ঢাকার নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে মতভেদ আছে। কথিত আছে যে, সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকার জঙ্গলে দেবী দূর্গার একটি বিগ্রহ খুঁজে পান। দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তিনি সেই এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।যেহেতু দেবীর বিগ্রহ ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো,তাই তিনি মন্দিরটির নাম রাখেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে জায়গাটির নাম ঢাকা হিসাবে পরিচিত হয়। আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে,মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ঢাকাকে সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসাবে ঘোষনা করেন,তখন সুবেদার ইসলাম খান শহরে ‘ঢাক’ বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্তির রূপ নেয় এবং সেটা থেকেই শহরের নাম হয় ঢাকা। মুঘল সাম্রাজ্যের বেশ কিছু সময় সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন স্বরূপ ঢাকা জাহাঙ্গীরনগর নামে পরিচিত ছিলো।

পুরান ঢাকা

মুঘল শাসনামলের আগের ঢাকা কেমন ছিলো?

মুঘল শাসনামলের আগে ঢাকা শহরটি এখনকার মতো সমতল ছিলো না, জায়গায় জায়গায় নালা,ডোবা,ঝিলের ছড়াছড়ি ছিলো। এইসব জায়গায় বর্ষার পানি কমে এলে মশা- মাছি, পোকা- মাকড়ের যন্ত্রনায় তিষ্ঠানো দায় হয়ে পড়তো। এছাড়া বর্ষার পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াতো, ফলে কলেরা, বসন্ত, ডায়রিয়া মহামারী আকারে দেখা দিতো। তখন যানবাহন ব্যাবস্থা উন্নত না থাকায়, আমদানি রপ্তানিযোগ্য মালপত্র একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া ছিলো দুরহ ব্যাপার।

যানবাহন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ইসলাম খাঁ বুড়িগঙ্গা থেকে একটি কৃত্রিম খাল খনন করান। খালটি বাবুবাজার থেকে আরম্ভ করে জিন্দবাহারের উত্তর দিক হয়ে তাঁতী বাজারের পাশ দিয়ে গোয়াল নগর, নবাবপুর ও নারিন্দা রোডের সামনে দিয়ে জালুয়ান নগর ঘুরে শরাফত গঞ্জ হয়ে লোহার পুলের নিচ দিয়ে পুনরায় বুড়িগঙ্গায় মিলিত হয়। অন্য খালটি শহরের মাঝখান তাঁতী বাজার ও মালিটোলার সংযোগ স্থলের কাছ থেকে বংশাল রোড অতিক্রম করে সুরিটোলার পশ্চিম দিক হয়ে নাজিরা বাজার ও দেওয়ান বাজারের মধ্য দিয়ে নিমতলী হয়ে শাহবাগ ও রমনাগ্রীন বা বাগ- ই- বাদশাহী হয়ে সেগুন বাগিচা, পুরানো পল্টন ও মতিঝিল পার হয়ে চলে গিয়েছিলো।

ঢাকার পুরানো হিন্দু মন্দির

এদেশ যেহেতু নদী মাতৃক কাজেই নৌকাই ছিলো মাল আনা- নেওয়ার প্রধান বাহন। তাই খাল দুটি খনন করার ফলে শহরবাসী যেমন উপকৃত হয়েছিলো,তেমনি শহরের ময়লা পানি নিষ্কাশনের ব্যাপারেও যথেষ্ট সহায়তা হয়েছিলো। প্রথম খালটি দোলাই খাল নামে পরিচিত, এই খালটি খননের ফলে শহরটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো।বাবুবাজার থেকে যে খালটি নবাবপুর অতিক্রম করে নারিন্দা ও শরাফতগঞ্জ হয়ে লোহার পুলের নিচ দিয়ে বয়ে গিয়ে মিলব্যারাকের কাছে বুড়িগঙ্গায় মিলিত হয়, তার বেষ্টনী সীমার মধ্যবর্তী অঞ্চলটিকে তৎকালীন শিল্প এলাকাও বলা যেতে পারে।

