খ্রিস্টীয় ১৬ শতক। ইরানের বিস্টোন বা বেহিশতুন শহরের কাছাকাছি প্রায় ১০৫ মিটার উচ্চতায় পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা এক অদ্ভূত শিলালিপি দেখতে পেলেন ইংরেজ কূটনীতিবিদ শেরলে রবার্ট। প্রথম দিকে মনে করা হয়েছিলো, শিলালিপিটি যীশুখ্রিস্ট ও তার ১২ জন শিষ্যের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু ভুল ভাঙলো, যখন তিন বছর কঠোর পরিশ্রমের পর ব্রিটিশ অফিসার রাউলিনসন হেনরি ১৯ শতকে এর পাঠোদ্ধার করলেন। রাউলিনসন হেনরির সেই পাঠোদ্ধার ইতিহাসে যোগ করলো এক আদিম বার্তার গল্প, যে বার্তার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা হয়েছিলো পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজার ক্ষমতা ও শক্তির দলিল। স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো, “আমি ডেরিয়াস, একজন মহান রাজা, রাজাদের রাজা, পারস্যের রাজা, প্রদেশগুলোর রাজা, হিস্টাসপিসের ছেলে, আরসামিসের নাতি, একজন আকিমেনিড”।

সমাধির সম্মুখভাগের উপরের বাম কোণে ডেরিয়াসের প্রথম শিলালিপি।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকিমেনিড সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হলেন দ্বিতীয় সাইরাস তথা সাইরাস দ্য গ্রেট। তার দাদা প্রথম সাইরাসের দাদা আকিমেনিসের নাম অনুসারেই মূলত আকিমেনিড বংশের নামকরণ করেন রাজাদের রাজা সাইরাস। আসলে আকিমেনিসের ছেলে টাইস্পিসের দুই ছেলের মাধ্যমেই আকিমেনিড বংশের দুটি মূল ধারার উৎপত্তি হয়। প্রথম সাইরাসের ছেলে ক্যাম্বাইসেসের ঘরে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় সাইরাসই সর্বপ্রথম বিশাল এই সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। আর টাইস্পিসের অপর ছেলে আরিয়ারামনেস থেকে শুরু হয় আকিমেনিড বংশের আরেকটি ধারা। তার ছেলে আরসামিস, আরসামিসের ছেলে হিস্টাসপিস এবং হিস্টাসপিসের ছেলেই হলেন বিশাল আকিমেনিড সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান সম্রাট প্রথম ডেরিয়াস বা ডেরিয়াস দ্য গ্রেট। অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করেন, ডেরিয়াস উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিজেকে আকিমেনিড বংশোদ্ভূত বলে জোর প্রচার চালিয়েছেন, যদিও এর সত্যতা সম্পর্কে জানা যায় নি।

ডেরিয়াস মূলত আকিমেনিড সাম্রাজ্যের তৃতীয় (মতান্তরে চতুর্থ) সম্রাট। খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ সালে সিংহাসনে বসেন তিনি। সাইরাস দ্য গ্রেটের সময়ে আকিমেনিড সাম্রাজ্য একটি বিশাল সীমানা লাভ করে সত্যি, কিন্তু এটি সর্বোচ্চ বিস্তার লাভ করে ডেরিয়াসের আমলে। ডেরিয়াসের সময়ে আকিমেনিড সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়াসহ উত্তরে বলকান দ্বীপ (রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন), পশ্চিমে লিবিয়া, মিশর এবং পূর্বে ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিলো। মেসোপটেমীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতা –মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সভ্যতা রূপ পেয়েছিলো ডেরিয়াসের সময়েই। সিংহাসনে বসে তিনি আর্মাইক ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন এবং নিজের নামে মুদ্রা চালু করেন। ডেরিয়াস পরিমাপের বেশ কিছু এককও নির্ধারণ করেছিলেন।

