আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে কত যে স্থাপত্যশৈলী তার ইয়ত্তা নেই। সঠিক পরিচালনা ও যত্নের অভাবে এর অনেকগুলোই আজ ধ্বংসের পথে। তেমনি একটি প্রাচীন স্থাপনার কথা আজ আপনাদের কাছে তুলে ধরব।

টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার চৌধুরী বাড়ি। প্রায় ৫৪ একর জমির উপর শৈল্পিক কারুকার্যমণ্ডিত নাগরপুর চৌধুরীবাড়ী প্রতিষ্ঠা করেন যদুনাথ চৌধুরী। কথিত আছে কলকাতার আদলে নাগরপুরকে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি। এখান থেকেই তিনি জমিদারি পরিচালনা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দী । ইতিহাস থেকে যতদুর জানা যায় – সুবিদ্ধা-খাঁ-র সূত্র ধরেই চৌধুরী বংশ নাগরপুরে জমিদারী শুরু করেন। চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষ যদুনাথ চৌধুরী। প্রায় ৫৪ একর জমির উপর জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের বংশক্রমে দেখা যায় – তাঁর তিন ছেলেঃ উপেন্দ্র মোহন চৌধুরী, জগদীন্দ্র মোহন চৌধুরী ও শশাঙ্ক মোহন চৌধুরী ।বৃটিশ সরকার উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর বড় ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরীকে সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্যে বিভিন্ন সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘রায় বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করে।

উপেন্দ্র সরোবরের প্রবেশদ্বার

সতীশ চন্দ্র রায়ের ১০-১২ বছরের ছেলে অসুস্থ হল। নিজ এলাকায় কোন হাসপাতাল নেই। দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসক এনে ছেলের চিকিৎসা করাতে লাগলেন। তবুও ছেলে কিছুতেই ভালো হয়ে ওঠে না ।অবশেষে কলকাতা থেকে স্বনামধন্য ডাক্তার নিয়ে এলেন। কলকাতার ডাক্তার জানালেন – সবই ঠিক ছিলো তবে বড় দেরি হয়ে গেছে। বাঁচাতে পারলেন না প্রাণ প্রিয় সন্তানকে। সন্তান হারানোর পর নিজ এলাকার মানুষের অসহায়ত্ব অনুধাবন করতে পারলেন। অসুস্থ হলে কোথায় যাবে এরা? সেজন্য জনগণের কল্যাণে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি দাতব্য চিকিৎসালয় যার নাম ছিল ‘পুন্ডরীকাক্ষ দাতব্য চিকিৎসালয়’। বর্তমানে এটি নাগরপুর সরকারি হাসপাতাল এ পরিণত হয়েছে।
হাসপাতালের রোগীদের জন্য আমিষের সুব্যবস্থা এবং পানির অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে হাসপাতালে অদূরেই ১১ একর জায়গার উপর ‘উপেন্দ্র সরোবর’ নামে একটি বিশাল দীঘি খনন করেছিলেন। দিঘিটিতে একটি বড় ঘাট সহ মোট ১৩ টি শান বাঁধানো ঘাট ছিল। সম্পূর্ণ দিঘীরপাড় চারপাশে পায়ে হেঁটে ঘুরে আসতে কমপক্ষে ৩০ মিনিট সময় লাগে। অযত্ন আর অবহেলায় বর্তমানে দিঘিটি কচুরিপানায় ভরে রয়েছে। অনেকগুলো ঘাট ভেঙে গেছে।

