বাংলা নববর্ষ আমাদের বেড়ে ওঠার এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। ষাটের দশকের মাঝামাঝি, আমার বয়স হয়তো নয় কি দশ, সারা রাত অপেক্ষা করতাম, নববর্ষের মেলায় যাব কাল সকালে। কী কিনব আমি? নানার বাড়ি ৩৭ নাজিমউদ্দিন রোডের বিশাল পরিবার। বাবা ড. আশরাফ সিদ্দিকী অথবা মামা ড. আব্দুল লতিফ চৌধুরী এই একান্নবর্তী পরিবারের সব শিশুকে নিয়ে যাবেন মেলায়। আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাব? মুড়ি? না, মুড়কি? চিনি নাকি গুড়ের সাজ? নাকি, মুরালি? প্রতিবারের তুলনায় এবারের মেলা থেকে বাজার করার জন্য বরাদ্দ কিছু বেড়েছে। গত বছর পেয়েছি ৪ আনা, এবারে পেলাম ৬ আনা। কী আনন্দ!

গতবারে কিনেছিলাম পানিতে চলা খেলনা লঞ্চ। এবারে কিনতে চাই ডুগডুগি। আমাদের মাঝে বড় রুমি ভাই (সায়ীদ সিদ্দিকী), সে কিনবে মাটির তৈরি পাকা চুলের বুড়োটাকে, এত পছন্দ করত বুড়োটাকে কী জন্য কে জানে?  বুড়োর গলায় স্প্রিং লাগানো থাকত,  তা দিয়ে  মাথা আগে পেছনে বা পাশে হেলানো যেত। রুমি ভাইয়ের খেলা ছিল বুড়োর মাথা ধরে বলা—‘রিমার এক চোখ নাই।’ বুড়োর মাথা নাড়িয়ে তার দাবির পক্ষে সায় নিত রুমি ভাই। আর আমি চিত্কার করতে থাকতাম। ‘এই তো আমার চোখ।’ ছোট বোন রীয়া (ড. তাসনিম সিদ্দিকী), সে বোকার মতো শুধু মাটির হাঁড়ি কেনে। গতবার কি কাণ্ডই না হলো! ফেরার পথে হাত থেকে ফেলে হাঁড়ি ভেঙে ফেলে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে সে কী কান্না। আবার ফিরে গিয়ে নাকি তাকে কিনে দিতে হবে। ছোট বোন রিফির (রিফাত আহমেদ) চাই মাটির পুতুল। তাও আবার একটা নয়, দুইটা চাই। মামাতো বোন নিনি (ড. নাসরিন ওয়াদুদ) আর আমার নারীসুলভ কোনো খেলনায় উৎসাহ ছিল না। আমরা কিনতাম দড়ি দিয়ে টানা ডুগডুগি বা তলোয়ার বা লাল কাগজ লাগানো চশমা। বিকাল হলে আবার বের হতাম বাবার সঙ্গে—নজরুল একাডেমি, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডে বাবা বক্তৃতা দিতেন। আর রিয়া বাবার কবিতা পড়ে শোনাত—‘আস বর্ষ, নববর্ষ, আন পিক কোয়েলীয়া, ময়না খঞ্জনার উদাশিয়া বারমাসী’।

১৮-তে পা দিয়ে নববর্ষ এল অন্যরূপে। সদ্য যৌবনা মেয়েদের সাজাতে মা সাঈদা সিদ্দিকী কিনে আনতেন লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। মা নেই কিন্তু বৈশাখে নতুন তাঁতের শাড়ির চলটা ছাড়তে পারিনি। ১৯৭৪ বা ৭৫ সাল (বাংলা ১৩৮২ সন)। রীয়া-রিফি শাড়ি পরায় বেশ পটু। বিশেষ করে রীয়া ক্লাস সিক্স থেকেই ভীষণ পরিপাটি করে গুছিয়ে শাড়ি পরতে পারত। এক্ষেত্রে অপটু ছিলাম আমি। ডালিয়াকে হাতে-পায়ে ধরে রাজি করাতাম সকালে এসে আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে। ভীষণ ঝক্কির কাজ মনে হতো শাড়ি পরা। ঘাড়ে পিন লাগাও, কুঁচিতে পিন লাগাও। তার পরে ওই ১২ হাত কাপড় পরে কি হাঁটা যায়? পায়ে জড়িয়ে যেত। আমার পরিবারের টমবয় আমি। ক্লাস নাইন থেকেই গাড়ি চালিয়ে সবাইকে এদিক-ওদিক নিয়ে যাই।

                                                        শ্রীলংকায় নববর্ষ উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী প্রথা হিসেবে নতুন মাটির হাড়িতে দুধ জাল দিচ্ছে