দারিয়াস আই

রাজ্য পরিচালনায় ডেরিয়াস সাইরাস দ্য গ্রেটের অনেক নীতি অনুসরণ করেছিলেন। বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনায় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কার জন্য সাইরাসের মতো ডেরিয়াসও প্রদেশভিত্তিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। প্রত্যেক প্রদেশের গভর্নরকে বলা হতো ‘সত্রপ’। সত্রপরা সম্রাটকে কর দিয়ে নিজ নিজ অঞ্চলের তত্ত্বাবধানে কাজ করে যেতেন। আর তাদের উপর নজর রাখার জন্য নিযুক্ত থাকতেন একজন কেন্দ্রীয় রাজকীয় সচিব, যাকে বলা হতো ‘সম্রাটের চোখ’। কেন্দ্রীয় রাজকীয় সচিব নিযুক্তকরণের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম গোয়েন্দা সেবা চালু করে আকিমেনিড সাম্রাজ্য। প্রত্যেক অঞ্চলের সত্রপরা কেন্দ্রীয় রাজকীয় সচিবের কাছে জবাবদিহিতার জন্য বাধ্য থাকতেন। সাইরাস দ্য গ্রেটের আমলে আকিমেনিড সাম্রাজ্য ২৬টি এবং ডেরিয়াস দ্য গ্রেটের সময় ৩৬টি প্রদেশে বিভক্ত হয়।

আকিমেনিড সাম্রাজ্যের উন্নয়নে ডেরিয়াসের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ যোদ্ধা এবং বিচক্ষণ শাসক। পুরো পৃথিবীর ৪০ ভাগ জনগোষ্ঠীকে নিজের সাম্রাজ্যের অধীনে শাসন করে গেছেন তিনি সফলভাবে। সুয়েজ খালের প্রাচীন রূপ ‘ডেরিয়াস ক্যানাল’ লোহিত সাগর ও ভারত সাগরের সাথে মেডিটেরিনিয়ান সাগরকে যুক্ত করেছিলো। বসফরাস প্রণালীতে প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় সেতু নির্মাণ করেন ডেরিয়াস, যেটি এশিয়া ও ইউরোপকে সংযুক্ত করে। ২৫০০ মাইল দীর্ঘ প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্যপথ ‘রয়্যাল রোড’ গড়ে উঠেছিলো ডেরিয়াসের হাত ধরেই। এই রয়্যাল রোডই পরবর্তীকালের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ ‘সিল্ক রুট’ এর প্রধান সংযোগ।

ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরিয়ার সার্ভিস প্রণয়ন করেন ডেরিয়াস দ্য গ্রেট। গ্রীক পন্ডিত হেরেডোটাসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, পারস্যের কুরিয়ার সার্ভিসের গতি সকল দ্রুততাকে হার মানাতো। মহাসাগরীয় অনুসন্ধানের চিন্তা ডেরিয়াসের মনেই প্রথমবার উদয় হয়, যা তাকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলো। সাইরাস দ্য গ্রেটের মতো ডেরিয়াসের আমলেও দাস প্রথাকে প্রশ্রয় দেয়া হয় নি, প্রত্যেক কর্মীকে দেয়া হতো উপযুক্ত পারিশ্রমিক। ডেরিয়াসের সময়ে প্রণীত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক মুদ্রা।

ডেরিয়াসের আমলের মুদ্রা

সে সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অঞ্চল ভারতবর্ষ ডেরিয়াসের প্রচেষ্টায় আকিমেনিড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো। তিনি নিজ সাম্রাজ্যসীমার বাইরের অঞ্চলগুলো নিয়ে সবসময় ভাবতেন। কিছুটা কৌতুহল, কিছুটা জয়ের নেশা থেকেই গ্রীক লেখক স্কাইলাক্সকে তিনি পাঠিয়েছিলেন সিন্ধু নদের অপর পাশের এলাকা অনুসন্ধানে। স্কাইলাক্সের দেয়া তথ্যই ভারতবর্ষের প্রতি আকর্ষিত করেছিলো ডেরিয়াসকে, যার ফলাফল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্তি। প্রাচীন ইতিহাসের নজিরবিহীন ‘প্যাক্স পার্সিকা’ বা ‘পার্সিয়ান শান্তি’ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে ব্যবিলন, মিশর, আয়োনিয়া ও গ্রীসসহ অনেকগুলো বিদ্রোহ সফলভাবে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন ডেরিয়াস। বিশ্বের প্রথম ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠা করেন বিচক্ষণ ডেরিয়াস দ্য গ্রেট।

ডেরিয়াস সত্রপদের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্য যেমন সুশৃঙ্খল পদ্ধতি প্রণয়ন করেছিলেন, তা বর্তমানের শাসকদের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয়। তার আমলে অসাম্প্রদায়িকতাও ছিলো অবাক করবার মতো। দ্বিতীয় চার্চ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ডেরিয়াসের ভূমিকা রয়েছে। আকিমেনিড সাম্রাজ্যে ‘বাগান’ নিয়ে তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। এটা সবাই জানে যে, পার্সিয়ানদের কাছে বাগান শুধুমাত্র সৌন্দর্য বর্ধনের বিষয় নয়, বরং এটি তাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ার। বাগান তৈরীর মাধ্যমে আকিমেনিড শাসকরা তাদের সৃষ্টি করার ক্ষমতাকে দেখাতে চান, জীবিত প্রাণীদের নিরাপদ আবাসস্থল এই বাগান গড়ে তোলার মাধ্যমে তারা পৃথিবীর মধ্যে স্বর্গ খুঁজে পেতেন। তাই বাগানকে বলা হতো ‘প্যারাডাইসিয়া’।

