খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে শাম অঞ্চলে বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলো- ‘পালমিরা’। পালমিরা সিরিয়ার সেই শহর যা বহু বছর ধরে প্রাচীনকালের অপূর্ব সব নিদর্শন বহন করে আসছিলো। ইউরোপ থেকে শুরু করে চীন, এমনকি ভারত থেকেও ব্যবসায়ের জন্য বণিকেরা ভিড় করতো এ শহরে। এ শহর সম্পর্কে ডেভিড পিটার ব্যাখ্যা করেছেন “যে শহরে প্রাচ্য মিলিত হয় পাশ্চাত্যে সঙ্গে”

অডিনেথাসের অধীনে রোমান অঞ্চল (হলুদ) এবং পালমিরীয় রাজ্য (সবুজ) Image source: Wikimedia

শহরটি আরেকটি কারণে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ সেটা হলো- “রানী জেনোবিয়া”। খ্রিষ্টাব্দ প্রথম শতকে পালমিরা রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। রোমানদের কাছে আর দশটা রাজ্যের থেকেও পালমিরার মর্যাদা ছিলো কিছুটা বেশি। কারণ এশিয়ার সাথে রোমের যোগাযোগের একমাত্র রুট ছিলো এই পালমিরা। এছাড়াও পারস্যসহ আশেপাশের রাজ্যগুলোর বিদ্রোহ ঠেকাতে পালমিরার সামরিক সাহায্যেরও প্রয়োজন ছিলো রোমান সম্রাটের। তাই নিজেদের স্বার্থেই সমস্ত কর মওকুফ করে এবং শাসক’কে রাজার সম্মান দিয়ে পলিমারকে স্বাধীন করে দিয়েছিলো রোম। এবং এর প্রতিদানে আশেপাশের সমস্ত এলাকায় বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে পারস্য ও শামে রোমানদের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন পলিমার রাজা ওডেনেইথাস। আর জেনোবিয়া হলো রাজা ওডেনেইথাসের দ্বিতীয় স্ত্রী। আজ আমরা রানী জেনোবিয়ার গল্পই জানবো। আর কেনোই জানবো তার সম্পর্কে? কে এই মহীয়সী নারী?

ওডেনেইথাসের আবক্ষ মূর্তি। Image source: Wikimedia

২৬৭ খ্রিস্টাব্দে এক সামরিক অভিযান থেকে ফেরার পথে আততায়ী হামলার শিকার হয়ে মারা যান রাজা ওডেনেইথাস এবং তার বড় ছেলে মিয়োনিয়াস । রাজা ও রাজপুত্রের মৃত্যুর পর কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে শেষমেষ রাজ্যের শাসনভার এর দায়িত্ব নেন জেনোবিয়া। সে সময়ে কোনো নারী অন্তঃপুর থেকে বের হয়ে এসে নিজ যোগ্যতায় নিজের এক আলাদা পরিচয় সৃষ্টি করা কম কথা নয়, যা সম্ভব করতে পেরেছিলন এই জেনোবিয়া। ইতিহাসের পাতায় তাঁর চরিত্রটি কখনো নির্ভীক যোদ্ধার, কখনো ষড়যন্ত্রকারী খলনায়িকার, কখনো বিচক্ষণ ও সংস্কৃতি অনুরাগী এক শাসক আবার কখনো বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য হারানোর এক উদাহরণ। যে যেভাবেই জেনোবিয়ার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরুক না কেনো, তিনি ইতিহাসের পাতায় তাঁর শক্ত জায়গা ঠিকই করে নিয়েছিলেন।

রানী জেনোবিয়া তার সৈন্যদের সম্বোধন করছেন। Image source: allthatsinteresting

জেনোবিয়ার বংশ পরিচয় সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও ধারণা করা হয় স্থানীয় এক অভিজাত পরিবারে জন্ম ছিলো তার। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেকে মায়ের দিক থেকে ক্লিওপেট্রার বংশধর হিসেবে দাবি করেছেন। তাঁর চেহারায় ছিলো গারো এক কৃষ্ণকায় আভা, প্রচলিত স্বাভাবিকতার চেয়েও বেশি শক্তিশালী ও কালো ছিলো তাঁর চোখ, ছিলো ঐশ্বরিক মহানুভবতায় ভরা আত্মা ও অস্বাভাবিক সৌন্দর্য। কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে তাঁর জীবনের মূল পাঁচটি ঐতিহাসিক বছরের ইতিহাস এবং তাঁর প্রকৃত রূপ ও চরিত্র বুঝতে খুব একটা সাহায্য করে না। এমনকি তার পাঁচ বছরের রাজত্বের ঘটনাও একেক জায়গায় একেকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, আর সেই ইতিহাস লিখেছিলো রোমানরা। তারা সঠিকভাবে সব লিখেছিলো কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে কেননা জেনোবিয়ার সাথে তাদের চিরকাল বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। জেনোবিয়ার প্রতিকৃতির যে একমাত্র চিহ্ন পাওয়া যায় তা হলো, সে সময়কার প্রচলিত একটি মুদ্রা যার উপর তাঁর ছবি মুদ্রণ করা। যদিও গিবন ও অন্যান্য ইতিহাসবিদগণ তাদের লেখায় জেনোবিয়ার রূপের বেশ ভূয়সী প্রশংসা করেছেন,কিন্তু মুদ্রায় খচিত আদলে বেশ ভিন্ন রূপই দেখা যায়।

