বিভূতিভূষণ বাবু’র কি ছোটগল্প কি উপন্যাস_ সবখানেই প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্কে সম্পর্কিত একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়_ তা কমবেশি সবারই অবিদিত নয়। প্রকৃতির সাথে মানব জীবনের চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্কের ইতি তথা রীতিতে কখনো যেমন ভারসাম্যতা এসেছে আবার কখনো ততটা ভারসাম্য অবস্থার দেখা না পেলেও নিদেনপক্ষে তার আকার ইঙ্গিতের মাধ্যমে অন্তত এটা বুঝা যায়_পূর্ণতা কখনো কখনো যদি অপূর্ণের দ্বারা রহিত হয় তখন ই কেবল তার আচার বিচারের নিমিত্তে মানুষের মনে অনেককাল অবধি স্থায়ী হতে পারে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে নিখুঁতের পাশাপাশি খুঁতের যদি কম্বিনেশন হয় তখন তা হয়ে উঠে আরো বেশি চিত্তাকর্ষক, আরো বেশি স্থায়ী। নিতান্তই সহজ-সরল, যা দেখে বড় হয়েছি বা যার সাথে হয়ত একসময় দহরম-মহরম সম্পর্কের মণিজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত ছিলাম, পরে যখন একজন লেখকের মানসপটে চিত্রিত হয় বিশেষ কোনো চরিত্রের দ্বারা তখন বলতেই হয়_আরে এ তো আমারই ঘটনা! লেখকের সার্থকতা মনে হয় তখনই বিচার করা হয়। ব্যর্থ লেখকেরা মনে হয় গঁদবাঁধা ঘটনার যাত্রাহীন বিরতীতে লিখতে গিয়ে কখন যে যাত্রীহীন তথা পাঠকহীন হয়ে একলা হয়ে পড়েছেন তা মনে হয় তারা ঘুণাক্ষরেও টের পান না! আর এই না পাওয়ার ফলেই তাদের আদুরে সৃষ্টিকর্মেরও সময়ের কালস্রোতে মলিন হয়ে, বিলীন হয়ে পাঠকের মন থেকে একেবারে মুছে যেতে হয় বা অবিশ্যি যাওয়া লাগে। বিভূতি বাবুর বেলায় মনে হয় একথা খাটে না। সবক্ষেত্রেই যে তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তা যেমন সত্য নয় তদ্রুপ কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি যে অনেকের চেয়ে অন্যতমের কৃতিত্বের দাবিদার তা না মানলেও সত্যের অপলাপ হবে।

পথের পাঁচালি, অপরাজিত, অশনী সংকেত উপন্যাস বা মেঘমল্লার, মৌরীফুল, যাত্রাবদল, কিন্নর দল বা আহ্বানে’র মতো বিখ্যাত ছোটগল্পের সৃষ্টিকর্তা বিভূতিভূষণ। সাহিত্য চর্চা করতে কলকাতায় আসেননি কখনো। বরং সবুজে শ্যামলে ঘেরা পরগণার ঘাটশিলাতেই জীবনাবধি কাটিয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে কলকাতায় আসলেও স্থায়ী হননি। বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে টিটকারি, কাষ্ঠহাসি হাসলেও রাগ করেননি কখনোও। স্বনামে আর সুনামের সহিত সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। লেখকের প্রথম সাহিত্যের কর্ম হিসেবে পথের পাঁচালি’কে গণ্য করা হয়। সমস্ত বাঙালির কাছেই উপন্যাসটি যে সুপরিচিত তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। অপু-দুর্গা_ভাইবোনের অপত্য স্নেহ বা সর্বজয়ার মতো মহিয়সী মায়ের কঠিনতম সংগ্রামের নানা দিক_ তা যেকোনো পাঠককে আন্দোলিত করে। ইন্দির ঠাকুরণের করুণ মৃত্যুও বেদনাদায়ক আবহ তৈরি করে। কিছু কিছু ঘটনার সমাবেশ সমালোচনার জন্ম দিলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিবেচনায় তা ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও চলে। সর্বপরী উপন্যাসটি দারুণ। সহজ-সরল ভাষায়, সহজ-সরল শব্দের ব্যবহার আর সর্বপরী সহজ-সরল মানুষের প্রতিকৃতির উপস্থিতি সহজ-সরল পাঠকের অন্তরে, সহজ-সরল ভাবের ই উদ্রেক করে।

অপরাজিত_পথের পাঁচালি’র দ্বিতীয় খণ্ড হিসেবে অনেকেই মনে করে। অবশ্য এ ব্যাপারে স্বয়ং লেখকও কিছু বলে যাননি। তারপরেও উপন্যাসে ঘটনার ক্রমনুসারতা, চরিত্রের উপস্থিতি তারই ইঙ্গিত দেয়। আমাদের পথের পাঁচালির ছোট অপুর বড় হয়ে ওঠার কাহিনিই বর্ণিত হয়েছে এখানে। আর লেখক আমাদের অপুদাকে বড় করানোর জন্য জাদুর শহর কলকাতায় নিয়ে আসলেন। মেধাবি অপুর জীবনের তাৎপর্য দিনগুলো কাটে এই শহরেই। ছাত্রাবস্থায় নিদারুণ কষ্টে, দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত আমাদের অপুদা হার মানেনি। কৈশোরের উষালগ্নে মা সর্বজায়াকে হারালো, বন্ধুর সাথে আমাদের এখনকার বাংলাদেশের অঞ্চলে বেড়াতে এসে অপর্ণার সাথে দৈবক্রমে পরিণয়সূত্রে গ্রথিত হওয়া, লীলার প্রতি এক ধরণের অবুঝ ভালোবাসার সর্বক্ষণ উপস্থিতি, চাকরির তদবিরে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ, বিপত্নীক হওয়া আর শেষে শিশুকালের সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে পৃথিবীর পথে নামা ইত্যাদী ঘটনা গুলো স্থবিরতার চেয়ে জঙ্গমশীলতা পাঠকের মনে এনে দেয় বলে রাগ-বিরাগের মাত্রা কমিয়ে অনুরাগের পরিমাণটা বাড়িয়ে বাধ্য করে পুরোটা পড়তে। অশনী সংকেত _দুর্ভিক্ষের অত্যাসন্ন বিভীষিকারই সংকেত বহন করে। পণ্ডিত গঙ্গারাম আর তার ব্রাহ্মণবধূ ব্রাহ্মণী অনঙ্গবউয়ের চরিত্র নিমিষেই নজর কাড়ে। সাথে প্রাচীন হিংস্রতার চরিত্রবেশি কয়েকজনের সাক্ষাৎও পাওয়া যায়। দারিদ্র্যের তথা আসন্ন দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে, সমাজের গতিত্বের কাছে সতিত্বকে বিকিয়ে দিতে গিয়েও বারংবার মনে হয়েছে নিজধর্মের কথা, নিজ নৈতিকতার কথা। কিন্তু যে পেটে সন্তান ধরে সে পেট কি আর অল্পে ভরে বা সতিত্ব না থাকলেও যদি অনাহারে থাকার থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তাতে মন্দ কি? তাই বাঁচার প্রশ্ন আগে।

কিন্নর দল, মেঘমল্লার, মৌরীফুল বা যাত্রাবদল গল্পের অসাধারণ ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি মানব মনের ওপর রেখাপাত করে। চারটি গল্পের মধ্যেই মানবিক সম্পর্কের উপর জোর দেখা যাচ্ছে। কিন্নর দলের শহুরে নায়িকার গ্রামের স্বামীর বাড়িতে এসে সমস্ত গ্রামটাকেই কেমন পাল্টে দিল। যেখানে নারীরা লাঞ্ছিত, বঞ্চিত সেখানে তার আর্বিভাব সবার মধ্যে আবার নতুন করে বাঁচার অনুভূতির আশা জাগায়। মেঘমল্লারে একটু অতিভৌতিক কাহিনির অবতারণা করলেও শেষে মূলতত্ত্ব সেই মানবিকতার উপরই নির্দেশ দেয়। মৌরীফুলে তদ্রুপই। আর যাত্রাবদলেও তার ভিন্ন নয়। তবে চারটি গল্পেই লেখক মূল চরিত্রগুলোর সমাপ্তি টেনেছেন খুব করুণ ভাবে। অর্থাৎ সবগুলো চরিত্রই মারা গেছে ঘটনার শেষে। এই যে মারা যাওয়াটা _সেটাকে নেহাত ই আত্নাহীন শবের উপমায় লেখক চিত্রিত করেননি। বরং পরিবর্তনের মূল প্রোটাগনিস্ট হিসেবে তিনি সেসব চরিত্রের অবতারণা করেছেন। আক্ষেপ যদি ছোটগল্পের মূল বৈশিষ্ট্যের একটি হয়ে থাকে সেখানে রবীন্দ্রনাথের পরে এর সফল ব্যবহার মনে হয় বিভূতিভূষণই করেছেন। যেখানে পাঠকের অতৃপ্ত বাসনার যথার্থ সুরাহা হয়নি।

সর্বপরী বলা যায় বিভূতিভূষণের সাহিত্যকর্ম মানবিকতাকে পাশ কাটিয়ে এর বিপরীত অর্থাৎ অমানবিকতার স্পর্শ অতটাও পায়নি যাতে করে পাঠকের মনে সস্তামার্কা বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট তৈরি করে। বরং সহজ-সরল আবেগ-অনুভূতি, অপরিণত সময়ে ঘটনা-চরিত্রের পরিবর্তন সেটা অবশ্যই বলাতে বাধ্য করে_ইস্ যদি এমন না হতো!!!