সরোবরের পাশে শিব মন্দির

সতীশ চন্দ্র রায় যদুনাথ চৌধুরীর নামে প্রতিষ্ঠা করেন যদুনাথ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। সময়ের আবর্তনে এটি আজ কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। চৌধুরীবাড়ীর দালানগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল – গুরুত্বপূর্ণ দালানগুলোর সামনে একটি করে শান বাঁধানো ঘাট যুক্ত পুকুর রয়েছে। ছোট ছেলে সুরেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন অপেক্ষাকৃত পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ঘেঁষা। তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে সৌখিন প্রকৃতির মানুষ।তিনি ছিলেন খুব ক্রীড়ামোদী। উপ-মহাদেশের বিখ্যাত ফুটবল দল ইষ্ট বেঙ্গল ক্লাবের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী। পাশ্চাত্য এবং মোঘল সংস্কৃতির মিশ্রনে এক অপূর্ব নান্দনিক সৌন্দর্যে নির্মিত চৌধুরী বাড়ির বৈঠকখানা বিল্ডিং এর উপরে ছিল নহবতখানা।সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রতিদিন ভোর সকালে সানাই-এর ভৈরবী ধ্বনীতে চৌধুরী বংশের তথা এলাকার প্রজাবৃন্দের ঘুম ভাঙ্গত। শোনা যায়, রায় বাহাদুরের ছোট ভাই সুরেশ চৌধুরীকে নাগরপুরে রেখে সম্পূর্ণ রাজধানী কলকাতার আদলে নাগরপুরকে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। চৌধুরী বাড়ীর রঙ্গমহলের পাশে এক সুদৃশ্য চিড়িয়াখানা ছিল। সেখানে শোভা পেত- ময়ূর, কাকাতোয়া, হরিণ, ময়না আর শেষ দিকে সৌখিন সুরেশ চৌধুরীর ইচ্ছায় চিড়িয়াখানায় স্থান করে নিয়েছিল বাঘ (কেতকী) এবং সিংহ(দ্যুতি)। ১৯৪৭ এর দেশ বিভক্তির পর একসময় তদানিন্তন সরকার চৌধুরী বাড়ীর সকল সম্পদ অধিগ্রহণ করে।

নাগরপুর চৌধুরীবাড়ী

অট্টালিকাটির অভ্যন্তরের পুরো কাজটি সুদৃশ্য শ্বেত পাথরে গড়া। বর্তমানে চৌধুরী বাড়ীর এই মুল ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাগরপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজ। চৌধূরীবাড়ীর অন্যান্য স্থাপনার একটি – ঝুলন দালান । প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন শিল্প কর্মে মন্ডিত চৌধুরী বংশের নিত্যদিনের পূজা অনুষ্ঠান হত এই ঝুলন দালানে। বিশেষ করে বছরে শ্রাবনের জ্যোৎস্না তিথিতে সেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের নাটক, যাত্রা মঞ্চায়িত হত। এখানেই চৌধুরী বংশের শেষ প্রতিনিধি মিলন দেবী (মিলন কর্ত্রী) স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চৌধুরীদের উপাসনা বিগ্রহ ‘‘বৃন্দাবন বিগ্রহ’’ -এর নিরাপত্তা দিতে গিয়ে দুষ্কৃতকারীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। এছাড়া ছিল ঘোড়ার দালান।ঘোড়ার দালানে জমিদারী পরিচালনা এবং বাবসায়িক প্রয়োজনে সুঠাম, সুদৃশ্য ঘোড়া পোষা হত। আর এই ঘোড়া এবং তার তদারকীতে নিয়োজিতদের থাকার জন্য নির্মাণ করা হয় শৈল্পিক কারুকাজ খচিত এই স্থাপনা। যা জমিদারদের ঘোড়ার দালান হিসাবে পরিচিত। এই ঘোড়ার দালানের পাশেই রয়েছে নাগরপুর শহীদ শামসুল হক উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে চৌধুরীবাড়ীর দালানগুলোর সৌন্দর্য খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল।
সম্প্রতি চৌধুরী বাড়ি ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমার দেখা দালানকোঠাগুলোর বেশিরভাগই এখন ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। কিছু বেদখল হয়ে আছে, কিছু সরকারি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে । সঠিক পরিচর্যা ,পরিচালনা ও সংস্কারের অভাবে ঐতিহাসিক একটি দর্শনীয় স্থান নাগরপুর চৌধুরীবাড়ী আজ তার সমস্ত জৌলুস হারাতে বসেছে।

পুরনো হাসপাতালের দালান। এখন এটি তালা বন্ধ থাকে।