আবু ইসহাকের জনপ্রিয় উপন্যাসের মধ্যে ‘সূর্য-দীঘল বাড়ি’র সাথে আমাদের পরিচিতির মাত্রায় তিব্রতা-তিক্ষণ্নতা থাকলেও উনার আরেকটি উপন্যাস  অতটা জনপ্রিয় না হলেও, ঘটনায় ভারিত্বের সমাবেশ না থাকলেও যে নেহাতই শিল্পগুণে পিছিয়ে আছে, তা নিজে বলবার বা অন্যকে দিয়ে বলাবার সুযোগ নেই। সহজ-সরল চরিত্রের চরিত্রায়ন, সমাজ ব্যবস্থার নতুনের দিকে বিবর্তনের তোড়জোড়, চরবাসীদের প্রত্যহ ভাঙ্গা-গড়ার সাথে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, চর দখলের নেশায় খুনখারাবি করে জেল-জরিমানায় শরিক হওয়া, নিম্মতম অবস্থান থেকে আর্থিক প্রতিপত্তির জোরে জাতে উঠার অসম প্রতিযোগিতা, দফাদার-চৌকিদার-জমিদার-মহাজনদের সীমাহীন দৌড়াত্ম্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চাল নিয়ে বিট্টিশ সরকারের চালবাজি, নৌকাশুমারি, স্বদেশি আন্দোলন তথা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ক্ষাণিক উপস্থিতি ইত্যাদী ঘটনায়-দুর্ঘটনায় পরিপূর্ণ ২২৫ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস। সহজ ভাবে বর্ণনা আর সরলপ্রাণ চরিত্রগুলোর উপস্থিতি এতটা আবেদন তৈরি না করতে পারলেও অন্তত সেটা পড়ে শেষ করে ফেলার স্পৃহা জাগায়।

এই উপন্যাসের মূল কাহিনি যা-ই হোক না কেন প্রকৃত বিচারে চরিত্রের সার্থকতা খোঁজা টাই আসল কাজ হবে। নদীকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থায় বিশেষ করে যারা নদীভাঙ্গনে সর্বস্বান্ত হয়েছে, নিজ ভিটে-মাটি থেকে উৎখাত হয়েছে কেবল তাদের মনোবেদনা কেমন, তাদের জীবন-চরিত্র পরবর্তীতে কোন দিকে মোড় নেয়, হাসি-কান্নার সমাবেশ বা বিচ্ছেদের সুর তথা চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে হিসেবে-নিকেশ করতে যাওয়া ইত্যাদী হয়ত আমরা যারা আসুলি(প্রকৃত মালিক/নিজ ভূমিতে যারা বসবাস করে) তাদের কাছে নেহাতই কল্পনার আশ্রয়ে লেখকের গালগল্প বলে মনে হতে পারে বা তা নাও হতে পারে তবে আবহমানকাল ধরে চলে আসা এইসব ঘটনার উত্থান-পতনের যে অভাব নেই তা মানতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

উপন্যাসের নায়ক ফজল। ছোটবেলায় তার বিয়ে দিয়ে ঘরে নতুন বউ আনল তার বাবা এরফান মাতব্বর। অথচ বেশকিছু দিন পর ঘরের বউ সেই লক্ষ্মীকে তাড়িয়ে দিল শুধুমাত্র ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। যদিও আমাদের নায়ক ফজল প্রথমে খুব রেগে-টেগে অনেকদিনের জন্য প্রথম স্ত্রী বিয়োগে নির্বাসিত জীবন যাপনে মনস্থির করে, এমনকি বাড়ি থেকে পালিয়েও গিয়েছিল। অবশ্য কিছুদিন পর আবার ফিরে আসে। তারও বছরকয়েক পরে,আরেকজনকে ছেলের বউ বানিয়ে আনল এরফান মাতব্বর। যাইহোক, উপন্যাসের নায়কোচিত চরিত্র হিসেবে প্রথমে ফজলকে নির্দেশ করতে কষ্টকর হলেও ঘটনার ক্রমান্বয়ে বিস্তার আস্তে আস্তে সে সন্দেহ দূর করে। চরদখলে নেতৃত্ব দেওয়া, জঙ্গুরুল্লাহ’র মিথ্যা ডাকাতি মামলায় আসামী হয়ে জেল খাটা, স্বদেশি আন্দোলনকারীদের সংস্পর্শে এসে দেশাত্মপ্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করার আকাঙ্ক্ষায় জেল ভেঙ্গে পালানো, চর বেদখলের ঘৃণায় আচ্ছন্ন হয়ে জঙ্গুরুল্লাহকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার তীব্র বাসনায়, প্রথম স্ত্রী জরিনার প্রতি ভালবাসার আকুলতা বা দ্বিতীয় স্ত্রী রুপজানের চিন্তায় ব্যাকুলতা প্রকাশ করা এবং পরে তারই নেতৃত্বে বউ রুপজানকে রাতের আধারে ডাকাতি করা  ইত্যাদী নানা ঘটনায় জড়িত ফজল নামক চরিত্রটি। তবে ঔপন্যাসিক ফজল চরিত্রকে আরেকটু ফুটিয়ে তোলার ইচ্ছে প্রথমে প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে তা থেকে পিছিয়ে এসেছেন। সামাজিক উপন্যাসে খানিকের একটু রাজনৈতিক প্রভাব আর তাতে ফজলের জড়িত হওয়া একটু অন্যদিকে, অন্যভাবে বিপ্লবাত্মক ঘটনার জন্ম দেওয়া অস্বাভিক ছিল না। তার বদলে ফজলকে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ঝিমিয়ে পড়া একজন নায়ক হিসেবেই লেখক উপস্থাপন করেছেন।