কলেজপড়ুয়া আমার দায়িত্ব ছিল সব বান্ধবী ডিনা, ডালিয়া, রলিদের বাসা থেকে তুলে বাবার ‘ডাটসন ব্লু বার্ড, গাড়ি করে রমনা পার্কে যাওয়া। কোথায় বসব আগে থেকে ঠিক করা থাকত। বাকি সব বন্ধু এসে যোগ দিত। জেনি, প্রজ্ঞা, লাবনী, হেলাল ভাই, তাজু ভাই আরো কত কে! তখন আমাদের চ্যালেঞ্জ নেয়ার বয়স, সামনে ভিড়, ছায়ানটের অনুষ্ঠান দেখা যাচ্ছে না। সোজা জেনির সঙ্গে হেলাল ভাইয়ের হোন্ডার ওপর দাঁড়িয়ে গেলাম। সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছিল। সেই সময় কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, নায়ক, সবাই যেন চেনা। খাচ্ছি কিছু, আল মনসুর এসে তাতে হাাসিমুখে ভাগ বসালে, যেন বর্তে যেতাম। সে সময় টিভির নায়কদের মধ্যে রীয়া, নিনি এরা পছন্দ করত আল মনসুরকে, আমার বেশি ভালো লাগত রাইসুল ইসলাম আসাদকে!

একবার হলো কি, এক সাংবাদিক সবাইকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করল, ‘আজ বাংলা কত সন?’ অনেক ইয়াং মেয়েই উত্তর দিতে পারছিল না। সাংবাদিকটি বেশ মজা পাচ্ছিল। জেনি দিল তার মজা নষ্ট করে। প্রশ্ন মাটিতে পড়ার আগেই বলে দিল—এটা অমুক সন। একবার নায়িকা চম্পাও জুটে গেল আমাদের সঙ্গে। আমরা ফটোগ্রাফারদের টার্গেট হয়ে গেলাম। সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি। সেই সব দিন পেরিয়ে আজ আমি ৬০-এর কোটায়। সেই আমি যে আবার ষোড়শীর মতো পহেলা বৈশাখ উপভোগ করব তা ভাবতে পারিনি।

আমার পুত্রবধূটি (সাবিনা মাহরুফ) সিংহল দেশের। ২০১৫ সালে আমরা যাচ্ছি বেয়ান বাড়ি বেড়াতে। ভাগ্যক্রমে মাসটি ছিল এপ্রিল। যাচ্ছি রাজধানী কলম্বো শহরে। কোথাও গেলে ভূগোলের ছাত্রী হিসেবে সব আদ্যোপান্ত না জানলে আমার ভালো লাগে না। জানলাম কলম্বোর পুরনো নাম ‘কালান তোত্তা’। আশ্চর্য হলাম মানে শোনে—‘কলানি নদীর ফেরিঘাট’। আরব নাবিকদের ভুল উচ্চারণে তা হয়ে গেল ‘কালাম্বু’। ঔপনিবেশিকতার ছাপত থাকবেই! তাই ১৫১৭ সালে কলম্বাসের সম্মানে হয়ে গেল কলম্বো। ১৬৫৬ সালে ওলন্দাজরা এবং তারপর ১৭৯৬ সালে ব্রিটিশরা শহরটি দখল করে নিলেও  নামের ওপর আর ছুরি চলেনি। এয়ারপোর্টে নেমে দেখি তখন শহরে সাজ সাজ রব। চারদিকে মুখোশের ছড়াছড়ি। একদল শিল্পী গান গাইছে। শুনলাম এসব তাদের নববর্ষকে ঘিরে হচ্ছে। আমি তো অবাক! আমাদের নববর্ষ আর শ্রীলংকার নববর্ষ কি একই দিনে? এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যাওয়ার পথে দেখি রাস্তায় রাস্তায় বোর্ডে বড় বড় করে লেখা—‘SUBAMA SUBA NAWA WASARKMA WEWA’।

                                                      নববর্ষ উপলক্ষে তামিলদের হাতে বানানো পিঠা সহ ঐতিহ্যবাহী খাদ্য পরিবেশন

 

অবাক হয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি, শুধু শ্রীলংকায় নয়, থাইল্যান্ড, লাউস, মিয়ানমার আমাদের দু-একদিন আগে-পরেই নববর্ষ পালন করে। আমাদের দেশে নববর্ষ যেমন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার অনুষ্ঠান। শ্রীলংকায় সিনহালা ও তামিল সম্প্রদায় এ উৎসব পালন করে। আমার ডাকসাইটে ল’ইয়ার বেয়ান বললেন, আমরা নববর্ষকে বলি ‘আলুথ আভুরদ্দা’। এ উৎসব সম্পর্কে আমার কৌতূহল দেখে বেয়ান শাহনাজ আরো জানালেন, বৌদ্ধ ও তামিল সম্প্রদায় তাদের নতুন বছর জ্যোতির্বিদদের দ্বারা নির্মিত শুভ সময়ে শুরু করে নববর্ষের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান। নববর্ষের আগের দিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে পূজা আর বিভিন্ন আচার পালনের মধ্য দিয়ে তারা পুরনো বছরকে বিদায় জানায়। পুরনো বছরের শেষের দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিনের মাঝে একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ণয় করে থাকে।