ডেরিয়াসর সেনাবাহিনী

ডেরিয়াস দ্য গ্রেটের আমলে আকিমেনিড সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা। সে সময় নারী কর্মীকে পুরুষ কর্মীর সমান পারিশ্রমিক দেয়া হতো এবং গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের জন্য ছিলো পারিশ্রমিকসহ মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা। সেই প্রাচীন সময়ে এমন দূরদর্শিতা সত্যিই অবাক করার মতো ব্যাপার। তা ছাড়াও মাল্টিকালচারালিজম তো সাইরাসের সময় থেকেই চলে আসছে আকিমেনিড সাম্রাজ্যে।

ডেরিয়াসের কীর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময় জাগানিয়া হচ্ছে চোখ ধাঁধানো পার্সেপোলিস নগরী, যেটি আলেকজান্ডারের হাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের প্রাচীন এই শহরই ছিলো সূর্যের নিচে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবার এতো বছর পরেও পার্সেপোলিসের ধ্বংসাবশেষ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া যায় না। ধ্বংস হবার আগে কতোটা জাঁকজমক ছিলো এখানে তা তো কেবল কল্পনার অতীত। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয় চমৎকার শহর ও প্রাসাদ ডেরিয়াস গড়ে তুলেছিলেন পার্সেপোলিসে। সিংহাসনে বসার পর আকিমেনিড সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী তিনি পার্সেপোলিসেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো পার্সেপোলিসকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ এর মর্যাদা দিয়েছিলো।

পার্সেপোলিসে দারিয়াসের প্রাসাদ

‘পার্সেপোলিস’ একটি গ্রীক শব্দ, যার অর্থ ‘পারস্যের শহর’। পারস্যের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিলো পার্সেপোলিস। আকিমেনিড সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী প্যাসারগাদেই থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই শহরের প্রবেশপথ থেকে শুরু করে প্রতিটি স্থাপনাই ছিলো কল্পনাতীত সুন্দর। পার্সেপোলিসে ডেরিয়াসের প্রাসাদের অক্ষত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত ১০০টি কলাম থেকে বিশেষজ্ঞরা একটি কাল্পনিক প্রতিকৃতি তৈরী করেছেন, যেটি নিঃসন্দেহে কোনো বিস্ময় থেকে কম কিছু নয়। প্রাসাদের প্রায় ৬৬ ফুট উঁচু ছাদটিও ছিলো মানুষের হাতে তৈরী, অথচ কি চমৎকার কাজ!

ডেরিয়াসের প্রতিটি কাজে তার প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। রাজ্যে শান্তি স্থাপনে তিনি ছিলেন ভীষণ মনোযোগী। আবার একই সাথে কঠোর হতেও কার্পণ্য করতেন না, যার প্রমাণ ‘বেহিশতুন শিলালিপি’। রাউলিনসন হেনরির পাঠোদ্ধার করা এই শিলালিপিটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ সিল্ক রুটের প্রধান সংযোগ রয়্যাল রোডের একটি স্থানে ভূমি থেকে ১০৫ মিটার উচ্চতায় পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে তৈরী করা হয়েছে এবং তৈরীর পর নিচের অংশটা ভেঙে দেয়া হয়েছে যেনো কেউ কোনোদিন সেই উচ্চতায় পৌঁছতে না পারে। শিলালিপি তৈরীর ধরন দেখে মনে হয়, রাজা জনসাধারণের মনে তার কঠোরতার দৃষ্টান্ত দেখানোর জন্যই এটি তৈরী করেছিলেন। প্রাচীন পার্সিক, ইলামাইট ও আক্কাদিয়ান বা ব্যবিলনিয়ান –এই তিন ভাষায় লেখা শিলালিপিটিতে সম্রাট ডেরিয়াস স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে গেছেন তার পরিচয় এবং সাইরাস দ্য গ্রেটের সাথে তার বংশগত সংযোগের কথা। সেই সাথে লিখে গেছেন, তার বিরুদ্ধাচারী ও অন্যায়কারীদেরকে তিনি কঠোর শাস্তি দিয়ে থাকেন, আর এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য স্বয়ং আহুরা মাজদা তাকে পাঠিয়েছেন। আহুরা মাজদা হলো জরাথ্রুস্টবাদীদের ঈশ্বর। আসলে প্রাচীন সময়ে দেবতা বা ঈশ্বরের নাম ব্যবহার করে নিজের প্রচারণা চালানো ছিলো শাসকদের অবলম্বন করা একটি রাজনৈতিক কৌশল, যার মাধ্যমে জনমনে সহজেই ভয় ও ভক্তি তৈরী করা যেতো। বিরুদ্ধাচারীদের শাস্তি প্রদানের একটি নমুনা শিলালিপির খোদাই চিত্র থেকেই স্পষ্ট করেছেন ডেরিয়াস। চিত্রটি থেকে দেখা যায়, উপরে আহুরা মাজদা সম্রাট ডেরিয়াসকে আশীর্বাদ করছেন, ডেরিয়াসের পায়ের নিচে পদদলিত তার সিংহাসন আত্মসাৎ এর প্রচেষ্টাকারী এবং সম্মুখে পেছনের দিকে হাত বাঁধা অবস্থায় দাঁড়ানো আরো অনেক অপরাধী। গ্রীক বর্ণনাগুলো থেকে জানা যায়, পার্সিয়ান শাসকেরা শাস্তিস্বরূপ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বিশেষ করে নাক কেটে নিতো।