উপন্যাসের দ্বিতীয় তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্র হল জঙ্গুরুল্লাহ। অনেকটা ভিলেনের বেশে সেমি-ভিলেনের মতো তার কার্যকলাপ অতটা আবেদন তৈরি করতে পারে নি। কোনো এক বিয়েতে সে বরযাত্রীর ফরাসে পা না ধুয়েই উঠে পড়ার পরবর্তীতে তার নামের টাইটেল হিসবে যুক্ত হয় পা না ধোয়া জঙ্গুরুল্লাহ! গ্রামাঞ্চলে যেরকম হয়ে থাকে আর কি! কোনো একটা গুরুতর/ক্ষুদ্রতর খুঁত বা দোষ যদি পাওয়া যায় বিশেষ কোনো মুহূর্তে তাহলে ঐ কর্মসম্পাদনকারী বা ঐ অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যসংগঠনকারীকে নানাভাবে চটানোর রীতি গড়ে উঠে এমনকি তার স্বতঃচলনতা/বহমানতা প্রজন্মের বেড়া পর্যন্ত ডিঙ্গায়। বেঁচে থাকে ঐ মানুষটি আর সাথে তার সাধারণকর্তৃক অর্পিত পদবি! এভাবেই হয়ত শত্রুতামূলক ঘটনার জন্ম দেয়। জঙ্গুরুল্লাহ নেহাতই কপর্দকহীন অবস্থান থেকে নিজ বুদ্ধি আর দুর্বুদ্ধি দুটোরই গুণে সমাজের ওপরের লেভেলে পৌছে যায়। প্রথমে দখলদারী, আগ্রাসী মনোভাব না থাকলেও আস্তে আস্তে সে সেদিকেই ধাবিত হয়। জাতে উঠার জন্য নিজ নামের সামনের ‘পা না ধোয়া’ কে বাদ দিয়ে পেছনে লাগায় ‘চৌধুরী’ যার আঞ্চলিক হিসেবে পরিচিতি পায় ‘চদরিসাব’। তারপরও যখন দেখল মানুষ তাকে আগের মতো থোরাই কেয়ার করছে, তখনই কেবল ঐসব মানুষদের ভিটেমাটির ওপরে তার আক্রোশ জন্মালো তথা পরবর্তীতে চরদখলের নানা কূটকৌশল অবলম্বন করা শুরু করল। তাতে অবশ্য সে সফলও হয়েছে। আইনকে টাকা দিয়ে কিনে তা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করাতে প্রথমে পারদর্শী হলেও পরবর্তীতে সে ধারা সে রক্ষা করতে পারেনি। তৎকালিন সময়ের বিট্রিশ পুলিশবাহিনীর দক্ষতা-তীক্ষণ্ণতা আর সতর্কতার কাছে তার কৌশল পরাজিত হলেও তা পুনঃউদ্ধারের চেষ্টা সে করে নি। এতেই তার ভিলেন হিসেবে ঠুনকো পরিচয় ফুটে উঠে। হত্যা মামলার আসামী হিসেবে প্রতিপক্ষ ফজলকে ফাঁসাতে না পেরে রণে ভঙ্গ দিয়ে সেখান থেকে কাপুরুষের মতো পলায়ন করে।
প্রশ্ন জাগে তাহলে ঔপন্যাসিক এতো ঠুনকো স্বভাবের ভিলেন চরিত্রকে বেঁছে নিলেন কেন?এই প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং লেখক দিলে ভালো হতো। তবে যেহেতু তিনি আর বর্তমানে নেই, তাই বিচার করার ভাড় আমরা যারা পাঠক আছি তাদের ওপরেই বর্তানো হোক।