জেনোবিয়ার প্রতিকৃতি খচিত মুদ্রা। Image source: Wikimedia

রানী হিসেবে জেনোবিয়া তাঁর মৃত স্বামীর রাজ্যনীতি অনুসরণ করেন। ২৬৯ সালে জেনোবিয়ার নেতৃত্বে মিশর অবরোধ করে পালমিরার সেনারা। এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর রোম শাসিত দেশটির পতন ঘটে এবং নিজেকে ‘মিশরের রানী’ ঘোষণা করেন জেনোবিয়া। মিশর দখলের পর জেনোবিয়ার সামরিক অভিযানের তালিকা আরো বিস্তৃত হয়। এক বছরের মাথায় পালমিরা পরিণত হয় এক বিশাল সাম্রাজ্যে। একের পর এক অভিযানে সিরিয়া, লেবানন এবং মিসরসহ আরব ও এশিয়া মাইনরের এক বিস্তীর্ণ এলাকা চলে আসে তাদের অধিকারে। কথিত আছে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে রানী জেনোবিয়া নিজে অংশ নিতেন এসব যুদ্ধে, আর দশজন যোদ্ধার সাথে পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিতেন মাইলের পর মাইল পথ।

অরেলিয়াস জেনোবিয়াস’ নামে একজনের সম্মানে লেখা শিলালিপি, যা পালমিরায় পাওয়া গেছে, অনেকেই যাকে জেনোবিয়ার পিতা মনে করেন; source: Wikimedia commons

একটা পর্যায়ে তুরস্কের আস্কারা পর্যন্ত পৌঁছে যায় পালমিরার পতাকা। ইউরোপে তাদের প্রবেশ সময়ের ব্যাপার মাত্র। এদিকে রানী জেনোবিয়া তাঁর সাম্রাজ্য বাড়ানোর জন্য একের পর এক যুদ্ধ-বিগ্রহ করে বেড়াচ্ছেন আরব জুড়ে, ঠিক তখন রোমানরা ব্যস্ত নিজেদের ঘর গোছানোর কাজে। ২৭০ সালে রোমের সম্রাট ক্লডিয়াসের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক কমান্ডার অরেলিয়ান। ক্ষমতায় বসেই নতুন সম্রাট বেরিয়ে পড়েন বেদখল হয়ে যাওয়া রাজ্যগুলো দখল করতে। পরবর্তীতে পালমিরার দিকে নজর দেন অরেলিয়ান । ততোদিনে রোমানদের ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে, রোমানদের জন্য আরব এবং এশিয়ায় যাওয়ার পথগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন রানী জেনোবিয়া। আর নিজের সাম্রাজ্যে ছেলের নামে মুদ্রাও চালু করে দিয়েছেন তিনি। সবদিক বিবেচনা করে অরেলিয়ান ঠিক করলেন এবার আরবে অভিযান চালাবেন তিনি, পত্র পেয়ে জেনোবিয়াও জানিয়ে দিলেন রোমান আগ্রাসন মোকাবেলা করতে তিনি পুরোপুরি প্রস্তুত। অবশেষে তুরস্কের এন্টিওচ শহরে এসে মুখোমুখি হয় দুই পক্ষ।

২০১০ সালে পালমিরার ধ্বংসাবশেষ; Image source: Wikimedia Commons

পালমিরিনদের মূল শক্তি ছিলো তাদের তীরন্দাজ ইউনিট। বিষাক্ত শর দিয়ে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ করতে পারতো তারা। যে কারণে নিজেদের তুলনায় আয়তনে বড় সেনাবাহিনীকেও হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিলো তাদের। সামরিক কমান্ডার হিসেবে অরেলিয়ানও খুব ভালোভাবেই জানতেন সেটা। তাই তীরন্দাজদের এড়াতে একটা বুদ্ধি আঁটেন তিনি। প্রতিটি সামরিক বাহিনীতে অশ্বারোহী ইউনিট থাকে সামনের সারিতে, তার পেছনে পদাতিক আর সর্বশেষে তীরন্দাজরা। অন্যদের তুলনায় গতি বেশি হওয়ার কারণে পেছনের ইউনিটগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায় অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ভেতর।

