শহীদ তিতুমীরের নাম শুনেনি এমন বাঙালী বোধহয় খুব কমই আছে। সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর ছিলেন একজন বাঙ্গালী, যিনি রাজাও ছিলেন না, তার কোনো জমিদারীও ছিল না; তিনি ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত সময়ের একজন সাহসী সংগ্রামী বীর। ২০০৪ সালের বিবিসি’র এক জরিপে দেখা যায় তিতুমীর হলেন ১১তম ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালী’। ১৭৮২ সালে বর্তমানের পশ্চিম বাংলায় তার জন্ম। তিতুমীর ১৮ বছর বয়সেই কোরআনের হাফেজ হন, এবং হাদিসের উপর পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি বিভিন্ন পেশায় জড়িত ছিলেন। কখনো তিনি ছিলেন কৃষক, কখনো একজন কুস্তিগীর, আবার কখনও জমিদারের লাঠিয়াল। নিজের পেশার চেয়ে জমিদারদের অত্যাচার এবং ইংরেজদের ভারত দখল তাকে বেশী করে ভাবিয়ে তোলে। এই ভাবনাই তাকে পরবর্তীকালে নিয়ে যায় সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে।

তিতুমীর সেই যৌবনকাল থেকেই কোন ভাবেই জমিদারদের অত্যাচার, ইংরেজদের ভারত দখল মেনে নিতে পারেন নি। সেই সময় জমিদারদের বেশ কয়েকটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন তিনি। যেমন, তৎকালীন কিছু জমিদার গরীব কৃষকের জমির উপর খাজনা আরোপ, মসজিদের উপর এবং দাড়ি রাখার জন্য কর ধার্য করেছিল। তাদের নিপীড়ণের বিরুদ্ধে তিতুমীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে অনেকবার অভিযোগ করেছিলেন, কিন্তু কোন ফল পান নি। জমিদারদের সীমাহীন অবিচার আর তিতুমীরের প্রতিবাদের কারণে তাদের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি বিরোধ দেখা দেয়। তিনি ভাবলেন, এই অত্যাচার বন্ধ করতে হলে এবং ইংরেজদেরকে ভারত থেকে তাড়াতে হলে সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। তিতুমীর কিছু বিশ্বস্ত লাঠিয়ালদের নিয়ে একটি নিজস্ব সশস্ত্র দল গড়ে তুলেন। অস্ত্র বলতে তাদের ছিল শুধুমাত্র বাঁশের লাঠি। এভাবেই তার মুক্তি সংগ্রামের সূচনা।

ধীরে ধীরে তিতুমীরের দলটি শক্তিশালী হয়ে উঠে। তিতুমীরের ক্রমবর্ধমান শক্তি খুব তাড়াতাড়িই ব্রিটিশদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। এমনকি জমিদাররাও তিতুমীরকে সাংঘাতিকভাবে ভয় পেতে লাগলো। কৃষকদের উপর নিপীড়নের জন্য গোবরডাঙার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তারাগনিয়ার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গৌরী প্রসাদ চৌধুরী এবং গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়ের সাথে তিতুমীরের চরম বিরোধ শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যেই গোবরডাঙার জমিদারের সহায়তায় মোলাহাটির ইংরেজ কুটিয়াল ডেভিস তিতুমীরের বিরুদ্ধে তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে। কিন্তু তিতুমীরকে শায়েস্তা করা তো দূরের কথা, ইংরেজরা তিতুমীরের বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
 
আরো কিছুদিনের মধ্যে তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে পনেরো হাজার হয়ে যায়। তিতুমীরের নেতৃত্বে তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বড় রকমের একটি সশস্ত্র সংঘাতের জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। প্রস্তুতিস্বরূপ ১৮৩১ সালের অক্টোবর মাসে তিতুমীর বারাসাত শহরের কাছে নারিকেল বাড়িয়ায় একটি বাঁশের দুর্গ তৈরি করেন। এই দুর্গটি এবং এ’র চারিদিকের দু’পাল্লার প্রাচীর ছিলো বাঁশ দিয়ে তৈরী। দুর্গটিকে শক্ত করার জন্য বাঁশগুলোর ভিতর শক্ত কাদা মাটি দিয়ে ভরাট করা ছিলো। বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হলেও দুর্গটি ছিলো অনেক মজবুত। এই দুর্গটি ‘তিতুমীরে বাঁশের কেল্লা’ নামেই বেশী পরিচিত।

তিতুমীর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, চব্বিশ পরগনা, নাদিয়া ও ফরিদপুর জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলটিকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনী এবং বৃটিশ সৈন্যরা বিভিন্ন জায়গায় তিতুমীরের গেরিলা কৌশলের কাছে বারবার পরাজিত হতে থাকলো। এতে ইংরেজরা তিতুমীরকে দমন করার জন্য আরো মরিয়া হয়ে উঠলো। অবশেষে, ১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর মাসে দুটি কামানসহ একশত অশ্বারোহী এবং তিনশত পদাতিক সৈন্য নিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের অনুসারীদের উপর আক্রমণ করে। বাঁশের লাঠি, কয়েকটি তলোয়ার এবং বর্শা নিয়ে সজ্জিত তিতুমীর ইংরেজদের আধুনিক অস্ত্রের আক্রমণকে বেশীদিন প্রতিহত করতে পারেন নি। বাঁশের কেল্লাটি ধ্বংস হয়ে যায় কামানের গোলার আঘাতে। তিতুমীর ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে এবং তার বেশ কয়েকজন অনুসারী যুদ্ধরত অবস্থায় ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর শহীদ হন। পরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার তিতুমীরের সাহসিকতার অনেক প্রশংসা করে। শুধু তাই নয়, ইংরেজ বাহিনী আরো স্বীকার করে যে, কেল্লাটিকে ধ্বংস করতে তাদেরকে দীর্ঘ সময় ধরে কামানের গোলা দিয়ে আঘাত করতে হয়েছিল। কেল্লাটির উন্নত মানের ডিজাইন এবং নির্মানশৈলী দেখে তারা খুবই আশ্চর্য হয়েছিল।

বাংলাদেশ কখনোই এই বীরকে ভুলে যায়নি। তিতুমীর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেকের কাছে মুক্তির এক অনুপ্রেরণা ছিল। খুলনায় ‘বি.এন.এস তিতুমীর’ নামে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি বিশাল ঘাঁটি রয়েছে। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকায় ‘জিন্নাহ কলেজে’র নাম পরিবর্তন করে ‘তিতুমীর সরকারী কলেজ’ রাখা হয়। ‘তিতুমীর হল’ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের নাম। ‘তিতুমীর এক্সপ্রেস’ নামে একটি আন্তঃনগর ট্রেন রাজশাহী এবং চিলাহাটির মধ্যে চলাচল করছে অনেক দিন থেকেই। ১৯৯২ সালের ১৯ নভেম্বরে বাংলাদেশ সরকার তিতুমীরের ১৬১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সম্মাননা স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করে।
তিতুমীরের ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ, দেশকে মুক্ত করার অদম্য বাসনা, জমিদারদের নিপীড়ন থেকে মুক্তির চেস্টা এখনো অনেককে অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়াবার অনুপ্রেরণা যোগায়।
তথ্য সূত্র:
1) “India’s Struggle for Freedom”. Department of Information & Cultural Affairs, Government of West Bengal, India, 2014.
2) Muazzam Hussain Khan, “Titu Mir”. Banglapedia. Bangladesh Asiatic Society.