শাস্ত্রমতে, এ সময়ের নাম ‘ননাগথে’, সে সময় তারা সাংসারিক বা অন্য সব রকম কাজকর্ম থেকে বিরত থাকে। পুরোহিতদের আশীর্বাদ নেয়া এ সময়ের প্রধান কাজ। মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি দিনের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের সময় জানিয়ে দেয়। বছরের শেষ দিনে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে  বিভিন্ন ভেষজ মেশানো তেল মেখে স্নান করে তারা তাদের শরীর ও আত্মাকে শুদ্ধ করে। বিকাল থেকেই তারা তাদের রান্নাঘরগুলো পরিষ্কার করে ঝকঝকে করে রাখে। উঁকি দিয়ে পাশের বাড়িতে দেখি মেঝেতে সুন্দর আলপনা আঁকা হচ্ছে। চারদিক থেকে ভেসে আসছিল ড্রামের (তাদের ভাষায় রাবনাবাদ) শব্দ। আর সেই সঙ্গে ফুটছিল আতশবাজি। পরদিন সকালে কলম্বো শহর থেকে ৭২ মাইল দূরে ক্যান্ডি শহরে আমাদের বেড়াতে নিয়ে গেলেন আমার বেয়ান। সেখানে থাকেন তার খালাত বোন সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন রোজ। ভগ্নিপতি কাদির সাহেব, বয়স ৮৫ বছর, স্থানীয় স্পাইস মার্চেন্ট। তাদের মেয়ে ড. রিফকা  বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে এমবিবিএস পাস করে এখন সরকারি হাসপাতালে কাজ করে। এ ক্যান্ডি শহরটাও ইতিহাসে ঠাসা। এটা শ্রীলংকার প্রাচীন রাজাদের সর্বশেষ রাজধানী ছিল। ঢাকায় বসে আমরা যে ডিলমা চা খাই, তা এ ক্যান্ডি শহরের পাহাড়ের পাদদেশেই উত্পন্ন হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ শহর ৫০০ মিটার উপরে অবস্থিত, সেখানে টুথ রিলিকের মন্দির দেখে আমি মুগ্ধ। এটা বৌদ্ধ বিশ্বের অন্যতম উপাসনালয়। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা, কোনো কোনো পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে গেছে জলপ্রপাত। কোথাও রাস্তার পাশে স্থানীয় অধিবাসীরা ফল সাজিয়ে বিক্রি করছে।

                                                                    শ্রীলংকায় নববর্ষ উপলক্ষে পান সুপারি পরিবেশন

রোজ আমাদের স্বাগতম জানালেন ‘কিরিবাথের’ মাধ্যমে, যা আমাদের দেশের ফিরনির মতো। বছরের প্রথম দিন কিরিবাথই তাদের ঐতিহ্যবাহী খাদ্য। রোজ আমাকে তাদের রান্নাঘরে নিয়ে চুলায় চড়ানো নতুন মাটির হাঁড়ি দেখিয়ে বললেন, এই নতুন মাটির হাঁড়িতে দুধ জ্বাল দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়াকে তারা তাদের সমৃদ্ধির প্রতীক বলে মনে করেন। খাবার টেবিলে দেখি সে এক এলাহি কাণ্ড! হাতে বানানো নানা রকমের পিঠা। স্থানীয় ভাষায় আমাকে পিঠাগুলোর নাম বলে গেলেন রোজ—কুকিস, আসামি, কেওস, আলুওয়া, ওয়েলি, থালাপ, ডডুল। কোনো কোনো পিঠার সঙ্গে আমাদের দেশের তৈরি পিঠার বেশ মিল রয়েছে। আশপাশের বাসার সঙ্গেও খাবার আদান-প্রদান চলছিল। তাছাড়া স্থানীয় আত্মীয়স্বজনদের আগমন ও শুভেচ্ছা বিনিময় তো রয়েছেই। মজা লাগল দেখে যে শিশুরা তাদের নববর্ষ শুরু করে বই পড়ে। আর বড়রা তাদের পেশানুযায়ী প্রতীকী কাজ শুরু করে। যেমন কৃষকরা ধান রোপণ করে, শিক্ষকরা পড়ান। নববর্ষে ছোটরা বড়দের পান-সুপারি খাওয়ায় আর বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ করে অর্থ দিয়ে। বিকালবেলা শুরু হলো নানা ধরনের খেলা। কোনো একটি খেলায় আমিও একটি পুরস্কার পেয়ে গেলাম। বর্ষবরণ উৎসব অনেক সময় সপ্তাহব্যাপী উদযাপন করা হয়।

পুত্রবধূর দেশের এ উৎসব আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল  আমার কৈশোরে-আমার যৌবনে। নববর্ষের সেই আনন্দই আবার যেন পেলাম এই নতুন দেশে, নতুন আবেশে।