বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে বেকুয়া উপত্যকা হয়ে সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হলেন একজন মিশরীয় ফারাও, উদ্দেশ্য কাদেশ বিজয়। বিশাল সেই যাত্রায় পদে পদে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন তার সেনাদল। খাদ্যাভাব, পানির অভাব ইত্যাদি সমস্ত সমস্যা মোকাবেলা করতে করতেই একের পর এক শহর পদানত করতে লাগলেন ফারাও। এমন সময় শত্রুপক্ষ হিট্টাইটদের দুই জন সেনা এসে জানালেন, হিট্টাইট রাজা মুওয়াতাল্লিশ ফারাও এর আসার কথা শুনে পালিয়ে গেছেন। ফারাও নিজের গরিমা নিয়ে ভীষণ গৌরবান্বিত, এক মুহূর্তের জন্যও তাদের কথা অবিশ্বাস করলেন না তিনি। পরম আত্মবিশ্বাসের সাথে মাত্র পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি দল নিয়ে উত্তর দিকে দ্রুত অগ্রসর হলেন কাদেশ বিজয়ের জন্য। পেছন পেছন আসতে লাগলো বাকি সেনাবাহিনী। ওদিকে হিট্টাইট রাজা মুওয়াতাল্লিশ প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ফাঁদ পেতে বসেছিলেন এবং তার পরিকল্পনা মতে, ফারাও ইতিমধ্যেই সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন। পথে বিশ্রাম নেবার জন্য ফারাও যখন তার সৈন্যদের নিয়ে ক্যাম্প করলেন, ঠিক তখন বনের চারিধারে ওঁত পেতে থাকা মুওয়াতাল্লিশের আড়াই হাজার চ্যারিয়ট অতর্কিতে হামলে পড়লো ফারাও এর পিছিয়ে পড়া সেনাবাহিনীর ওপর। হঠাৎ এমন আক্রমণের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো ফারাও এর সেনাবাহিনী। তবুও হাল ছাড়লেন না অসম সাহসী ফারাও।
একাই বীরের মতো যুদ্ধও করতে লাগলেন, আবার সেনাদের অন্তরে সাহসও যোগাতে লাগলেন। ফারাও এর অর্ধেক সৈন্য মারা পড়লো হিট্টাইটদের হাতে। তবে হিট্টাইট সেনারা সংখ্যায় বেশি হলেও ফারাও এর সেনাবাহিনী ছিলো অধিক শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। দ্রুতই সেনাবাহিনীর মনোবল ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেন ফারাও, বীরত্ব দিয়ে যুদ্ধ করে বাঁচালেন নিজের সৈন্যদেরকে। সেই যুদ্ধে ফারাও জিততে না পারলেও হেরেও কিন্তু যান নি, সাময়িক সন্ধির মাধ্যমে অবশিষ্ট সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে গিয়েছেন মিশরে। কাদেশের এই যুদ্ধই মহত্ত্ব এনে দিয়েছিলো ফারাওকে। এ যুদ্ধের পরই তার নামের সঙ্গে ‘মহান’ কথাটি যুক্ত হয়েছে। এই ফারাও আর কেউ নন, স্বয়ং দ্বিতীয় রামেসিস বা রামেসিস দ্য গ্রেট।
ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস প্রথম সেটির দ্বিতীয় ছেলে। পঁচিশ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করলেও কিশোর বয়স থেকেই তিনি বাবার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। বাবার সাথে সিরিয়া অভিযানেও সঙ্গী হয়েছিলেন তিনি। ছোট থেকেই ‘ক্রাউন প্রিন্স’ হিসেবে বেড়ে ওঠা রামেসিস ছিলেন ভীষণ যুদ্ধবাজ।
ফারাও হবার পর বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করেন দ্বিতীয় রামেসিস। তিনি সব সময় নিজের গরিমা প্রচারে সচেষ্ট থাকতেন। আবিদোসে ‘টেম্পল অফ সেটি’-র নির্মাণ কাজ শেষ হবার পরও সেখানে তিনি নিজের নাম খোদাই করেছেন। সেই সাথে ‘টেম্পল অফ সেটি’-র পেছনে নিজের নামেও একটি মন্দির নির্মাণ করেন তিনি।
দ্বিতীয় রামেসিস আবু সিম্বেলে এমন এক মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, যা আগে কখনো কেউ করেন নি। আগের মন্দিরগুলো তৈরী হতো ইটের ব্লক ব্যবহার করে। দ্বিতীয় রামেসিসই প্রথম পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে মন্দির নির্মাণ করলেন। মন্দিরের প্রবেশপথে নির্মিত হলো ফারাও রামেসিসের ৬৭ ফুট উঁচু চারটি বিশাল মূর্তি। জনমানবহীন এই এলাকায় দক্ষিণ মিশরের নুবিয়ান জনগোষ্ঠীর মনে ফারাও এর প্রতাপ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই এই বিশাল মন্দির তৈরী করেছিলেন রামেসিস। এই মন্দিরটির পাশেই প্রিয়তমা স্ত্রী নেফারতারির জন্য তিনি আরেকটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। নেফারতারির মন্দিরটির নির্মাণকাজ শেষ হবার এক বছরের মধ্যেই নেফারতারি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