এরফান মাতব্বর; আমাদের নায়ক ফজলের বাবা। এককালে বেশ ডাকাবুকো জবরদস্ত লোক ছিলেন। চর দখলের নেশা যার ছিল মজ্জাগত তদ্রুপ কলাকৌশলেরও তারিফ করতে হয় তার। রক্তারক্তির বদলে টেকনিক্যালি সমস্যার সমাধানে ওস্তাদ ছিলেন। পেরে উঠে পারেননি জঙ্গুরুল্লাহ সাথে সেটা হোক বয়সের ন্যুব্জতা বা বুদ্ধিগত অভাবের কারণে। পুত্রবধূর ভূয়সী প্রশংসাকারী; যদিও প্রথমটাকে জোর করে তালাক লিখিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করেছেন তবে দ্বিতীয়টার প্রতি ততোধিক ই অপত্য স্নেহ প্রকাশ পেয়েছে। ছেলের বউয়ের গয়না বন্ধক দেওয়ার কারনে বেয়াইসাব রাগ করে পুত্রবধূকে তার নিজ বাড়িতে আটকে রেখেছে। শর্তারোপ করেছে গয়না না পাওয়া পর্যন্ত তার মেয়েকে ঐ মণ্ডলবাড়ি পাঠাবে না। তাই শত কষ্ট সত্বেও টাকা জোগাড় করে গয়নাগুলো বন্ধকি থেকে ছাড়িয়ে এনে রওনা দেয় বেয়াইবাড়ির দিকে। তবে তার আশা আর পূরণ হয় না। বেয়াইসাব গয়না রেখেছে, তবে তার মেয়ে ছাড়েনি। যাইহোক, আরো নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে এরফান মাতব্বর উপন্যাসের কাহিনি থেকে ছিটকে যায় অথার্ৎ লেখক এ পর্যায়ে এরফান মাতব্বরের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়েছেন।

আরশাদ আলী; এরফানের বেয়াইসাব, ফজলের শ্বশুর বা রুপজানের বাবা এই পরিচয় ছাড়াও তার আরেকটি পরিচয়  সে হল জঙ্গুরুল্লাহর ছা-পোষা ভক্ত। ফজলের কাছ থেকে জোর করে রুপজানের তালাকনামা নেয় শুধুমাত্র কিছু জমি পাওয়ার লোভে। পুরো উপন্যাস জুড়ে তার এইসব কার্যক্রম তার প্রতি বিরক্তির উদ্রেক করলেও শেষের প্রতিবাদী অবস্থান তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।

উপন্যাসে নারীচরিত্রগুলোর স্বকীয়তা একদম নেই বললে অত্যুক্তি করা হবে না। রুপজান আর জরিনা দুজনের মধ্যে কে যথার্থই নায়িকা হওয়ার যোগ্যতা রাখে সে প্রশ্ন উঠলে আমি জরিনাকেই নায়িকা হিসেবে উল্লেখ করব। কিছুটা স্বাধীনচেতা, স্বমহিমায় উদ্ভাসিত, সমাজের শৃঙ্খল থাকা সত্বেও নিজ কর্মবলে কাজ চালিয়ে জীবিকা অর্জন করা সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ।
আর আর চরিত্রের সমাবেশ নেহাতই ঘটনার খাতিরে টেনে আনা হয়েছে।

সর্বপরী বলা যায় আবু ইসহাকের এই উপন্যাস এতটা জটিলতাপূর্ণ বা কূটিলতায় ভরপুর না হলেও নিতান্ত সহজ-সরল চরিত্রের সমাবেশ পাঠককে বাধ্য করে অন্তত উপন্যাসটা পড়ে শেষ করে ফেলতে।।