‌পি.এইচ.ডি. করতে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন জার্মানি | যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পি.এইচ.ডি. করতেন সেই সময়ে আইনস্টাইন ছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একবার সেই শহরে এক কৌতুক প্রতিযোগিতার আয়োজন হল – স্থানীয় জার্মান ভাষায় | আর সেই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান পেলেন এক বাঙালি | ভাবা যায় !

তিনি আর কেউ নন , বাংলা সাহিত্যের রসিক লেখক ‘সৈয়দ মুজতবা আলী’।

১৭ টি ভাষা ছিল তাঁর দখলে | ১৭ টি ভাষাতেই তিনি কথা থেকে শুরু করে লিখতে পর্যন্ত পারতেন | “গীতা” সম্পূর্ণ মুখস্থ | কবিগুরুর “গীতবিতান” শেষ থেকে শুরু সম্পূর্ণ মুখস্থ | একবার এক অনুষ্ঠানে এক পুরোহিত সংস্কৃত ভাষায় গীতা সম্বন্ধে বক্তব্য রাখছিলেন | উনি ধরে ফেললেন কিছু জায়গায় ভুল বলেছেন ওই পুরোহিত | দাঁড়িয়ে সমস্ত বক্তব্য মূল সংস্কৃত ভাষায় কী হবে তা মুখস্থ বলে গেলেন | উপস্থিত দর্শকেরা তো হতবাক !

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় “বংগীয় শব্দকোষ” রচনা করেছিলেন | সেই হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যাবার পূর্বে বলেছিল, “আমার অভিধান যদি কোনো সময় সংশোধন করার প্রয়োজন হয় তাহলে যেন সৈয়দ মুজতবা আলী সেটা করে।” এর মাধ্যমেই বোঝা যায় সৈয়দ মুজতবা আলীর বাংলা ভাষায় কত গভীর দখল ছিল |
একবার এক রাষ্ট্রদূত তাঁর সাথে সাক্ষাত করে আলাপ করলেন। পরে সেই রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, “আমি জীবনে এত অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর এত বিষয়ে আলাপ শুনি নাই, যেটা উনি আমাকে শুনিয়েছিলেন অল্প কয়েক ঘন্টার মধ্যে।”

পুরীর মন্দিরে গেছেন মুজতবা। সাধ জগন্নাথ দর্শন করবেন। পুরুত জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি বাবা? উত্তর দিলেন- সৈয়দ মুজতবা আলী। উত্তর এলো- বিধর্মীর প্রবেশ নিষেধ। মনে মনে মুজতবা বললেন, জগন্নাথ যদি সত্যিই ভগবান হন, তাহলে তাঁর কাছে পুরুতও যা, আমিও তাই। তিনি সমুদ্র তীরে গিয়ে মাথা মুন্ডন করে তাতে টিকি রাখলেন। পৈতে ধারণ করলেন। গেরুয়া পরলেন। কপালে তিলক কাটলেন। হাতে কমন্ডুল ও পায়ে খড়ম। মুজতবার গভীর সংস্কৃত জ্ঞান ও স্পষ্ট সংস্কৃত উচ্চারণ। গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী টিকলো নাকের মুজতবা ঘন্টা দুয়েক বাদে, ঐ পোষাকে যখন সংস্কৃত শ্লোক আওড়াতে আওড়াতে পুরীর মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন, পুরুতরা ভাবলে, হিমালয় থেকে নিশ্চয়ই কোন মহাসাধক এসেছেন। তারা প্রায় পাঁজকোলা করে মুজতবাকে জগন্নাথের সামনে নিয়ে গেল। মুজতবা লিখেছেন, “আমার গায়ে চিমটি কেটে পুরুতরা যদি বুঝতে পারতো, আমি বামুন, কায়েত না মোচলমান, তাহলে বুঝতুম জাত-পাত- ধর্মের একটা মানে আছে। অদৃশ্য এই বস্তুটি নিয়ে আমাদের কত হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি।”

আদ্যন্ত ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ ছিলেন তিনি | জাত ধর্ম নয় | মনুষ্যত্বের শিক্ষাই ছিল তাঁর আদর্শ | এজন্য কটাক্ষের শিকার হতেন প্রায়ই | অনেকেই বলত,‘মুজতবা আলীর ধর্ম নিরপেক্ষ উদার দৃষ্টিভঙ্গি একটা আইওয়াশ, আসলে আলী একজন ধুরন্ধর পাকিস্তানি এজেন্ট।’ আক্ষেপ করে তিনি লেখক শংকরকে বলেছিলেন, “এক একটা লোক থাকে যে সব জায়গায় ছন্দপতন ঘটায়, আমি বোধহয় সেই রকম লোক।” রসবোধ ছিল খুব বেশি | মৃত্যুর আগে অবধিও তা বজায় ছিল | বলেছিলেন,”আমার মৃত্যুর পর সবাইকে বলবে আলী সাহেব তার বেস্ট বইটা লেখার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু কী করবেন, উনার তো প্যারালাইসিস হয়ে ডান হাতটা অবশ হয়ে গেল। হাতটা ভালো থাকলে তিনি দেখিয়ে দিতেন সৈয়দ মুজতবা আলীর বেস্ট বই কাকে বলে।”

তাঁর লেখা পড়লে অনুধাবন করা যায় তাঁর লেখনীর গভীরতা, তাঁর জীবনতৃষ্ণার প্রতি ভালবাসা। সৈয়দ মুজতবা আলী-র মত সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে বিরল |

(তথ্য ঋণ- ইন্টারনেট)