আবিদোস আর আবু সিম্বেলের পর রামেসিয়ামে আরেকটি মন্দির তৈরী করেছিলেন দ্বিতীয় রামেসিস, যেখানে পরবর্তী একশো বছর তার পূজা প্রচলিত ছিলো। এই মন্দিরটি মূলত শবাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
আগেই বলেছি, ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস ছিলেন ভীষণ সামরিকপ্রবণ। যুদ্ধ-বিগ্রহ তাকে ভীষণভাবে টানতো। বহু বার হিট্টাইটদের পক্ষ থেকে সন্ধির প্রস্তাব আসলেও রামেসিস তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এতো যুদ্ধবাজ একজন রাজাও কিন্তু একটা সময় শান্তির পথ বেছে নিয়েছিলেন। দীর্ঘমেয়াদী কাদেশের যুদ্ধ থেকে অব্যাহতির জন্য শেষ পর্যন্ত চিরশত্রু হিট্টাইটদের সাথে সন্ধি করতেও সম্মত হয়েছিলেন তিনি।
তার অনেকগুলো স্ত্রীর মধ্যে প্রধান ছিলেন নেফারতারি। নেফারতারিকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, যার প্রমাণ নেফারতারির মন্দিরগুলো দেখলেই পাওয়া যায়। নেফারতারি মারা যাবার পর ইস্টনোফ্রেট হয়েছিলেন রামেসিসের প্রধান স্ত্রী। আসলে নেফারতারি এবং ইস্টনোফ্রেট দুজনকেই তিনি ফারাও হবার অনেক আগে প্রায় পনেরো-ষোলো বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। তাই এদের দুজনের প্রতিই রামেসিসের মমত্ববোধ একটু বেশি ছিলো। ইস্টনোফ্রেটও রামেসিসের রাজত্বের চৌত্রিশ বছর পর মারা যান। এর পর তিনি নিজের আরও তিনি মেয়েকে এবং একজন বোনকেও বিয়ে করেছিলেন। এরপরই সংঘটিত কাদেশ শান্তিচুক্তি রক্ষার্থে হিট্টাইট রাজকন্যা মাথর্নফিউরিকে বিয়ে করেন দ্বিতীয় রামেসিস। এই বিয়ের যৌতুক নিয়ে রামেসিস এবং হিট্টাইট রাণী পুদুহেপার মাঝে এক চমৎকার দর কষাকষি হয়েছিলো। মাথর্নফিউরি মারা যাবার পর চুক্তির শর্ত রক্ষার্থে আরও একজন হিট্টাইট রাজকন্যাকে বিয়ে করতে হয়েছিলো তার।
দ্বিতীয় রামেসিসের অসংখ্য স্ত্রী তো ছিলেনই, তা ছাড়াও হারেমের বিভিন্ন নারীর সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিলো। ফারাও হবার আগেই বিভিন্ন নারীর গর্ভে তার প্রায় ১০-১৫ জন সন্তান হয়েছিলো। তার মোট সন্তানের সংখ্যা হিসেব করলে তা ১০০ এর কাছাকাছি যেতে পারে।
ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস প্রায় ৯০ বছর বেঁচেছিলেন এবং প্রায় ৬৭ বছর তিনি মিশর শাসন করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তার চোখের সামনেই তার বহু স্ত্রী ও সন্তানেরা মারা গেছেন। নেফারতারি মারা যাবার সময় তিনি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন। তার বড় ছেলে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে বেড়ে উঠলেও ফারাও হবার সুযোগ তার মেলে নি। চোখের সামনে আরও অনেক প্রিয় সন্তানদের মৃতদেহ দেখতে হয়েছিলো ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসকে। হয়তো আপনজনদের এতোসব মৃত্যুই তার মনকে নরম করে দিয়েছিলো। শেষ সময়ে এসে তিনি যুদ্ধবিমুখ হয়েছিলেন। সন্ধির মাধ্যমে শান্তি রক্ষার্থে হয়েছিলেন বদ্ধপরিকর।
ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস একমাত্র মৃত ব্যক্তি, যাকে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট তৈরী করা হয়েছিলো। প্যারিস এথনোলজিক্যাল মিউজিয়ামে তার মমির দেহে প্রায় ৮৯ প্রজাতির ফাঙ্গাল সংক্রমণ ধরা পড়ে, যা গামা রশ্মি ব্যবহার করে ধ্বংস করা হয়। আজও মিশরের কায়রো জাদুঘরে মমি হয়ে প্রদর্শিত হয়ে আছেন ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস।
রেফারেন্স:
- ‘মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত’ –এস এম নিয়াজ মাওলা