মধ্যযুগে বাংলায় স্বাধীন সুলতানী আমল এক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়। দিল্লির আনুগত্য ছেড়ে বাংলার স্বাধীন সুলতানেরা বংশপরম্পরায় শাসন করেছেন এই বঙ্গভূমিকে। প্রায় দুইশো বছরের স্বাধীনযুগের প্রায় পুরোটাই মুসলিম সুলতানদের শাসনাধীন ছিলো। মাঝখানের কিছুটা সময় রাজা দনুজমর্দনদেব গণেশ বাংলার সিংহাসন দখল করেন। মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হিসেবে বিবেচিত হবেন নিঃসন্দেহে। দারুন কৌশলে তিনি পরাক্রমশালী ইলিয়াস শাহী বংশের কাছ থেকে সিংহাসন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁরই পুত্র যদু তথা জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহকে নিয়েই আমাদের আজকের গল্প। এটা বেশ অবাক বিষয় যে, হিন্দু ধর্মের অনুসারী রাজা গণেশের পুত্র মুসলিম কিভাবে হলেন? এর পেছনে রয়েছে এক বিরাট গল্প। সুলতান জালালুদ্দিন তাঁর সময়ের একজন দক্ষ ও যোগ্য শাসক ছিলেন। বাংলার পার্শ্ববর্তী তদানিন্তন আরাকান রাজপুত্র নরমিখলাকে রাজ্য পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে তিনি যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন তা শুধু বাংলা নয় আরাকান রাজ্যের ইতিহাসেও অনন্য স্থান অধিকার করবে। আজকের অবতারণা রাজা গণেশের কীর্তিমান পুত্র সুলতান জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহকে নিয়ে।

১৯-শতকের একটি বাংলা কর্ম “রাজা গণেশ” এর প্রচ্ছদে রাজা গণেশের প্রতিকৃতি

মূলত ইলিয়াস শাহী বংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সময় থাকে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন রাজা গণেশ। বহিরাগত মুসলিমদের তাড়িয়ে সিংহাসন দখল করে করে পুনরায় বাংলাকে হিন্দু শাসনে ফিরিয়ে আনাই তাঁর অভিসন্ধি ছিলো। এর আগে হিন্দু জমিদারেরা বাংলার মুসলিম সুলতানদের অনুগত ছিলেন।এই সুলতানেরা মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন ফলে তাঁদের দরবারে যোগ্য হিন্দু ব্যাক্তিদের স্থানও দিতেন, এমনকি তাঁরা উজির পদেও ছিলেন। এমনি একজন সভাসদ ছিলেন রাজা গণেশ। দরবারের আমীর-ওমরাহদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে সিংহাসনে জাঁকিয়ে বসলেন রাজা গণেশ। এবার তাঁদের চৈতন্যদয় হলো। কিন্তু তখন আর কিছুই করার থাকলো না। গণেশ সিংহাসনে আসীন হয়েই মুসলমানদের উপর বিশেষকরে সুফী-দরবেশদের উপর দমন-পীড়ন চালান। এতে অতিষ্ঠ হয়ে তৎকালীন প্রভাবশালী আলেম ও দরবেশ হযরত নূর কুতব আলম নিরুপায় হয়ে জৌনপুরের মুসলিম সুলতান ইব্রাহিম শর্কিকে বাংলা আক্রমণ করে রাজা গণেশকে উৎখাত করার আমন্ত্রণ জানান। হযরতের চিঠি পেয়ে ইব্রাহিম শর্কি বিশাল বাহিনী নিয়ে বাংলা আক্রমন করেন। এতে রাজা গণেশ ভীত হয়ে পড়লেন। এবার তিনি দারুন এক কূটনৈতিক চাল চাললেন। তিনি হযরত নূর কুতুবের সাথে সমঝোতা করে ফেললেন।

ঠিক হলো, রাজা গণেশের জ্যেষ্ঠ পুত্র ১২ বছর বয়ষ্ক যদুকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে তাঁকে সিংহাসনে আসীন করা হবে এবং এই ধর্মান্তরকরণ নূর কুতুব নিজেই সরল বিশ্বাসে সমাধা করলেন। তিনি ইব্রাহিম শর্কিকে নিজ দেশে ফেরত যেতে অনুরোধ করলেন। এইভাবে যদু প্রায় দুই বছর রাজত্ব করলেন।কিন্তু ক্ষমতা মূলত থাকলো রাজা গণেশের হাতেই। ফলে মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার কমলো না। পরবর্তীতে তিনি যদুকে সড়িয়ে নিজেই সিংহাসনে আবারো আসীন হলেন এবং বিশাল আড়ম্বরে যদুকে প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠান করে পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফেরত আনলেন। যদুকে কারাবন্দী করেও রাখেন। এবারে প্রায় ১৪ মাস রাজত্ব করার পর রাজা গণেশ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে বেশিরভাগ ঐতিহাসিকগণ যদুকেই দায়ী করেন। তিনি কারাগার থেকে পলায়ন করে তাঁর বিশ্বস্ত আমীরদের সহায়তায় পিতাকে হত্যা করেন। এরপর সভাসদেরা রাজা গণেশের কনিষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রদেবকে সিংহাসনে বসায়। এর প্রায় মাস দুয়েক পর যদু আবার ইসলাম ধর্মে ফেরত আসেন এবং ছোট ভাইকে অপসারণ করে নিজেই জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ নামে সিংহাসনে আসীন হন।