১৮৬৪ সালে ঢাকা নগরবাসীর সাংগঠনিক কার্যাবলীর গোঁড়াপত্তন হয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিবর্তন হয় ১৮৮২ সালে। ঐ বছর পৌরসভার অধীনে আরও সাতটি মহল্লাকে আনা হয়। এগুলির মধ্যে—রায়ের বাজার, কালু নগর, জাফরাবাদ ও বিবির মাজার এলাকাগুলির অবস্থান ছিলো শহরের পশ্চিম ও দক্ষিণ- পশ্চিম প্রান্তে। পিলখানাকে পৌর এলাকাভুক্ত করা হলেও পরে তা বাদ দেয়া হয়। ১৮৯৫ সালে রায় সাহেব দীননাথ সেন ও বাবু রজনীকুমার চৌধুরীর উদ্যোগে শহরের উপকণ্ঠ এলাকা গেন্ডারিয়ার বনজঙ্গল পরিস্কার করা হলে শহরের বহু অভিজাত নাগরিক সেখানে বসতি স্থাপন করেন। ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে আসাম ও পূর্ববঙ্গের রাজধানী হয় ঢাকা। রাজধানী হওয়ার সাথে সাথে ঢাকার পৌর এলাকার অনেক পরিবর্তণ করা হয়। এই পরিবর্তণে ৬.১৫ বর্গমাইল এলাকা ঢাকা পৌর এলাকার অধীনে চলে আসে।

ঢাকা নিউ মার্কেট

পাকিস্তান আমলে ঢাকা আবার প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পায়। এই সময় পৌরসভার মর্যাদাও বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। বৃহত্তর ঢাকা শহর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চতুর্দিকে তার সীমা পরিসীমা বাড়াবার ব্যাপক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৫১-৫২ সালের দিকে নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন লেন, শান্তিনগর, শাহজাহানপুর প্রভৃতি এলাকাকে ঢাকা পৌরসভার আওতায় আনা হয়।অবশ্য শহরের আয়তন বাড়লেও পৌরসভার আয় তেমন বাড়েনি। ফলে অনুন্নত এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। পৌর আয় এতো কম ছিলো যে নতুন নতুন এলাকার পয়ঃপ্রণালী, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও বিজলী বাতি সম্প্রসারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।কমিশনাররা অক্লান্ত প্রচেষ্টা করে সরকারী সাহায্যে এসব নির্মাণের ব্যাবস্থা করেছিলেন।এইসব এলাকার উন্নয়ন সম্ভব হলে ঢাকা পৌর এলাকার পরিধি আরও বাড়াবার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ কিছু এলাকা ঢাকা পৌরসভার অধীনে আনা হয়। এতে করে ঢাকা শহরের পরিধি অনেকটা বাড়ে।

১৯৬১ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর ৪২ টি এলাকা নিয়ে বৃহত্তর ঢাকা পৌরসভা সম্পর্কে এক সরকারী প্রেসনোট প্রকাশিত হয়। সেই সময় বৃহত্তর এলাকার পরিধি দাঁড়ায় ১৪.২০ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা হয় ৩.৩৬ লাখের মতো। বর্তমানে ঢাকা নগরীর পরিধি আরও বেড়েছে এবং এর আয়তন উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।

আজকের ঢাকা শহর একটি বৃহত্তর নগরী।উঁচু উঁচু ইমারত,রাস্তার দু’ধারের আলোয় শহরটা ঝলমল করে। রাজপথে আধুনিক গাড়ি,উড়াল সেতু,মেট্রো রেল,নতুন নতুন বিপনী বিতানগুলিতে পণ্যসম্ভার উপচে পড়ছে।স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ায় এখানে স্থাপিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মিশন অফিস।ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পৃথিবীটাকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। ঢাকা পৌরসভা রূপান্তরিত হয়েছে ঢাকা পৌর কর্পোরেশনে। জনশুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী এখানে ১ কোটি ২ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস। ঢাকার জাতীয় দর্শনীয় জায়গাগুলি—জাতীয় সংসদ ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘর,মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর,লালবাগের কেল্লা,আহসান মঞ্জিল,হাতির ঝিল,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,জাতীয় স্মৃতিসৌধ,কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার,বায়তুল মোকাররম মসজিদ,তারা মসজিদ, ঢাকেশ্বরী মন্দির,আর্মেনীয় গীর্জা ইত্যাদি দর্শনীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

নতুন ঢাকা

বর্তমান ঢাকা – বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল মেগাসিটিগুলোর একটি।

তথ্যসূত্র
গ্রন্থ— কিংবদন্তির ঢাকা, লেখক— নাজির হোসেন।
উইকিপিডিয়া
ছবি— গুগুল