শাহনামার যুদ্ধের দৃশ্যের সাথে মিলে যায় নাকশে রুস্তমের খাদাইচিত্রগুলো; Source: ancient-origins.net

ডেরিয়াস দ্য গ্রেটের করা আরেকটি চোখ ধাঁধানো কীর্তি হচ্ছে তার নিজের সমাধি, যেটি তিনি তার মৃত্যুর সাত বছর আগে তৈরী করেছিলেন পার্সেপোলিস নগরী থেকে কিছুটা দূরে একটি পাহাড়ের চূড়ায়। তার সমাধির নিচের অংশে খোদাই করা হয়েছে শিলালিপি, যা দেখে তার সমাধিটি আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায়। ডেরিয়াস দ্য গ্রেটসহ তার তিন বংশধর- জারজেস, আর্তাজারজেস ও দ্বিতীয় ডেরিয়াস এবং তাদের পরিবারের সমাধিও আছে এখানে। পরবর্তীকালে রচিত ইরানি কবি ফেরদৌসীর কাব্যগ্রন্থ ‘শাহনামা’ এর সাথে ডেরিয়াসের সমাধির খোদাইচিত্রগুলো ভীষণভাবে মিলে যায়। তাই ‘শাহনামা’ এর পাঠকরা এটিকে প্রথম দিকে শাহনামা যুদ্ধের বীর রুস্তমের কাহিনী ভেবে ভুল করলো। আর সেই থেকেই এই সমাধির নামকরণ হলো ‘নাকশে রুস্তম’ বা ‘রুস্তমের চিত্র’। সমাধির প্রবেশমুখগুলো ক্রুশ আকৃতির।

নাকশে রুস্তম; Source: ancient-origins.net

ডেরিয়াস দ্য গ্রেটের বিশাল ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর ইতিহাস নজিরবিহীন। গ্রীক পন্ডিত হেরেডোটাসের বর্ণনা থেকে ডেরিয়াসের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর কথা জানা যায়। বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সর্বোচ্চ যোগ্যতার আসনে অধিষ্ঠিত সুঠাম দেহের অধিকারী সৈন্যদের বেছে বেছে এই সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করতেন ডেরিয়াস। তিনি নিজের আত্মবিশ্বাস ও সেনাবাহিনীর শক্তির জোরেই এতো এতো রাজ্য জয় করে বিশাল আকিমেনিড সাম্রাজ্য গড়তে সক্ষম হয়েছেন। গ্রীকদের বিরুদ্ধে প্রথমবার ডেরিয়াসই যুদ্ধ করেছিলেন, যদিও তাতে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি।

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে ডেরিয়াসের নাম আনতেই হবে। প্রাচীন খোদাইচিত্রগুলো, নাকশে রুস্তম, বেহিশতুন, পার্সেপোলিস –সবাই যেনো প্রতিনিয়ত চিৎকার করে জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে; সর্বোচ্চ যোগ্যতার সাথে আকিমেনিডকে আঁকড়ে ধরবার এবং পূর্ণ জীবনবোধ দিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখবার মতো একজনই জন্মেছিলেন হাজার হাজার বছর আগে। তিনি মহান আকিমেনিড শাসক ডেরিয়াস দ্য গ্রেট।

রেফারেন্সঃ

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

হিন্দু দেব-দেবীর ধারণা প্রাচীন মধ্য এশীয় বিশ্বাসেরই প্রতিরূপ নয় তো?