সিংহাসন অধিকার করেই সুলতান জালালুদ্দিন রাজধানী পান্ডুয়া থেকে গৌড়ে সড়িয়ে ফেলেন। আগে রাজা গণেশ রাজধানী গৌড় থেকে পান্ডুয়ায় সড়িয়ে নিয়েছিলেন। যে সমস্ত হিন্দু পন্ডিত তাঁকে প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিয়েছিলেন তাদের শাস্তির ব্যাবস্থা করেন। এছাড়া তিনি হযরত নূর কুতুবের নাতিদেরকে সম্মানের সাথে রাজধানীতে আশ্রয় দেন। তিনি নিজে নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন। কিন্তু অন্য কোনও ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। তিনি হানাফী মাজহাব অনুসরণ করতেন।বহু মসজিদ ও মাদ্রাসা, যা তাঁর পিতার সময়ে ধ্বংস করা হয়েছিলো তা পুনর্নির্মান করেন। তিনিই প্রথম সুলতান যিনি মুদ্রায় কলেমা খোদাই করেন, এর আগে অন্য কোনো সুলতান কলেমা মূদ্রায় খোদাই করেন নি। তিনি অত্যান্ত যোগ্য শাসকও ছিলেন। তিনি চীনের সম্রাট ও মিশরের আব্বাসীয় খলিফার কাছেও দূত পাঠিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, পূর্ববর্তী খলিফাগণ মুসলিম জাহানের খলিফার প্রতি আনুগত্য পোষণ করতেন। কারণ খলিফার অনুমোদনক্রমেই সকল মুসলিম ভূখন্ডের শাসকেরা সুলতান বা বাদশাহ হিসেবে স্বীকৃত হতেন। তাঁরা নিজেদের মুদ্রা বা শিলালিপিতে খলিফার সহায়ক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতেন। কিন্তু জালালুদ্দিনই প্রথম নিজেকে খলিফাতুল্লাহ বা আল্লাহর খলিফা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন। ধারণা করা হয়, তিনি বিপুল উপঢৌকনসহ খলিফার কাছে দূত প্রেরণ করেন ও নিজের অনুমোদন প্রার্থনা করে এর পরই তিনি খলিফাতুল্লাহ উপাধী গ্রহণ করেন এবং এতে খলিফার অনুমোদন ছিলো। তাঁর পরে অন্যান্য সুলতাগণও এইরকম উপাধী গ্রহন করেছেন। এর মাধ্যেমে তিনি মুসলিম জাহানে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত হন। এছাড়া শক্তিশালী তৈমূরীয় সাম্রাজ্যের শাসক মির্জা শাহরুখের সাথেও মিত্রতা স্থাপন করেন। যার ফলশ্রুতিতে তাঁর আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইব্রাহিম শর্কির থেকেও নিরাপদ থাকেন।

