অনেকেই মনে করে, আঠারো শতকে মহীশূরের রাজা টিপু সুলতান ছিলেন সাংঘাতিক রকমের একজন ধর্মান্ধ অত্যাচারী শাসক। টিপুর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো, তিনি ছিলেন প্রচন্ড হিন্দুবিদ্বেষী। হাজার হাজার হিন্দুকে তিনি মেরে ফেলেছিলেন কারণ তারা ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে চায় নি। আরোও অভিযোগ যে, টিপু হিন্দুদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ফেলেছিলেন। তথ্যনির্ভরহীন টিপুর বিরুদ্ধে এ অভিযোগগুলো আসলে শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। বিশেষ করে গল্প-উপন্যাস-বক্তৃতায় এ নিয়ে ইতিহাসবিবর্জিত অনেক কিছুই দেখা যায়। এ অভিযোগগুলোর গভীরতা আমরা অনেকেই দেখতে পেয়েছিলাম কয়েক বছর আগে, এবং এখন দেখছি তা’ আরোও প্রকট ভাবে।

“The Sword of Tipu Sultan” টিভি সিরিয়াল

১৯১২ সালে ভারতের শ্রীরাঙ্গাপাটনায় টিপুর নামে সরকারীভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়। এটার বিরোধিতা করা হয় চরমভাবে। ২০১৪ সালে ভারতের সরকার যখন টিপুর জন্মদিন পালন করতে চেয়েছিল, তখন সমস্ত ভারতজুড়ে এর সমালোচনা শুরু হয় সাংঘাতিকভাবে। এটাই শেষ নয়। ১৯৯০ সালে টেলিভিশনে সঞ্জয় খানের “The Sword of Tipu Sultan” টিভি সিরিয়াল প্রচারিত হলে আবার এ নিয়ে চলে তুমুল বিতর্ক। পরে অবশ্য এ সিরিয়ালটির জন্য সঞ্জয় খান পেয়েছিলেন “Gem of India” পুরস্কার। বেশীদিন নয়, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকার ঘোষণা দেয় যে স্কুলের সব পাঠ্যপুস্তক থেকে টিপু সুলতানের নাম মুছে ফেলা হবে। এগুলো কি আসলেই টিপুর প্রাপ্য? দেখা যাক, টিপুকে নিয়ে ইতিহাস কি বলে!

শঙ্করাচার্য্যির খ্যাতিমান “শৃঙ্গেরী মঠ”

ইতিহাসও স্বীকার করে যে, টিপু কিছু কিছু হিন্দুদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তিনি উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিম্ন বর্ণের শূদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের প্রতি টিপুর ছিল অপরিসীম সহনাভুতি। অনেকেই জেনে অবাক হবেন যে, টিপুর সেনাবাহিনীর বেশীরভাগ সৈন্যই ছিলো নিম্ন বর্ণের শূদ্র। টিপু প্রতিবছর কমপক্ষে ১৫৬ মন্দিরে নিয়মিতভাবে সরকারী অনুদান দিতেন। শঙ্করাচার্য্যির খ্যাতিমান “শৃঙ্গেরী মঠ” যখন মারাঠাদের আক্রমণে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, টিপু তখন মঠের পবিত্র মূর্তি পুনঃস্থাপন এবং পুনরুদ্ধারের জন্য প্রচুর আর্থিক সহায়তার দেন। তবুও বলবেন যে টিপু ছিলেন প্রচন্ড হিন্দুবিদ্বেষী?

এছাড়াও টিপু হিন্দুদের অন্য অনেক মন্দিরে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। যেমন, নানজানগুডের বিখ্যাত শ্রীকান্তেশ্বর মন্দিরে তাঁর দান; কাঁচিতে মন্দিরের কাজ শেষ করতে দশ হাজার সোনার মুদ্রার অনুদান; মেলকোট মন্দিরে দুই সম্প্রদায়ের পুরোহিতের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি; কালালে লক্ষ্মীকান্ত মন্দিরে তাঁর উপহার উল্লেখ করার মতো। আরো শুনে অবাক হবেন, অগণিত মন্দিরের শহর শ্রীরাঙ্গাপাটনা তাঁর শাসনের পুরোটা সময়ই ছিল মহীশূর রাজ্যের রাজধানী। হিন্দুদের সার্বিক কল্যাণে টিপুর ভূমিকা দেখে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক বি. এ. সালেতোর টিপুকে “হিন্দু ধর্মের রক্ষাকারী” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু হিন্দুদেরই নয়, খ্রিষ্টানদের জন্যও টিপুর অবদান অসীম। মহীশূরে প্রথম গির্জা নির্মাণে টিপু সাহায্য করেছিলেন অনেকভাবে। শুধু কি তাই?

টিপু সুলতান হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা বিচারক নিয়োগ করেছিলেন। প্রতিটি প্রদেশে মুসলমানদের জন্য ছিল ‘কাজী’ এবং হিন্দুদের জন্য ছিল ‘পন্ডিত’। টিপু তার রাজসভায় অনেক হিন্দুকে উচ্চ পদে চাকুরী দিয়েছিলেন। যেমন, তাঁর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন কৃষ্ণ রাও, শামাইয়া আয়েঙ্গার ছিলেন ডাক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, এবং মুলচাঁদ ও সুজন রাই মুঘল দরবারে তাঁর প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন। টিপুর প্রধান “পেশকার” সুবা রাওও হিন্দু ছিলেন। এতো কিছু করার পরও টিপুকে হিন্দুবিদ্বেষী বলা মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করা, তাই নয় কি?

টিপু পুরো রাজ্যে মদ্যপান নিষিদ্ধ করেছিলেন ধর্মীয় ভিত্তিতে নয়, নৈতিক ও স্বাস্থ্যের কারণে। সামাজিক এক রীতি অনুযায়ী বালাঘাটের পুরো অঞ্চলে তখন বেশিরভাগ হিন্দু মহিলা তাদের বক্ষ এবং মাথা উন্মোচিত করে রাখতে বাধ্য থাকতো। টিপুর কাছে এটা ছিলো খুবই পাশবিক এবং অসভ্যতা। তিনি সমস্ত মহিলাকে তাদের বক্ষ এবং মাথা ঢেকে রাখার অনুমতি দিয়েছিলেন। তার মানে, এরপর থেকে তারা ইচ্ছে করলে তাদেরকে ঢেকে রাখতে পারতো। টিপু কেরালায় বহুবিবাহও নিষিদ্ধ করেছিলেন, যা আগে কখনো সম্ভব ছিল না। টিপুর এসব মহৎ কাজকে অস্বীকার করবেন কিভাবে?

টিপুকে কোনোভাবেই একতরফা ভাবে একজন অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ শাসক হিসাবে অপবাদ দেয়া যায় না। বাস্তবে তিনি ভারতের অনেক ধর্মীয় ঐতিহ্য সংরক্ষন করেছিলেন। টিপু ছিলেন অনেক সহনশীল। তিনি আন্তঃ-ধর্মীয় ঐতিহ্য, ধর্মনিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের সম্মিলন করেছিলেন তাঁর রাজ্যে । সুফিবাদে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাসের কারণে তিনি এটি করতে পেরেছিলেন। সবচেয়ে বড় সত্য হলো, টিপু সুলতান একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়েও হিন্দুপ্রধান এক বিশাল জনগোষ্ঠী শাসন করে গেছেন ষোলোটি বছর! তিনি শুধু শাসনই করেন নি, গড়ে তুলেছিলেন ধর্মীয় সহনশীল এক আধুনিক উন্নত রাষ্ট্র! গল্প-উপন্যাস-ব্লগে ভিত্তিহীন কাল্পনিক মসীচিত্র অংকন করে টিপুর অপরিসীম অবদানকে মুছে ফেলা যাবেনা। তা’ করতে হলে এর সমর্থনে প্রয়োজন ঐতিহাসিক প্রামানিক দলিল। কোথায় সে দলিল?

তথ্য সূত্র:
(1) M. Assadi, “Tipu Sultan: a secular internationalist, not a bigot,” The Hindu newspaper, 27-09-2015.
(2) Bansy Kalappa, “Tipu Sultan legacy may be erased from school textbooks,” The New Indian Express, 31-10-2019.
(3) Tipu Sultan Wikipedia.