জোনাথন সুইফ্টের অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস ‘গালিভার্স ট্রাভেলস’। ড্যানিয়েল ডিফোর ‘রবিনসন ক্রুসো’ (১৭১৯) নামক অভিযান গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর অভিযানের গল্প বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তার কিছু বছর পরেই ১৭২৬ সালের ২৮শে অক্টোবর প্রকাশিত হয় ‘গালিভার্স ট্রাভেলস’। বই হিসেবে এটি প্রকাশ হওয়ার পরে কমিকস, এমনকি এই গল্পটি নিয়ে সিনেমাও হয়েছে, মুখ্য চরিত্রে দেখা গিয়েছে অভিনেতা জ্যাক ব্ল্যাককে।

জোনাথন সুইফট

‘গালিভার্স ট্রাভেলস’ গল্পে গালিভার একজন শিক্ষিত সমুদ্রপ্রেমী যুবক, যে তার ৪টে সমুদ্রযাত্রার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখে।

বুক ১ -এ সে লিলিপুটদের দেশে তার প্রথম সমুদ্রযাত্রা বর্ণনা করে। সুমাত্রার কাছে অজানা দ্বীপের কাছে জাহাজডুবি হয় এবং জেগে উঠে দেখতে পায় সে ৬ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষদের কাছে বন্দী। গালিভারের নড়াচড়ায় তারা ভয় পেয়ে যায় এবং তার চিৎকারে লিলিপুটেরা তীর, বর্শা নিক্ষেপ করতে থাকে। কিন্তু যখন সে চুপ করে যায়, তখন লিলিপুটরা শান্ত হয়। গালিভার তাদের বোঝাতে চায় সে খুব ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত এবং লিলিপুটরা তাকে জল ও মাংস খেতে দেয়। গালিভারের ভালো ব্যবহারে লিলিপুটদের রাজা খুশী হয়, গালিভার ব্লেফুসকুর মানুষদের সঙ্গে দেখা হয়, অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং বাড়ি ফিরে আসে।

বুক ২ -এ গালিভার তার জাহাজের সঙ্গীদের থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং এমন একটা দ্বীপে পৌঁছোয়, যেখানকার মানুষ তার থেকে আকারে ১২ গুণ বড়। তারা গালিভারকে পোষ্যর মতো ব্যবহার করে এবং এখানে লিলিপুটদের জায়গায় ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটে। গালিভার এখানে তাদের দয়ার পাত্র হয়ে যায়।

বুক ৩ -এ গালিভার জলদস্যুদের হাতে বন্দী হয় এবং একটা দ্বীপে এসে পড়ে। সে পৌঁছোয় এক উড়ন্ত দ্বীপে, সেখানকার মানুষেরা শুধু বিজ্ঞান আর অংক নিয়ে কথা বলে। তারা বালনিবারবি দ্বীপ শাসন করে। বালনিবারবি থেকে গালিভার যায় গ্লুবড্রুবড্রিব, যাদুকরদের দেশে। তারপর সে যায় লুগনাগে এবং সেখান থেকে যায় স্ট্রাল্ডবার্গসে।

বুক ৪ -এ গালিভার জাহাজের নাবিক হয় এবং বিদ্রোহের শিকার হয়। সে এসে পড়ে ভদ্র ঘোড়াদের দেশ, হুনইমদের জায়গায়। ইয়াহু, অদ্ভুত ধরণের মানুষদের সাথে দেখা হয়। উল্টোদিকে, হুনইমরা খুবই নিখুঁত, এবং গালিভারের তাদের জীবনযাপনের ধরণ বেশ পছন্দ হয়। তারা নীতিপরায়ণ ও দার্শনিক। অদ্ভুত লিলিপুট এবং ছন্নছাড়া ব্রবডিংনাগিয়ানদের থেকে অনেক ভালো এবং অন্যতম বুদ্ধিমান প্রাণী। ঐ দেশ থেকে বেরিয়ে গালিভার নিজের দেশে ফিরে এবং অনেকটা সময় নিজের পোষ্য ঘোড়াদের সাথে কথা বলে কাটায়।