পালমিরা মানচিত্র ২৭১ খ্রিস্টপূর্ব

আর এই বিষয়টাকে কাজে লাগান অরেলিয়ান, যুদ্ধ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি পিছু হটতে নির্দেশ দেন রোমানদের। পালমিরিনরা এটাকে দুর্বলতা ভাবলেও আসলে অরেলিয়ানের উদ্দেশ্য ছিলো শত্রুপক্ষের তীরন্দাজের নাগালের বাইরে আসা। টোপ গিলে ঠিকই তাদের পিছু নিতে শুরু করে পালমিরার অশ্বারোহীরা। তীরন্দাজদের নাগালের বাইরে আসতেই সেনাপতির নির্দেশে ঘুরে দাঁড়ায় রোমানরা, তাদের এই আচমকা ঘুরে দাঁড়ানোর ফলে মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে পালমিরিনদের ফ্রন্ট লাইন। আর নিমিষেই বিজয়ের উল্লাস পরিণত হয় পরাজয়ের গ্লানিতে। ৭০ হাজার সেনা নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এমিসার দিকে রওনা দেন জেনোবিয়া। এমিসাতে পৌঁছে আরও এক প্রস্থ যুদ্ধ হয় দুই পক্ষের ভেতর। আবারও সেই একই ভুল, একইভাবে পরাজিত হন জেনোবিয়া। সামান্য কিছু যোদ্ধা নিয়ে পালমিরা ফেরত আসতে সক্ষম হন তিনি। কিন্তু অরেলিয়ান ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নয়, রানীর পেছন পেছন তিনিও এসে উপস্থিত হন এখানে এবং তার বাহিনীকে নির্দেশ দেন গোটা শহরটাকে ঘিরে ফেলতে।

১৯৯৮ সালের সিরিয়ান ৫০০ সিরিয়ান পাউন্ড নোটে জেনোবিয়া; Image source: Wikimedia Commons

আগে থেকে অবরোধের প্রস্তুতি না থাকায় কিছুদিনের ভেতর খাদ্য সংকট দেখা দেয় পালমিরা শহরে। এ পরিস্থিতিতে দুই পক্ষ থেকেই সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো একবার কিন্তু জেনোবিয়া নিজের সিংহাসনের দাবিতে অনড়। তিনি কিছুতেই রোম সম্রাটের অনুগত্য করবেন না। অবশেষে যেকোনো উপায়ে শহরটিতে প্রবেশ করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন অরেলিয়ান। আর নিশ্চিত পরাজয় টের পেয়ে রোমানদের নজর এড়িয়ে কৌশলে পালমিরা থেকে বের হয়ে যান জেনোবিয়া। একটি উটের পিঠে চড়ে পুত্রসহ রানী রওনা দেন পারস্যের দিকে। আশা করেছিলেন পারস্যের সহায়তা নিয়ে পালমিরাকে মুক্ত করবেন তিনি। কিন্তু পারস্যে পৌঁছানোর অনেক আগেই বুহ্য ভেঙ্গে পালমিরাতে প্রবেশ করে রোমান বাহিনী। তারা পালমিরার প্রত্যেকটি নগরীকে গুঁড়িয়ে দেয় যারা জেনোবিয়ার পক্ষে ছিলো, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় গোটা শহর। আর জেনোবিয়ার পালিয়ে যাওয়ার খবর জানতে পেরে তাঁকে ধরার জন্য বিভিন্ন দিকে সেনাবাহিনী পাঠান অরেলিয়ান। অবশেষে ফোরাত নদীর তীরে পুত্রসহ রোমানদের হাতে ধরা পড়েন রানী জেনোবিয়া। ধরা পড়ার পর জেনোবিয়ার ভাগ্যে কি ঘটেছিলো তা আর জানা যায়নি। কারও মতে, তিনি বন্দী অবস্থাতেই মারা গেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছে, অরেলিয়ান নাকি তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মুক্ত করে ইতালির একটি শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তবে নিশ্চিতভাবে তাঁর পরিণতির কথা কেউই বলতে পারেনি। রানী জেনোবিয়ার পতনের পর আবারও রোম শাসন শুরু হয় পালমিরাতে। কিন্তু বিধ্বস্ত এ শহর তার জৌলুস আর কখনোই ফিরে পায়নি।

পরাজিত জেনোবিয়াকে অরেলিয়ানের সামনে হাজির করার চিত্র শিল্পীর তুলিতে; Image source: allthatsinteresting

মূলতঃ জেনোবিয়া নামের এই যোদ্ধাসম্রাজ্ঞী ২৫০ থেকে ২৭৫ সাল পর্যন্ত টানা ২৫ বছর তাঁর সিরিয়া শাসনকালে জয় করেছিলেন মিশর, দখল করেছিলেন রোমের উপনিবেশ, আর তাঁর আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু বিশাল এক সাম্রাজ্য। দুর্ধর্ষ এই নারী এতোটাই পরাক্রমশালী ছিলেন যে, আর্মেনিয়া, আরব ও পারস্যের শাসকরাও তাঁর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছিলো। তিনি ছিলেন নির্ভীক, দুঃসাহসী এক যোদ্ধাসম্রাজ্ঞী। যার নেতৃত্ব তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো বিশ্বকে। কালের স্রোতে তিনি আজও নিজেকে অমর করে রেখেছেন।