১৯১০ সালে তৈরি ফ্রিম্যাসন্স হল রাজধানী ঢাকার পুরানা পল্টন মোড়ে মুক্তাঙ্গনের একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটি পুরোনো দোতলা সাদামাটা একটি ভবন। ভবনটির গায়ে থাকা ফলকে লেখা রয়েছে, ‘ফ্রিম্যাসন্স হল, ১৯১০’। ভবনটি ১১০ বছর আগে নির্মিত হলেও এটি একাধিকবার সংস্কার করা হয়েছে। অনেকে বলেন, এটি ছিল ইহুদিদের ক্লাব। কেউ বলেন, এখানে ইহুদিরা গোপনে সভা করতেন। অনেকের মতে, এটি ছিল ইহুদিদের প্রার্থনাঘর। আসলেই কি ঢাকায় ইহুদিদের প্রার্থনাঘর বা গোপন আস্তানা ছিল? বাংলাদেশের ইতিহাস এই ক্ষেত্রে খুবই নিরব। যদিও সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের পাসপোর্টে ইসরাঈল ভ্রমণ নিষেধ কিন্তু সেতো ১৯৭১ সালের পরের কথা। তার পূর্বের ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে কি রয়েছে? চলুন, আজকে আমরা তার একটা গল্প জেনে আসি।

১৯১০ সালের ফ্রিম্যাসন্স হল। পুরানা পল্টন, ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি। ছবি: আবদুস সালাম, প্রথম আলো

ঢাকার ফ্রিম্যাসন্স হলটি লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল এতোদিন। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম আলো পত্রিকা সহ বেশ কয়েকটি পত্রিকা ও টেলিভিশনে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে, আমাদের সামনে অনেক অজানা ইতিহাস উঠে আসে। এটি ইহুদিদের একটি প্রার্থনালয়। পল্টনের এই প্রাচীন স্থাপনাটি ১০ কাঠা জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ হলটি আগে আরও বড় ছিল। এটি ফ্রিম্যাসনদের একটি ক্লাব। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক ভবন ভূমি মন্ত্রণালয়ের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এটির বিষয়ে বহুজনের মত পার্থক্য রয়েছে। কেউ ফ্রিম্যাসন্স হলকে সরাসরি ইহুদিদের ক্লাব বলেছেন। আবার গবেষকদের মতে, হলটিকে সরাসরি ‘ইহুদিদের ক্লাব’ বলা অযৌক্তিক। ফ্রিম্যাসন্স হলের দেয়ালে সংঘের একটি লোগো রয়েছে। লোগোতে একটি কম্পাস ও স্কেলের চিহ্ন রয়েছে। আগে জানা প্রয়োজন, তাহলে ‘ফ্রিম্যাসন’ কি?

ফ্রিম্যাসনরির সদস্যদের ফ্রিম্যাসন বলা হয়। ধর্মীয় দিক থেকে আমরা জানি, বাইবেল অনুসারে ফ্রিম্যাসনেরা সলোমনের অনুসারী। ব্রিটানিকা থেকে আরো জানা যায়, বিশ্বের অনেক ফ্রিম্যাসনরি লজ ইহুদি, ক্যাথলিক ও কৃষাঙ্গবিরোধী। কেউ কেউ বলেন, ঢাকার হাতে গোনা ইহুদিরা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গেই চলাফেরা করত। এমন হতে পারে, এই হলে ইহুদিদেরও যাতায়াত ছিল। ‘ফ্রিম্যাসনরা ক্যাথলিক ছিলেন না, এটা নিশ্চিত। তাদের একসময় ক্যাথলিকেরা ভালো চোখে দেখতেনও না।

ফ্রিম্যাসন্স হলের দেয়ালে সংঘের লোগো। পুরানা পল্টন, ঢাকা, ১৬ ফেব্রুয়ারি। ছবি: আবদুস সালাম, প্রথম আলো

এখন দেথা যাক, এদের সাথে বাংলাদেশের কি সম্পর্ক? বাংলাদেশে এখনও ইহুদি ধর্মাবলম্বি আছেন বা নেই সে বিষয়টা আলাদা। তবে জানা যায় যে, ভারত উপমহাদেশে সুলতানি আমলেই ইসরাইল সম্প্রদায়ের ইহুদিরা কোনকান ও কোচিন উপকূলে বসবাস শুরু করেছিল। বর্তমান ভারতের মিজোরাম ও মনিপুরে বহু ইহুদি বসবাস করছে। বাংলাদেশে কখন প্রথম ইহুদিরা আসে তার রেকর্ড না থাকলেও সুলতানি আমল এর প্রথম দিকে এবং মোগল আমল থেকেই ইহুদিদের অনেকেই ঢাকা, চট্টগ্রাম এলাকায় বসবাস করতো। মোগল আমলে যখন ইউরোপিয়দের সাথে বানিজ্য বৃদ্ধি পায় তখন ব্যবসায়ী ইহুদি শ্রেনি মহাজন ও ব্যাবসায়ি হিসেবে এদেশে তাদের আস্তানা গড়েছিল। এছাড়া মুল্যবান রত্ন ব্যাবসার বড় অংশই ইহুদিদের নিয়ন্ত্রনে ছিল। মোগল আমলে ঢাকায় বসতি করা অনেক ইহুদি পরিবার ১৯৪৭ সালের পর কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় ইহুদিদের উদ্যোগেই গড়ে উঠে সিনাগগ, ট্রিংকা রেষ্টুরেন্ট ও গ্রান্ড হোটেলের মত বহু প্রতিষ্ঠান। তবে তখনও কয়েকটি পরিবার বাংলাদেশে রয়ে যায়। যার মধ্যে রাজশাহির কোহেন পরিবার এবং চট্টগ্রামের বারোক পরিবার অন্যতম। ঢাকাতেও থেকে যায় কিছু পরিবার। আসলে বাংলাদেশের সাথে ইহুদীদের আরো একটা বিশেষ সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে। সেটি হলো- আমেরিকান লুই আই কান, যিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি ছিলেন এবং ভারতীয় সেনা জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব, যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তারা দুজনেই ছিলেন আজীবন ইহুদি।

ঢাকা টেলিভিশনের প্রথম ঘোষক ইহুদি সম্প্রদায়ের মর্ডি কোহেন বুদ্ধদেব বসু, ছবিঃ কালের কণ্ঠ

যাইহোক, মধ্যযুগে ক্যাথিড্রাল তৈরি এবং পাথরের কাজ করেন এমন ব্যক্তিদের দিয়ে সংগঠিত হয়েছিল ফ্রিম্যাসন্স হল। অর্থাৎ রাজমিস্ত্রিদের সংগঠনও হতে পারে। কারণ রাজমিস্ত্রির ইংরেজি শব্দ ম্যাসন। ১৭১৭ সালে যুক্তরাজ্যে এই সংঘ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। ১৭৭৫ সালে লন্ডনে এর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। ধারনা করা হয়, তেমনিভাবে ঢাকাতে ফ্রিম্যাসন্স হল নির্মিত হয়েছিল। ফ্রিম্যাসন শব্দের সঙ্গে ইহুদি সম্প্রদায়ের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ঢাকার এই হলটি যে ফ্রিম্যাসনদের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও পরবর্তীতে, তারা অনেক গোপন কাজের সাথে জড়িয়ে পরে। যেকারণে, তাদেরকে ‘সেক্রেট এজেন্ট’ বলা হয়ে থাকে। এ বিষয়ে আরো গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে। তার জন্য প্রয়োজন সকলের সহযোগীতা।

তথ্যসূত্রে, প্রথম আলো পত্রিকা, উইকিপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার কাছে আমরা ঋণী।

লেখাঃ এসআইএস ক্রিয়েটিভ রাইটিং টিম।