‘Irony’ অর্থাৎ বিদ্রুপ এই গল্পের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘Irony’-র মাধ্যমে দু’ধরনের অর্থ বোঝানো হয়, আক্ষরিক অর্থ এবং গূঢ় অর্থ। সুইফ্ট নিজের গল্পে দুরকম ‘irony’ -র ব্যবহার করেছেন, কথার মাধ্যমে এবং পরিস্থিতির মাধ্যমে। গালিভারের বিদ্রুপ রূপকের মাধ্যমেও ফুটে উঠেছে। লিলিপুটদের দেশে গিয়ে তাদের রাজ্যের আয়তন এবং রাজকীয় শব্দের মাধ্যমে ভাষায় ব্যবহৃত irony ফুটে উঠেছে। লিলিপুটদের আয়তন ও উচ্চতা, তাদের অনৈতিকতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়, যখন তাদের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, ভণ্ডামি, ষড়যন্ত্রের প্রবণতা দেখা যায়। গালিভারের কাছে তারা পুতুলের মত, কিন্তু তাদের ব্যবহার মানুষের মতই অমানবিক। লিলিপুটদের দেশের গালিভারের অভিযান কাহিনী অনেকটাই সমসাময়িক ইংল্যাণ্ডকে উপস্থাপিত করে। উল্টোদিকে ব্রবডিংনাগিয়ানরা মহৎ ও উদার। শুধু আয়তনেই নয় তারা মানবিক দিক দিয়েও বড়ো ছিল। সুইফ্ট ব্রবডিংনাগের উৎকৃষ্টতা এবং গালিভারের অসামঞ্জস্যতাকে তুলে ধরেন। লিলিপুটরা তাকে দেখে তীর অস্ত্র ছুঁড়লেও, জায়েন্টরা তার যত্ন নিয়েছিল।

ল্যাপুটায় অভিযান আরও একটা ironic পটভূমি। এখানে মানুষ অদ্ভুতভাবে বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক কাজে ও গবেষণায় ব্যস্ত, যেমন- শশার মধ্যে থেকে সূর্যরশ্মির শোষণ। এই দূরদৃষ্টিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাদের বাস্তব জীবন আড়ষ্ট এবং অবহেলিত। হুনইমদের দেশে অভিযান গালিভারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। দেশটি হুনইম নামক ঘোড়াদের শাসনে চলে এবং তারা যথেষ্ট নীতিপরায়ণ, অন্যদিকে মানুষের মতো জীব ইয়াহুরা অসংলগ্ন এবং অনৈতিক। সুইফ্ট ব্যাঙ্গের মাধ্যমে গালিভার, ইয়াহু ও হুনইমদের বর্ণনা করেছেন। সমসাময়িক ইংল্যাণ্ডের রাজনীতি এবং প্রশাসনকে বিদ্রুপ করেছেন মানুষের মর্যাদা, শখ, দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ ও ভণ্ডামির মাধ্যমে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ‘গালিভার্স ট্রাভেলস’ বেশ প্রাসঙ্গিক একটি গল্প।

‘গালিভার্স ট্রাভেলস’ রাজা এবং নেতাদের অত্যাচারের উদাহরণ বহন করে। এই উদাহরণগুলো ১৬০০-১৭০০ খ্রীস্টাব্দের সময়ের ইংরেজ রাজত্বকে অনেকাংশে তুলে ধরে। ইংল্যাণ্ডের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক পার্টি হুইগ এবং টোরির সংঘর্ষ প্রকাশ পেয়েছে এই গল্পে। এই দুই দলের দুর্নীতি, সংঘর্ষ এবং লড়াই সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, তার কিছুটা ইঙ্গিত সুইফ্ট দিয়েছেন তাঁর এই গল্পে। সুইফ্টের সমসাময়িক বিজ্ঞানী যেমন স্যার আইজ্যাক নিউটনের কাজ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তাঁর গল্প সাজান। পঞ্চদশ শতাব্দীতে কিছু ইউরোপিয়ান অজানা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে সমুদ্র যাত্রা করেছিল এবং তাদের ভ্রমণকাহিনী বর্ণনাও করেছিল। সেই সব গল্পগুলো সব সময় পুরোটাই ঠিকঠাক ছিল না এবং কিছু বাড়তি কথা লেখা ছিল। সুইফ্ট গালিভারের মাধ্যমে তাঁর কল্পনাকে রূপ দেন, সেই সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর অভিযান কাহিনী লিখেছেন।

লেখা – Sonalisa Bera

প্রথম প্রকাশঃ প্যারালাল II Parallel