“বসন্ত বাতাসে সই গো

বসন্ত বাতাসে

বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ

আমার বাড়ি আসে।”

শিল্পী শাহ আব্দুল করিমের এই গানটি কে না শুনেছে ! তার আরও অনেকগুলি জনপ্রিয় গান আছে যা মানুষের মুখে মুখে ফিরে….

‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু’, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ কিংবা ‘গাড়ি চলে না’ মতো কালজয়ী গানগুলো এখনও শ্রোতাদের মন আলোড়িত করে। বাংলার লোকগানের সর্বশেষ অধীশ্বর বলা হয় তাকে।

যে বাড়িটিতে বাউল সম্রাট থাকতেন

তার অন্যান্য  গানের মধ্যে আছে- ‘প্রাণনাথ ছাড়িয়া যাইও না মোরে’, ‘আগের বাহাদুরি এখন গেল কই’, ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে’, ‘আমার বন্ধুয়া বিহনে গো’, ‘মাটির পিঞ্জিরার সোনা ময়না রে’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে’, ‘আইলা না আইলা নারে বন্ধু’, ‘মানুষ হয়ে তালাশ করলে মানুষ হওয়া যায়’, ‘সখি কুঞ্জ সাজাও গো’, ‘তুমি বিনে আকুল পরাণ’, ‘আমি তোমার কলের গাড়ি’, ‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী’, ‘কেমনে ভুলিব আমি’ ও ‘রঙের দুনিয়া তোরে চাই না’সহ অনেক গান।তার গানগুলি সাধারনত লোকগীতি, বাউল গান ও ভাটিয়ালি গান,  এ পর্যন্ত তার ৭টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা সঙ্গীতে তাকে বাউল সম্রাট বলে সম্বোধন করা হয়।

বাউল সম্রাটের ব্যবহৃত বিছানা

ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে।

তিনি শরীয়তী, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীতসহ বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চা করেছেন।

তার জীবনের একটি বড় অংশই কেটেছে দরিদ্রতার সাথে লড়াই করে। দারিদ্রতার কারনে তাকে জমিতে কৃষিকাজ করতে হতো কিন্তু কোন কিছুই তাকে তার গান রচনা করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

বাউল সম্রাটের ব্যবহৃত হারমোনিয়াম এবং একতারা

 কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও বেশ কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলে তিনি সারাদেশে পরিচিত হন।

শাহ আব্দুল করিমের জন্ম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে একটি কৃষক পরিবারে। নানা অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা এ বাউল এক সময় সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। আর কালে কালে মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে তা নিয়ে গান রচনা করে গেছেন। এই গানে যেমন ছিল আনন্দ তেমনি ছিল জীবন সংগ্রামের প্রেরণা। আর এ কারণেই তাঁকে দেওয়া হয়েছে ‘বাউল সম্রাটের’ মর্যাদা।অভাব অনটনের মধ্যে বেড়ে উঠলেও গানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা।

তিনি, তাঁর সহধর্মিনী এবং তাঁর একমাত্র ছেলে

স্বশিক্ষিত বাউল শাহ আব্দুল করিম এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচশোরও বেশি গান লিখেছেন এবং সুর করেছেন। বাংলা একাডেমির উদ্দ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়।

বাংলা সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০১ সালে ‘একুশে পদক’ পুরস্কারটি দেন।

২০০৬ সালে সাউন্ড মেশিন নামের একটি অডিও প্রকাশনা সংস্থা তার সম্মানে জীবন্ত কিংবদন্তী বাউল শাহ আবদুল করিম নামে বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া তার জনপ্রিয় ১২ টি গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে। সেখান থেকে যে অর্থ পাওয়া যায় সেটা তার চিকিৎসার জন্য তার হাতে তুলে দেয়া হয়।

২০০৭ সালে বাউলের শাহ আবদুল করিমের জীবন নিয়ে একটি বই প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়, ‘শাহ আবদুল করিম সংবর্ধন-গ্রন্থ’ (উৎস প্রকাশন) নামের এই বইটি সম্পাদনা করেন লোকসংস্কৃতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক সুমনকুমার দাশ। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী ২০০৯ সালের ২২ মে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ও খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি ড. জাফর আহমেদ খানের উদ্যোগে বাউল আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে গ্রন্থ ‘শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র’ প্রকাশিত হয়।মোটমাট তার সাতটি বই প্রকাশিত হয়।

এই ঘরটির ভেতরেই ঘুমিয়ে আছেন শাহ আবদুল করিম ও তাঁর সহধর্মিনী

তিনি ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি লালন ফকির, হাছন রাজা, রাধারমণ, শীতালং শাহ, দুদ্দু শাহ্, উকিল মুন্সীকে মনেপ্রাণে লালন করে গান করতেন।