তিনি পূর্ববর্তী সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের ন্যায় পবিত্র মক্কা নগরীতে বেশ কিছু ভবনসহ একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। এছাড়া মক্কাবাসীদের দান করার জন্যে বহু অর্থ পাঠিয়েছিলেন। তবে তিনি ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আরাকান রাজকে অনুগ্রহ করার কারণে। আরাকান তখন স্বাধীন রাজ্য ছিলো। সেসময়ের আরাকান রাজ্যের চন্দ্রবংশীয় রাজা নরমিখলা তাঁর অধীন জনৈক সামন্তের বিবাহিত বোনকে জোর করে নিজের অধিকারে নেন। ফলে, তাঁকে শিক্ষা দিতে সমস্ত সামন্তরা একত্রিত হয়ে প্রতিবেশী বার্মার রাজা মেং শোকে আরাকান আক্রমনের আমন্ত্রণ জানান। রাজা মেং শো প্রায় ত্রিশ হাজার সেনা নিয়ে আরাকান আক্রমন করেন। এতে প্রাণভয়ে ভীত হয়ে নরমিখলা রাজধানী লংগ্রেত ছেড়ে পালিয়ে বাংলা তথা গৌড়ে সুলতান জালালুদ্দিনের আশ্রয়ে আসেন। সুলতান জালালুদ্দিন নরমিখলাকে আশ্রয় দেন এবং তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি ওয়ালী খানকে প্রায় বিশ হাজার সেনা সহ নরমিখলার সহায়ক করে রাজ্য পুনরুদ্ধারে পাঠান। ওয়ালী খান বর্মীদের হটিয়ে দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেকেই আরাকানের সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। নরমিখলা আবার পালিয়ে সুলতান জালালুদ্দিনের কাছে যান। এবারে সুলতান তাঁর আরেক বিশ্বস্ত সেনাপতি সিন্ধী খানকে প্রায় ত্রিশ হাজার সেনাসহ পাঠান ওয়ালী খানকে সমুচিত শিক্ষা দিতে। সিন্ধী খান ওয়ালী খানকে দমন করেন এবং তাঁর সেনারাও পরে সিন্ধী খানের অনুগত হয়ে যায়। এভাবে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনা নরমিখলার অধীন করে দেয়া হয় যারা স্থায়ী ভাবে আরাকানে বসবাস করতে থাকে।এদের সাহায্যেই নরমিখলা সিংহাসন নিষ্কন্টক করেন। এভাবেই আরাকানে মুসলমানদের প্রবেশ ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে নরমিখলা নিজেও ইসলাম গ্রহন করেন এবং নাম নেন সোলায়মান শাহ। এভাবে তিনি ভিন্ন মুসলিম রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন যাঁদের রাজধানী ছিলো ম্রোহং। এই বংশের সবাই পরবর্তীতে যদিও ইসলাম ধর্মে ছিলেন না তারপরও সবাই মুসলিম উপাধী গ্রহন করতেন এবং মূদ্রায় ফারসী অক্ষরে মুসলিম উপাধী খোদাই করা থাকতো। সম্ভবত, সুলতান জালালুদ্দিনের এই মহানুভবতা একেবারে নিঃস্বার্থ ছিলো না। সম্ভবত আরাকানরাজের স্থায়ী আনুগত্য তিনি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী অঞ্চলের শাসনকর্তা হিসেবে সুলতান জালালুদ্দিন আরাকানরাজকে যে মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন এতে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব ও সামর্থ্য সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। তাঁর প্রেরিত এই পঞ্চাশ হাজার সেনারাই আজকের মায়ানমারের আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের অনেকেরই পূর্বপুরুষ। এছাড়া আরাকান রাজ্য স্বাধীনতা হারানোর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ সেই অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বাংলার শিল্প-সাহিত্যের একটা বড় প্রভাব সেখানে ছিলো। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য চর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিলো আরাকান রাজসভা। আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় দৌলতকাজী, মহাকবি আলাওল, আবদুল করীম খোন্দকার প্রমুখ কবিরা বাংলা সাহিত্যের একের পর সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। এসবকিছুরই আসলে প্রারম্ভ হয় সুলতান জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহের কারণে।

একলাখী সমাধিসৌধ, জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহের সমাধি সৌধ

অসাম্প্রদায়িক ও বিচক্ষণ এই সুলতান প্রায় ১৫ বছর অত্যান্ত দক্ষতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তিনি রাজনৈতিক যোগ্যতা ও দূরদর্শিতায় তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে পরিগণিত হবেন নিঃসন্দেহে। ১৪৩৩ সালের দিকে এই মহান শাসক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর সিংহাসনে বসেন তার বালক পুত্র শামসুদ্দিন আহমদ শাহ। রাজা গণেশ যেমন ইলিয়াস শাহী সুলতানদের কাছ থেকে ষড়যন্ত্র করে সিংহাসন দখল করেন তেমনি ইলিয়াস শাহী বংশের পক্ষের আমিরদের ষড়যন্ত্রে বালক সুলতান আহমদ শাহ কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন।কারন হয়ত তারা রাজা গণেশের বংশীয় সুলতানদের কাছ থেকে পুনরায় ইলিয়াস শাহী বংশের অধীনে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। হয়ত তাদেরই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে বালক সুলতান প্রাণ হারান। বাংলার সিংহাসন আবার চলে যায় ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের হাতে। এইভাবে রাজা গণেশের বংশের প্রায় ২১ বছরের শাসন শেষ হয়। রাজা গণেশ চেয়েছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করতে অথচ ভাগ্যের পরিহাসে তাঁর নিজ সন্তান অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম শাসক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন।