এর মহাকাব্যিক আবেদনের কথা।

 জার্মান স্কলার George Smith

গিলগামেশ ছিল সর্বসুন্দর একটা মানুষ কিন্তু অত্যাচারী এবং নারীর প্রতি ছিলো তার অদম্য লালমা। প্রতিটি প্রজার নব বিবাহিত বউকে প্রথম রাতে সে উপভোগ করতো। অত্যাচারিত উরুকবাসীরা দেবতার কাছে অভিযোগ করলো , তাদের দাবি ছিলো – গিলগামেসের সীমাহীন ঔদ্ধত্য আর একাধিপত্যে বন্ধ করতে হবে। এখান থেকেই মূল আখ্যানের সূচনা।

এনকিডু, গিলগামেশের বন্ধু

ঈশ্বর গিলগামেসকে শায়েস্তা করার জন্য এনকিডুকে সৃষ্টি করলেন। অরন্যচারী এনকিডু, বন্য প্রানীদের সাথে তার মিতালী। এক শিকারীর মুখে সেই অরন্যচারী এনকিডুর ক্ষমতার কথা শুনে তাকে বশে আনার জন্য গিলগামেস কাজে লাগালেন এক অসামান্য সুন্দরী পতিতাকে, নাম শামহাত। এনকিডু তার বশ হলো তারপর শামহাতের কথামতো সে চলল গিলগামেসের সাথে বন্ধুত্ব করতে। কিন্তু রাজপ্রাসাদে আসার পথে সে রাজার ব্যাভিচারের কথা জানতে পারে, এক প্রজার নববিবাহিতাকে প্রথম দিন জোর করে ভোগ করায় রাগে অন্ধ হয়ে এনকিডু বাধা দেয় রাজাকে। এর ফলে দুজনের মাঝে শুরু হয় এক দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ। পরে তারা বন্ধু হয়, দিনে দিনে সে বন্ধুত্ব গভীর হয়ে ওঠে। মিলিতভাবে তারা অরন্যের রক্ষক হুমবাবার বিরুদ্ধে সিডার অরন্যে অভিযান চালায়। দুই বীরের আক্রমণে মৃত্যু হয় হুমবাবার। তারপরেই আসে এক বিপদ, গিলগামেসের রূপমুগ্ধ দেবী ইসথার গিলগামেসকে চেয়ে না পেয়ে প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে ওঠেন। তিনি ছেড়ে দেন স্বর্গের ষাঁড়কে উরুক নগরী ধ্বংসের কাজে। তার আক্রমণে অনেকে মারা গেলেও গিলগামেস আর এনকিডুর যৌথ আক্রমণে মারা যায় সেই ষাঁড়। তবে এই বীরগাথার পরেই ট্র্যাজেডি নেমে আসে এনকিডুর জীবনে। ঈশ্বরের ক্রোধে এনকিডু প্রান হারায়।

গিলগামেশ রথে চড়েছিলেন, লুডমিলা জেমনের রচিত গিলগামেশ কিং বইটি থেকে।

এনকিডুর মৃত্যুতে গিলগামেশ ভেঙ্গে পড়েন,মৃত্যুভয় তার জীবনেটাকে বদলে দেয়। গিলগামেসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এই জায়গাটিতে আলোকপাত করেছেন মহাকবি রিলকে। বলেছেন “গিলগামেস হল মৃত্যু-ভীতির মহাকাব্য।” কথাটা মোটামুটি সত্য কারন এই মৃত্যুভয়ই গিল গামেসের জীবনকে করে এক নতুন পথে চালায়। মৃত্যু কে জয় করার সঙ্কল্প নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে পৃথিবী -ভ্রমণে। উদ্দেশ্য তার একটাই- সে দেখা করবে উতা-নাপিসতির সাথে। সুমেরুদেশের ওপর দিয়ে কয়েক বছর আগে বয়ে গেছে মহাপ্লাবনের ঢেউ, ব্যাপক ধ্বংসলীলার পরে একমাত্র জীবিত পুরুষ এই উতা নাপিসতি ।একমাত্র জীবিত নারী তার স্ত্রী। এই দম্পতি বাস করে প্রেতলোকে, ঈশ্বরের আদেশে তারা অমর। এই দম্পতির চেষ্টায় আর দেবতার ইচ্ছায় আবার নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে মানবসমাজ, জন্ম নিয়েছে প্রানীকূল। এই দম্পতির খোঁজে গিলগামেস রওনা হয় এক বিপদ সঙ্কুল অভিযানে।

গিলগামেশের মূর্তি, ইউনিভার্সিটি অফ সিডনি, সিডনি, নিউ সাউথ ওয়েল্‌স, অস্ট্রেলিয়া

উতা নাপিসতির কাছেও কোনো উত্তর পায়না গিলগামেস। উতা নাপিসতি তাকে অনন্ত জীবনের স্বপ্ন ছেড়ে দিতে বলেন, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াই যে জীবিত মানুষের ভবিতব্য – তাও তাকে স্পষ্ট করে বলে দেন। তিনি আরও বলেন যে মৃত্যুর স্বরূপ বোঝা কোন জীবিতের পক্ষে সম্ভব না। তার কথায় যে সত্য সেটা গিলগামেসের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উতা-নাপিসতি একটা পথের সন্ধান দেন গিলগামেসকে, দেন জীবনকে সঠিক ভাবে চালনোর মূলমন্ত্র। তার কাছে এসে গিলগামেস শেষপর্যন্ত বুঝতে পারে পরিবর্তনশীল এই জগতে একমাত্র কীর্তিমান ব্যাক্তিই অমর আর তিনিই চিরকাল বেঁচে থাকেন মানুষের হৃদয়ে। সেই পথে চলার লক্ষ্য নিয়ে উতা-নাপিসতির কাছ থেকে ফিরে আসে উরুক এর রাজা গিলগামেস। তারপর প্রজার উন্নতির জন্য সে সঁপে দেয় তার নিজের বাকী জীবন।

সিডার বনের যাত্রায় গিলগামেশের দ্বিতীয় স্বপ্ন। তুরস্কের হাট্টুসা থেকে গিলগামেশ মহাকাব্য। খ্রিস্টপূর্ব ১৩ শ শতাব্দী। নিউজ মিউজিয়াম, জার্মানি