সিংহবাহনের ওপর এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য নিয়ে চার হাতবিশিষ্ট এক দেবী যুদ্ধবাজ ভঙ্গিমায় আসীন নিজের সন্তানদের প্রতিরক্ষার জন্য। খুব পরিচিত লাগছে তাই না? নিশ্চয়ই দেবী দুর্গার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এ তো দুর্গা নয়, ব্যাক্ট্রিয়ান মাতৃদেবী ‘নানায়াহ’ বা ‘ননা’...

মহাবীর কর্ণের অন্তিম যাত্রা

সূর্যদেব অস্তে চলে যাচ্ছেন। গোধূলিবেলার লালচে আলোতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার এই জন্মের শত্রুকে। তার গান্ডিব ধরা উদ্ধত হাতে চকচক করছে অঞ্জলিক বাণ, যা আমার মস্তক ছেদ করার জন্য একটু পরেই ছুটে আসবে।পান্ডব বীর অর্জুন, যে আমার চরম শত্রু আবার আমার সহদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।ওই...

মীরাবাঈ, লেডি ম্যাকবেথ, বিনোদিনীর রুপে মঞ্চ মাতিয়ে রাখা তিনকড়ি দাসী

ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বড়লোক বাবুর রক্ষিতা হতে হয়েছিল তাকে। আর সেই রক্ষিতার পুরস্কার হিসেবেই পেয়েছিলেন তিন তিনটে বাড়ি। তিনটি বাড়ির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তা নিজের করে ধরে রাখার কোন ইচ্ছে ছিল না তার। বাড়ি তিনটির একটি তার রক্ষক বাবুর ছেলেকে এবং বাকি দুটো মৃত্যুর আগে...

নারীকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সৃষ্টির শুরুর ইতিহাসের সাথে পরবর্তী ইতিহাসের সংঘাত

প্রত্যেক সময়ের প্রেক্ষাপটেই দেখতে পাওয়া যায়, নারীর ওপর সমাজ কতোগুলো বিধি-নিষেধ আরোপ করে থাকে। তাদের চলা-ফেরা, বাক-স্বাধীনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সমস্ত কিছুর উপর প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে সমাজ। তবে এতো বাধা-বিপত্তির পরও প্রতিটি যুগে অসংখ্য নারী...

তিন সম্রাটের শাসনের প্রত্যক্ষদর্শী মুঘল রাজকন্যা গুলবদন বানু বেগম

“ইতিহাসের বই দিয়ে ব্যক্তিত্ব বিচার করলে এটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, পুরুষরাই ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক চরিত্র ছিলেন। অন্তত মনে রাখার মতো কোনো চরিত্র যদি থেকে থাকে, তবে পুরুষরাই সবার সামনে চলে আসেন। অবশ্যই এটি একটি অসত্য বিষয়। কিন্তু আমরা এই অসত্য বিষয়টিকেই...

আমার চোখে ‘বড় আপা’, অগ্রণী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ড. কাজী আনোয়ারা মনসুর

ছেলেবেলা থেকে আমার গড়ে উঠবার প্রতিটি ধাপে আমার অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করবার ক্ষেত্রে, আমার অনুধাবন ও উপলব্ধিকে গঠনমূলক রূপ প্রদানের ক্ষেত্রে এবং আমার স্বশিক্ষাকে পরিপূর্ণ করবার ক্ষেত্রে বেশ ক’জন ব্যক্তির অবদান রয়েছে। এই তালিকায় অবশ্যই আমার মা, বাবা, খালাসহ পরিবারের...

বিস্মৃতপ্রায় অযোধ্যার রাজমাতা: মালিকা কিশোয়ার

লখনৌ এর বিশাল রাজবাড়ি। অন্দরমহল থেকে ছুটে আসছেন অযোধ্যার রাজমাতা। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট; পা খালি, জুতো ছাড়াই ছুটে আসছেন তিনি; গা থেকে খুলে পড়ে যাচ্ছে চাদর। রাজমাতার এমন অবস্থা দেখে পেছন পেছন ছুটছেন দাসীরা। কি হলো রাজমাতার! নিজের কামরা থেকে কদাচিৎ বের...