জর্জ বার্নার্ড শ একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “শুধুমাত্র একজন সমাজবাদী নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও আমার উচিত পরিবেশের বিশাল শক্তি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করানো। মানুষের জীবনে পরিবর্তনই একমাত্র স্থিতিশীল বিষয়। পরিবেশের সাথে মানুষকে পরিবর্তিত হতেই হয়। কোনো রচনার কোনো মূল্যই নেই যদি না তা মানুষকে বিশৃঙ্খলা থেকে ঐশ্বরিক ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে।”
 
জর্জ বার্নার্ড শ ছিলেন একজন বিখ্যাত আইরিশ নাট্যকার এবং ‘লণ্ডন স্কুল এবং ইকোনমিক্স’-এর সহ প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমদিকে তিনি মূলত গান এবং সমালোচনামূলক রচনা করতেন, কিন্তু পরে তাঁকে আমরা ভিক্টোরিয়ান যুগের অন্যতম সেরা নাট্যকার হিসেবে দেখতে পাই। তিনি কিছু প্রবন্ধ সাহিত্য, উপন্যাস আর ছোট গল্পও লিখেছিলেন। তাঁর লেখনী মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যগুলোকে তুলে ধরতো হাস্যরসের মাধ্যমে। শোষিত শ্রমজীবী মানুষদের জীবন তাঁকে ভাবিয়ে তুলতো। সমাজে শান্তির বার্তা দিতে ১৮৮৪ খ্রীস্টাব্দে মধ্যবিত্তদের একটি সংগঠন তৈরি হয়, যা ‘ফ্যাবিয়ান সোসাইটি’ নামে পরিচিত ছিল। জর্জ এই সংগঠনের একজন প্রকৃত সমাজবিদ এবং সক্রিয় সদস্য ছিলেন। নারী-পুরুষের সমানাধিকার, শ্রমজীবী মানুষদের শোষণ, জমির প্রকৃত মালিকানা, মানুষের জীবন যাপনের রীতি – এগুলি তার লেখনীর মূল বক্তব্য ছিল।
 
১৮৫৬ সালের ২৬ শে জুলাই আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনের সিঞ্জ স্ট্রিটে জর্জ বার্নার্ড শ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা বার্নার্ড শ একজন সামান্য ব্যবসায়ী ছিলেন এবং মা লুসিণ্ডা এলিজাবেথ শ একজন গায়িকা ছিলেন। তাঁর দুই বোন, লুসিণ্ডা ফ্রান্সেস এবং এলিনর অ্যাগনেস। শ এর যখন ১৬ বছর বয়স তখন তাঁর মা তাঁর দুই বোনকে নিয়ে আলাদা থাকতেন এবং শ তাঁর বাবার সঙ্গেই থাকতেন। শ ডালকির একটা প্রাইভেট স্কুলে এবং তারপর ডাবলিন সেন্ট্রাল মডেল স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে স্কুলজীবন শেষ করেছিলেন ডাবলিন ইংলিশ সায়েন্টিফিক এন্ড কমার্শিয়াল ডে স্কুল থেকে। পরে তিনি তাঁর মায়ের সাথে থাকতে শুরু করেন। রাজশাহী তিনি লাইব্রেরীতে যেতেন এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যাতায়াত শুরু করেছিলেন, যেখানে তিনি পড়াশোনা করতেন এবং উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন। ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে শ বিয়ে করেন শার্লট টাউনশেডকে। তাঁরা লরেন্সের আয়ট সেন্ট এ থাকতেন যেটি এখন ‘শ’স কর্ণার’ নামে পরিচিত।
 
জীবনের শুরুর দিকে শ একজন সাহিত্য সমালোচক হিসেবে কাজ করেছিলেন ‘প্যল ম্যল গ্যাজেট’-এ। তিনি ‘কর্নো ডি ব্যাসেটো’ ছদ্মনামে লিখতেন। ১৮৯৫ – ১৮৯৮ সাল অবধি তিনি তার বন্ধু ফ্রাঙ্ক হারিসের পত্রিকা ‘স্যাটারডে রিভিউ’-তে নাট্য সমালোচক হিসেবে কাজ করতেন, যেখানে তিনি ভিক্টোরিয়ান যুগের কৃত্রিমতা এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে কটাক্ষ করতেন। এই পত্রিকায় তিনি হেনরিক ইবসেনের রচনা নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। ১৮৯১ সালে হেনরিক ইবসেনের কাজ সম্পর্কিত তার রচনা ‘কুইন্টেসেন্স অফ ইবসেনেজম’ সাহিত্যজগতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। এমনকি শেক্সপীয়ার সমালোচকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
সঙ্গীত সমালোচক হিসেবে জর্জ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। জার্মান সুরকার রিচার্ড ওয়াগনারের কাজ নিয়ে প্রশংসামূলক একটি প্রবন্ধও রচনা করেন, ‘দ্য পারফেক্ট ওয়াগনারাইট’। আরেক বিখ্যাত জার্মান সুরকার ব্রম্ভস্ এর কাজ নিয়েও সমালোচনা করেছিলেন। শ এর সঙ্গীত সমালোচনা সংগ্রহ কে ‘শ’স মিউজিক’ নামকরণ করা হয়।
 
