ইতিহাসের দিক থেকে কেরল রাজ্য একটি অতি সমৃদ্ধ খনি। ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয় কেরলে। প্রথম রোমান ক্যাথলিক গির্জাও এখানে স্থাপিত হয়। ইহুদিরা এখানে বসতি স্থাপন করেছিল আবার এখানেই জন্মেছেন শঙ্করাচার্য যিনি মাত্র বত্রিশ বছর জীবিত ছিলেন। তিনি অধুনা কেরল রাজ্যের কালাডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (৭৮৮-৮২০ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি ভারতের চার প্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করে হিন্দু ধর্মের ধ্বজা তুলেছিলেন। ‘’শ্লোকার্ধের প্রবক্ষামি যদুক্ত: গ্রন্থ কোটিভি: অর্থাৎ কোটি কোটি বইয়ে যা লেখা আছে সেটা আমি মাত্র আধখানা শ্লোকে বলে দিতে পারি, কি তেজি বক্তব্য ! সেই আধখানা শ্লোক হচ্ছে — ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। কথাটা খুবই সরল কিন্তু আসলে বেশ জটিল। জগৎ কেন মিথ্যা হবে ? সেই বিষয়ে তিনি বলেছেন, প্রত্যেক জীবই স্বরুপত ব্রহ্ম, কিন্তু অজ্ঞানবশত জীব তাঁর স্বরুপ বুঝতে পারেনা বা ভুলে যায়।

২০১২ সালের চেরামন জুম্মা মসজিদ এর আলোকচিত্র

শঙ্করাচার্যের জীবনীতে আছে যে— বারোশো বছর আগের কথা… একদিন তিনি পূর্ণা নদীতে গোসল করার সময় একটি কুমির তার পা কামড়ে ধরে। এক সময় পূর্না নদীতে কুমির ছিল ।শঙ্করের মাও সেই সময় পূর্ণার তীরে উপস্থিত ছিলেন, এটা দেখে তিনি আর্তস্বরে কেঁদে উঠেন। শঙ্করাচার্যের তখন কিশোর বয়স, সেই বয়সেই তিনি সংসার ত্যাগ করে ব্রহ্মচর্য নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চান কিন্তু মা রাজি না। তিনি মা-কে বলেন, মা যদি সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দেন, তাহলে তিনি বাঁচার চেষ্টা করবেন। ছেলের প্রাণ বাঁচাতে মা তখন ব্যাকুলভাবে অনুমতি দিয়ে বললেন, তুই সন্যাসী, ব্রহ্মচারী যা হতে চাস হবি, এখন শুধু বেঁচে ফিরে আয়। তখন কুমিরটি তার পা ছেড়ে দিয়ে চলে যায় আর তিনি ঘাটে ফিরে আসেন। এরপর আর কোনোদিন পূর্ণা নদীতে কোনো কুমিরকে দেখা যায়নি। কালাডিতে রয়েছে তার স্মৃতিমন্দির বা আটতলা কির্তিস্তম্ভ সৌধ। শঙ্করাচার্যের জন্মস্থান হিসাবে জায়গাটি প্রায় তীর্থস্থানে পরিনত হয়েছে। সেখানে রয়েছে তার রুপার চটিজুতা আর দেওয়ালের গায়ে তার জীবনকাহিনীর নানারকম ছবি।

শিষ্যদের সাথে আদি শঙ্কর

বন্দর নগর কেরলের কোচিন দূর্গ চত্বরেই রয়েছে প্রথম রোমান ক্যাথলিক গির্জাটি, পর্তুগীজরা এটা বানিয়েছিল প্রায় পাঁচশো বছর আগে। সেন্ট ফ্রান্সিসের নামের এই গির্জাটি খুব সাদামাটা, খুব বড় বা খুব সুন্দরও নয়। সামনের অংশটুকু অবিকল রেখে ভিতরে যে অনেকবার পুননির্মান করা হয়েছে। কিন্তু এই চার্চের প্রধান আকর্ষন — এখানেই ভাস্কো-দা- গামার সমাধি, ১৫২৪ সালে ভাস্কো-দা- গামা এখানে মারা যান। পাশ্চাত্য বনিক ও লুন্ঠনকারীদের ভারতে প্রথম টেনে এনেছিলেন এই ভাস্কো-দা- গামা, ভারতের অধঃপতনের ইতিহাসে এই মানুষটির ভূমিকা অনেকখানি।

সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চের সামনে

সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চে তাকে কবর দেয়ার চৌদ্দ বছর পর তার দেহাবশিষ্ট লিসবনে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এই গির্জার মধ্যে তার কফিন ও সমাধি ফলক রয়ে গেছে, স্মৃতিফলকে লেখা আছে তার মৃত্যু হয়েছিল ক্রিসমাসের দিন সকালে।তার দেহ এখানে থাকুক বা থাকুক, তাতে কিছু যায় আসেনা, মৃত অবস্থায় তিনি এখানে শায়িত ছিলেন ,সেটা ভাবতেই রোমান্চ হয়।

কেরলের মাত্তান নামের জায়গাটায় যেন বিষন্নতার ছোঁয়া লেগে আছে। এখানকার পল্লীতে কোন যুবক কিংবা যুবতী নাই , অধিবাসী অধিকাংশই বুড়ো- বুড়ি।মাত্তানের জু টাউন, এক কালে ছিল সমৃদ্ধ নগর। ইজরায়েল থেকে পালিয়ে এসে দলে দলে ইহুদিরা এখানে বসতিস্থাপন করেছিল। এখনো বাড়িগুলি ইউরোপিয় ধরনের , রাস্তাঘাট সুন্দর কিন্তু যারা আছে তারা সবাই বুড়ো বুড়ি, অল্প বয়সীরা সবাই পাড়ি দিয়েছে উন্নত ও শক্তিশালী দেশ ইজরায়েলে, সেখানে ইহুদিদের কাজ যোগাড় করার কোন অসুবিধা নাই। বুড়ো বুড়িরা যায়নি কারন শেষ বয়সে নতুন পরিবেশে গিয়ে কিইবা হবে ! একেকটা বড় বাড়িতে আছে ফ্যাকাসে মুখের মাত্র একটি বৃদ্ধ ও একটি বৃদ্ধা। এরাই এখানকার প্রসিদ্ধ সিনাগগটি কোনরকমে চালু রেখেছে।

তথ্যসূত্র

পায়ের তলায় সর্ষে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়