পাঁচটি উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি যদিও সেগুলি তেমন সুখ্যাতি পায়নি। ১৮৮২ সালে লিখেছিলেন ‘ক্যাসেলস বায়রান’স প্রফেশন’, যা ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটির মুখ্য চরিত্র ক্যাসেলের জীবন কাহিনী নিয়ে লেখা হয় গল্পটা। ১৮৮৩ সালে লেখা তাঁর পরের উপন্যাস ‘অ্যান আনসোশ্যাল সোশালিস্ট’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে। তারপর আরো দুটি উপন্যাস ‘লাভ অ্যামাং দ্য আর্টিস্ট’ এবং ‘দ্য ইররশ্যানাল নট’ প্রকাশিত হয়। সবশেষে ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘ইমম্যাচুরিটি’ (১৮৭৯)।
 
ছোটগল্পের সংকলন ‘দ্য ব্ল্যাক গার্ল ইন সার্চ অফ গড এণ্ড সাম লেজার টেলস’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে। সংকলনের ‘দ্য ব্ল্যাক গার্ল’ একটি রূপক গল্প সঙ্গে বানিয়ানের ‘দ্য পিলগ্রিমস প্রসেস’ এর সাদৃশ্য রয়েছে। ‘দ্য মিরাকুলাস রিভেঞ্জ’ ঐ গল্প-সংকলনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা।
জর্জ বার্নার্ড শ সর্বাপেক্ষা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন একজন নাট্যকার হিসেবে। তাঁর নাটকগুলি বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসে ভরা। তাঁর নাটকগুলি সেই সময়ে লন্ডনের তুলনায় জার্মানি এবং আমেরিকার বিভিন্ন শহরে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যদিও পরবর্তীকালে লন্ডনের থিয়েটারে সেগুলি বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিল। এমনকি তাঁর লেখা কিছু নাটক এখনো মঞ্চস্থ করা হয় লন্ডনের থিয়েটারে; যেমন, ‘মিসেস ওয়ারেন’স প্রফেশন’, ‘আর্মস এন্ড দ্য ম্যান’, ‘ক্যানডিডা’, এবং ‘ইউ নেভার ক্যান টেল’ । ভিক্টোরিয়ান যুগের লন্ডনের মঞ্চ মূলত ভাবপ্রবণ মঞ্চের পরিচায়ক ছিল। কিন্তু শ লন্ডনের মঞ্চকে নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবপরিদর্শনের প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
 
শ এর খ্যাতি এবং অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে তার লেখনী, শৈলী এবং পটভূমিকা আরও স্পষ্ট ও সফল হতে থাকলো। ‘সিজার অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’, ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’, ‘মেজর বারবারা’, ‘দ্য ডক্টরস ডিলেমা’ প্রভৃতি নাটক তাঁর পরিণত ভাবনাকে তুলে ধরলো। ১৯০৪-১৯০৭ সালে তাঁর অনেক নাটক লন্ডনের কোর্ট থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল হার্লে বার্কার এবং জে. ই. ভেন্ড্রেনের সহযোগিতায়। তাঁর একটা নাটক ‘জন বুল’স আদার আইল্যান্ড'(১৯০৪) দেখে রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড হাসতে হাসতে চেয়ার ভেঙে ফেলেছিলেন, যা শ এর জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
 
১৯১০ সালের দিকে জর্জ বার্নার্ড শ একজন বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যকার হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ‘ফ্যানি’স ফার্সট প্লে’এবং ‘পিগম্যালিয়ন’ লন্ডন সিনেমা হলে দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। ‘পিগম্যালিয়ন’ নাটকটির জন্য তিনি ১৯৩৪ সালে অস্কার পেয়েছিলেন। শ’ই একমাত্র মানুষ যিনি সাহিত্যে নোবেল এবং অস্কার দুটিই পেয়েছিলেন। তিনি নোবেল পুরস্কার নিতে রাজি হননি কারণ তিনি সাম্মানিক পেতে চাইতেন না। পরে তাঁর স্ত্রীর অনুরোধে তিনি নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে রাজি হন। ‘পিগম্যালিয়ন’ নাটকটির মঞ্চস্থ রূপের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মাই ফেয়ার লেডি’। তাঁর অন্য বিখ্যাত নাটক ‘হার্টব্রেক হাউস’, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে রচিত। এছাড়াও অন্যান্য বিখ্যাত ও উল্লেখযোগ্য নাটক হল ‘ব্যাক টু মেথুসেলাহ্’, ‘সেন্ট জোন’, ‘দ্য অ্যাপেল কার্ট’, ‘টু ট্রু বি গুড’, ‘অন দ্য রকস্’ ইত্যাদি। তাঁর শেষ গুরুত্বপূর্ণ নাটক ‘গুড কিং চার্লস গোল্ডেন ড্যেস’।
 
লেখক হওয়ার পাশাপাশি শ একজন দক্ষ ফোটোগ্রাফার ছিলেন। ১৯৫০ সালে ৯৪ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়। ডি এস প্রিচেট লিখেছিলেন “শ ছিলেন শেষ ভিক্টোরিয়ান আদর্শবাদী।” শ এর বাড়িটি এখন ন্যাশনাল ট্রাস্ট প্রপার্টি। তাঁর নামানুসারে লন্ডনে ‘দ্য শ থিয়েটার’ স্থাপিত হয়। শ এর কথায়, “আমার গল্পের রসিকতা গুলোর মাধ্যমে আমি সমাজের সত্যতাকে তুলে ধরি। এটাই পৃথিবীর সবথেকে বড়ো তামাশা।”
লেখা – Sonalisa Bera
প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel