বাঙালি ভাবধারায় বিশ্বাসের চেয়ে অবিশ্বাস স্থাপনকারী, পাশ্চাত্যের প্রোগেসিভ চিন্তাচেতনায় অনুসরণকারী-অনুকরণকারী একদল মানুষকে তৎকালীন সময়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী’ হিসেবে। বেঙ্গল-বাঙ্গাল-বঙ্গ_যেটা হিসেবেই উল্লেখ করা হোক না কেন ঐ সময়ের পরিপেক্ষিতে এখানকার ভূখণ্ডে অখণ্ডতা না থাকলেও কতিপয় শিক্ষিতদের মাঝে যে বিখণ্ডায়ন শুরু হয়ে গিয়ে, সমাজে একটা যারপরনাই বিভাজন তৈরি করে ফেলেছিল তাতে সন্দেহ পোষণ করতে গেলে, নেহাতই বেগের চেয়ে আবেগে বশিভূত হলে যেমন হয় বা বলতে পারি_জেদের বশে গোয়ার্তমি করলে সেটা হাস্যকর-লাস্যকর বলে সুধীমহলে ঠেকে_সেটাই আর কি! পুরাকালের পুরাকীর্তি, ইতিহাসে যার উপস্থিতি_সেটাকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বা রাখঢাক রেখে বাজিয়ে হয়ত বর্তমান কালে জাহির করার মধ্যে বিশেষ কোনো লাভ নেই, তবে সেটার মূল্য বিচারে কৃপণতা করতে গেলে নিজেকেই মনে হয় ছোট করা হয়। কথাচ্ছলে বলা যেতে পারে_ইতিহাস লালন করা যায়, তা হয়ত শখের বশে পালনও করা যায় তবে বাস্তবতার নিরীকে সেটা ধারণ করাটা বোকামির কাজ হবে।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনকাহিনী বোধহয় আর নতুন করে বলার কিছু নেই। সচরাচর যা হয়ে থাকে মাইকেল মধুসূদন সেটার প্রতিনিধিত্ব করে বা মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনেকটা অলীকের হাতছানি’তে আসক্ত হয়ে, নিজেকে পাশ্চাত্যের রঙে-ঢঙে উপস্থাপনে আসত্তি জন্মিয়ে এক নতুনতর ব্যক্তি হিসেবে নিজের কায়া বদলাতে সচেষ্ট হতে চেয়েছিলেন_এটা সবার জানা কথা। শুধু মধুসূদন কেন? ঐ সময়কার আরো অনেকজন এমন হতে চেয়েছেন_যাদের মধ্যে কতিপয় যেমন সফল হতে পেরেছিলেন, ব্যর্থতার দিক দিয়েও ইতিহাসে অনেকের মোলাকাত মিলে। হয়ত নতুনকে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছায় পুরাতন ধ্যান-ধারণা পাল্টিয়ে নিজেকে নতুন ভাবে, নতুন পরিবেশে অভিযোজনের মাধ্যমে অভিযোজিত করতে অনেকেই রুপকথা’র সাতসমুদ্র-তেরো নদী’র জলসীমা-স্থলসীমা পেড়িয়ে নতুন একটা সমাজ তথা_তার সার্বিক ব্যবস্থাতে যৌক্তিকতা সম্পূর্ণ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা আলোকিত হয়ে কেউ কেউ ফিরে আসলেও, অনেকে থেকে গিয়েছিল। তবে যারা এসেছিল তাদের পূর্ববর্ণিত ইচ্ছা-আকাঙ্খায় ভরসাম্যতা বা চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সামঞ্জস্যতা না আসাতে তাদেরকে আবার ফিরে যেতেও দেখা গিয়েছে। কেউ কেউ নিজ নিজ সমাজকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে সমালোচিত যেমন করেছে তেমনিভাবে সে সমাজের শতাব্দী প্রাচীন স্থাবরতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বাদ-বিবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে।

ছোটবেলা থেকে মনের কোণে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করার অদম্য ইচ্ছায়, সামাজিক শৃঙ্খলকে পায়ে মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াটা অবশ্য অতটা বন্ধুর ছিল না। তবে লক্ষ্য যখন স্থির/অনড় থাকে তখন মনে হয় কোনো বাধা-বিপত্তি ই সে যাত্রাপথ থেকে ফেরাতে পারে না। অনেকটা ঝোঁকের বশে বা নতুনকে জানার স্পৃহার দিক থেকে তীব্রতর আন্দোলনে ভেসে উঠে, গুণগুণ করে তাড়িত করার প্রেক্ষিতেই প্রথমেই বাঁধা হিসেবে নিজ ধর্মকে ছাড়লেন। অবশ্য সেখানে অন্য আরেকটি’র স্থাপন নেহাতই কোনো বিশেষ দিকের প্রতি নির্দশ দেয়। আরো নানা ঘটনার পট-পরিবর্তনের তথা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মধুসূদনের জীবন হয়ে উঠে_অনেকের চেয়ে অন্যতম হিসেবে। বিদেশ যাত্রা, সেখানে সাহিত্যচর্চা, আর্থিক দৈন্যতা, মানুষিক হীনন্ম্যনতায় জর্জরিত হওয়ার পরবর্তীতে দেশাত্নবোধের আর্বিভাব হওয়া_এখানে অনেকে আপত্তি তুলে থাকেন। যুক্তি হিসেবে তোলে ধরে_যখন মধুসূদনের আশা মাঠে মারা গেল তখন আর অন্য-ভিন্ন পথ না পেয়ে নামেমাত্র দেশাত্নবোধের ফিরিস্তি তুলে ধরে পূর্ব ভুল শোধরাতে অনেকটা ন্যাকাকান্না কাঁদতে বসে, বাংলায় ফিরে এসে অনেকের সেন্টিমেন্ট আদায় করে, রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন! হয়ত ঠিক বা হয়ত নয়। তবে এ কথা মানতেই হবে_মধুসূদনের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যে তথা সামাজিক,সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় বাংলা-বাঙালি’র জীবনে যারপরনাই একটা কাঁপুনি-ঝাকুনি দিয়েছে। আর তাতেই বাজিমাত! এক ধাক্কায় আমরা একটি যুগ অতিক্রম করে আরেকটি নতুন যুগে প্রবেশ করলাম। অবশ্য তাতে যে প্রথমেই সফলতার সাক্ষাৎ মেলে তেমন নয়। যাইহোক, মধুসূদনের বিচিত্র ঘটনা অনেকের ই জানা আছে, তাই সেদিকে না গিয়ে তার সাহিত্যকর্মের দিকে মনোযোগ দেওয়া-ই সমীচীন হবে।

আধুনিক যুগের সাহিত্যের প্রাণপুরুষ অভিধায় অভিষিক্ত, বাংলা নাটকের জনক, প্রহসন নামের সাহিত্যের নতুন এক শাখার সিদ্ধহস্ত পুরুষ, কবিতার বিশেষ ছন্দ হিসেবে পরিচিত_ অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক, প্রথম সার্থক মহাকাব্যের জনক এগুলো যেমন উচ্চারিত হয় মধুসূদনের সাথে, তারথেকেও বড় কথা হল_মধুসূদন প্রথম আধুনিক বাঙালি। বিলাত সফর করে, সেখানে বিশেষ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়া_অবশ্য সেক্ষেত্রে আধুনিকতা বোঝায় না! মধুসূদন আধুনিক তার সৃষ্টিশীল চিন্তাধারায়, মানবতাবোধের ধ্যান-ধারণায় আর সর্বপরী দেশাত্নবোধের প্রথম কারিগর হিসেবে। সেটা হোক পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য বা অন্যকে অনুসরণ-অনুকরণ করার জন্য বা অন্যকোনো অদৃশ্যশক্তি বলে। শতাব্দী প্রাচীন সংস্কারের বিরুদ্ধে মসী চালনা চাট্টেখানি কথা নয়_অন্তত তখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে। সামাজিক বিপ্লব হয়েছে _হয়ত তেমন বলা যাবে না তবে একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে_তা না মানলে বোধহয় সত্যর অপলাপ হবে।

মধুসূদনের অন্যসব সাহিত্যকর্ম নিয়ে কথা বলার আগে তার দুটি প্রহসন নিয়ে কথা বলা অধিক জরুরি। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রো’ বাংলা সাহিত্যের দুটি বিশিষ্ট সৃষ্টিকর্ম। আমরা মাইকেল মধুসূদনকে পাই_অনেকটা জাজমেন্টাল বা বৈচারিক হিসেবে। সবাই জানে মধুসূদন_আধুনিক কবি হওয়ার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন পাশ্চাত্য। সেখানে কতটুকু কবিত্বের সফলতা পেয়েছিলেন সেটা না দেখে তিনি কতটুকু চিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে গড়তে পেরেছিলেন সেটা অধিক বিবেচ্য। যাইহোক, প্রহসন রচনার বেলায় দেখা যায় তার সুনিপুণ সৃজনশীলতা। একেই কি বলে সভ্যতা_ প্রহসনের ঘটনায় দেখা যায়_একদল আধুনিক ভাবধারা সম্পন্ন, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছেলের দলের অন্ধদের মতো, মার্কামারা সভ্যতা-ভব্যতার ট্যাগ লাগিয়ে, যাচ্ছেতাই মদে আসক্ত হয়ে, বাড়ি এসে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে। অধিক ঘাটাঘাটি না করে এর সমাপ্তি এখানেই হওয়া উচিত। মাইকেল তার জীবনে ‘ইয়ংবেঙ্গল গ্রুপের’ সদস্য হিসেবে কতটুকু আত্মত্যাগ করেছিল-তা হয়ত সকলের জানা নেই তবে উপরোক্ত প্রহসনের বেলায় দেখা যায় তার নিরপেক্ষতামূলক উপস্থিতি। তবে সমালোচনাও মনে করি কম হওয়ার কথা নয়। কেননা, একদা বা কোনো এক সময়ে স্বয়ং মধুসূদন_আধুনিক সভ্যতায় শিক্ষিত হওয়ার অদম্য বাসনায়-কামনায় ধর্ম-কর্ম ছেড়ে ছোড়ে, আরেক ধর্মের অনুসারী হয়ে নিজ দেশ ত্যাগ করে পাড়ি দিয়েছিলেন ঐ পাশ্চাত্য নামক জাদুর শহর বলে খ্যাত_তখনকার বিট্রিশদের স্বর্গভূমি ইংল্যান্ডে। সেখানে স্থায়ী হওয়ার সাথে সাথে মজ্জাগত ইচ্ছার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে সদা-সর্বদা যেমন লেগে থেকেছেন তদ্রুপ আধুনিক পশ্চিমের কৃষ্টি-কালচারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে, ভালো-মন্দের ভেদরেখা টেনে একটি সুস্থ-সবল আর্দশিক অবস্থানে আসারও প্রাণান্তকর চেষ্টা তিনি করে গিয়েছিলেন। জানি না কতটুটু সে চেষ্টার প্রতিফলন হয়েছে। তবে তিনি তার নিজ মধ্যে বিল্পব ঘটাতে পেরেছিলেন। এতকাল অবধি সংস্কারের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে একটা গতানুগতিক স্থবিরতায় আটকে থেকে পূর্বতনের দেখানো পথ_শরণ-অনুসরণ করে ইতিহাস-ঐতিহ্যের লালন-পালনকারী রুপে পরিচিতি বজায় রাখলেও এবার তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। সম্ভব হয়ে উঠেনি তা বললে একরোখা হতে বাধ্য তাই বলতে হবে_মধুসূদন সেই পূর্বপুরুষের হালের জোয়াল কাঁধে নিয়ে আর এগুতে চাননি। আর তাই নতুন উদ্যমে নিজ চিন্তা-চেতনার নির্মাণ-বিনির্মাণ করে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। যার দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয় তার রচিত-বিরচিত সাহিত্যকর্মে।

যাইহোক_উপরিউক্ত প্রহসনের বেলায় দেখা যায়_মধুসূদন অনেকটা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে একটা যারপরনাই হেস্তনেস্তে আসতে চেয়েছেন। পাশ্চাত্য সভ্যতা, তার সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে এদেশীয়দের অজ্ঞতা-অজ্ঞনতা ইত্যাদী দূর করতে সামাজিক কর্মী হিসেবে মাইকেল কাজ করেছেন_এটা বললে সত্যর একটু পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। অনেকের মনে হয়ত প্রশ্ন জাগতে পারে, আর সেটা জাগাটাও অমূলক নয়। সভ্যতার প্রাথমিক নির্মাণ তথা পরবর্তীতে তার বিনির্মাণ ইত্যাদীতে এগিয়ে ছিল বললে ভুল হবে_কারণ এখনো আছে_ পশ্চিমের অধিবাসীরা-ই অগ্রগণ্য এটা মানা কষ্টকর নয়। এখন সেটা কতটুকু যৌক্তিতাপূর্ণ, মূল্যবোধের দিক দিয়ে তাদের মধ্য কি পরিমাণ গ্রহণযোগ্যতা আছে সেটাও তাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতার উপরে নির্ভরশীল। তাই যেটা তাদের জন্য, তাদের সমাজের প্রেক্ষিতে ভদ্রতা-সভ্যতার নির্ণায়ক বা মানদণ্ড ঠিক বিপরীতভাবে সেটা অন্যকোনো সমাজ তথা ঐ সমাজের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার দিক দিয়ে ঘাটতি বা ততটাই অসভ্যতাপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তাই এই আপেক্ষিক বিষয় নিয়ে খাটাখাটি-ঘাটাঘাটি না করাটাই সমীচীন হবে। প্রহসনের নামানুসারে বলতে গেলে_মধুসূদন সভ্যতা বলতে তথাকথিত ঐ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে মূল কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি ভারতীয় সভ্যতার সাথে পাশ্চ্যত্য সভ্যতার মধ্যকার একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক যে আছে সেটাকে খানিকটা রাগের বশেই তুলে ধরেছেন তার প্রহসনে। সভ্যতাকে নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, সভ্যতার বৈধতা তথা তার প্রতি সমাজের মানুষের গ্রহণযোগ্যতার দিকটির প্রতি তীক্ষ্ণবাণ আরোপ করে, এক সময়কার নিজের ভুলের শোধরানোর প্রতিশোধ নিয়েছেন বলে আমার মনে হয়_প্রহসনটি পড়ার সময়ে। তিনি ভারতীয় শতাব্দীপ্রাচীণ মানুষের, ঘুণেধরা সংস্কারের দোহাই টেনেছেন অনেকটা পক্ষপাতিত্বের সাথে। যত দোষ নন্দ ঘোষ_বলে বাংলায় যে বিশিষ্ট প্রবাদ আছে তারই বাস্তব প্রতিফলন _মধুসূদনের এই প্রহসনে সাক্ষাৎ মেলে। মদ খেয়ে মাথা বিগড়ালে তাতে দোষ কার_ঐ পাশ্চ্যত্য সভ্যতার নাকি_যে সঠিক পরিমাণ না খেয়ে বেঠিক খেয়ে উল্টাপাল্টা কাজকর্ম করা শুরু করেছে তার? কারণ যাই হোক না কেন এক্ষেত্রে মধুসূদনকে খানিকটা সংস্কারবাদী ব্যক্তি হিসেবে আমার মনে হয়েছে। পশ্চিমের প্রতি এদেশীয়দের একটা সংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব সবসময়ই বিরাজ করে। নতুনকে সহযে গ্রহণ করার প্রতি আমাদের অনীহা_ সেটা নতুন নয়। হয়ত প্রহসনে মধুসূদন সেই সহযে গ্রহণ না করার প্রতি বিরাগের কারণ বা পূর্ববর্তী ধারণার মূলে আঘাত করেছেন। তিনি যেহেতু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলেন তাই ভালো-মন্দের ব্যাপারে তথা আসল-নকলের বিষয়ে তিনি সিদ্বহস্ত ছিলেন বলেই প্রহসনকে একরকম অস্ত্ররূপে ব্যবহার করেছেন। যাইহোক, এটা এখানেই সমাপ্ত করা উচিত।

‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসন পূর্ববর্তী থেকে ভিন্ন। কেননা, এখানে এরকম কোনো বিশেষ দিকের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। সচরাচর সামাজিক অসঙ্গতি আর অনাচারের কারণে বিচার যখন নিভৃতে কেঁদে মরে তখন হয়ত অন্যায়-অবিচারের মাত্রা, লোভ-লালসা বেড়ে যায়, ক্ষমতার দাপটের জন্য সর্বদা তটস্থ থাকতে হয় নিম্নতম শ্রেণীকে, তবে এটাকেই দৈববাণী হিসেবে সমাজের কতিপয় সাহসীরা মানতে নারাজ। তারা তাদের সবটা দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যায় তথাকথিত ঐ ক্ষমতাধারী’র বিরুদ্ধে। সফল হয়ত অনেকক্ষেত্রই হয় না তবে বিফল হলেও তার একটা যথোপযুক্ত চিহ্ন রেখে যায়। যাতে পরের প্রজন্ম শিক্ষা নিতে পারে। উপরোক্ত প্রহসনে তেমন একটা বিদ্রোহীমূলক ঘটনার সাক্ষাৎ মেলে। কামনা-বাসনার চরিত্রকে চরিতার্থ করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হওয়ার ফলে একটা হাস্যরসাত্নক আবহ _নাট্যকার তৈরি করেছেন। এরকম ঘটনার অনেক উদাহরণ আমাদের সমাজে দেখা যায়।

নাটক রচনার ক্ষেত্রেও মধুসূদন প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এতকাল অবধি যে নাটকগুলো রচিত হয়েছে_সেখানে নাটকের যেসব গুণগুলো অত্যাবশ্যক থাকার কথা সেগুলোর অনুপস্থিতির কারণেই যথার্থভাবে নাটক হওয়ার মর্যাদা পায়নি। কিন্তু মধুসূদন সে প্রথা ভেঙ্গে দেওয়ার পাশাপাশি, নতুন প্রথা, নতুন রীতিনীতি’র সংযুক্তির মাধ্যমে এক সৃষ্টিশীলতার জন্ম দিলেন। মায়া-কানন, পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী আর শর্মিষ্ঠা_নাটকগুলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে তাতে সন্দেহ নেই। নাটকগুলোর কাহিনি তেমন মৌলিকতা সম্পন্ন না হলেও এ কথা বলতে দ্বিধা নেই _মধুসূদন নতুন করে সেগুলো, সেসব কাহিনি গুলোর বিনির্মাণ করেছেন। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি’র অবতারণা বিরক্তির উদ্রেক করেনি বরং নাট্যকারের হাতের ছোঁয়ায় তা বিশিষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে বলেই বিভিন্ন শাখার প্রবর্তক হিসেবে মধুসূদন স্মরিত-বরিত।

সর্বশেষে মধুসূদনের শ্রেষ্ঠকর্ম ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্য নিয়ে না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বাঙালি রেনেসাঁ যে ইউরোপীয় রেনেসাঁ থেকে অনেক পরে হয়েছিল_সেটা আর নতুন করে বলবার অপেক্ষা রাখে না। ধ্রুপদী সাহিত্য রচিত হয়ে আসছিল এতকাল অবধি। মানুষের স্থবিরতা, তাদের চিন্তার কূপমণ্ডূকতা, পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্য একটা শুনশান অবস্থায় মধুসূদনের আবির্ভাব। দেবদেবী, পয়গম্বর তথা অশরীরীদের অতিভৌতিক রচনায় মানুষ মজেছিল অনেককাল। যার কারণে নিজ জীবন সম্পর্কে, নিজ কীর্তি সম্পর্কে ততটাই অনীহা আর অজ্ঞতার দরুণ নতুনকে পাওয়ার, সেলক্ষ্য এগিয়ে যাওয়ার শক্তি-সাহসের ঘাটতিতে পড়ে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেওয়াতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। মধুসূদন সেটাতে আঘাত হানলেন। মানব-মানবিকে স্থান দিলেন কল্পিত চরিত্রের জায়গায়। মানুষের আশা-আকাঙ্খার, তার চাওয়া-পাওয়ার, দুঃখ-বেদনার ভীত হিসেবে একাধিক প্লটের আশ্রয় নিলেন। তাতে তিনি সফলও হলেন। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে মেঘনাদ বধ কাব্যর কথা বলা যায়। পৌরাণিক কাহিনিতে দেব-দেবীদের মাহাত্য আছে, তারা সকল কিছুর ঊর্ধ্বে, পাপ-পঙ্কিলতা তাদের ছুঁতে পারে না। তবে মর্ত্যের মানব সন্তানদের সবকিছুই আছে। তাই রেনেসাঁর মূলকেন্দ্র হিসেবে মহাকাব্যের চরিত্র হিসেবে তিনি মানব-মানবিকে বেছে নিলেন। তারা সৃষ্ট_ স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ, আনুগত্যবোধ তাদের থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর যদি উল্টো দেখা যায় তখন ব্যাপারটা কেমন দেখায়? সেই দেখানোর কাজটিই মধুসূদন তার মহাকাব্য করেছেন। রাক্ষসদের নায়ক রুপে রুপায়িত করে, আর দেবতাদের তার বিপরীত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যাইহোক, ন্যায়যুদ্ধ বলে কথিত সেই যুদ্ধে দেবতা বনাম মানব সন্তান বা রাক্ষসদের অসম লড়াই। রাক্ষসরাজ রাবণ, তার ভাই বিভীষণ, বীরবাহু, প্রমীলা, মন্দোদরী আর মেঘনাদ একদিকে আর অন্যদিকে রাম, লক্ষণ, সীতাসহ কতিপয় দেবতার জোট। দেবতাদের মধ্যে যেমন ডিভিশন বা বিভাজন আছে তদ্রুপ তাদের মধ্যকার পারস্পারিক দ্বন্দ্ব-ধন্দ্বের কারণেও সেই যুদ্ধে রাক্ষসরা হেরেছে। নানা ঘটনার সম্মীলনে মধুসূদন তার মহাকাব্য লিখেছেন। পড়ার সময়ে মনে হয়েছে_পুরাতনকে তিনি নতুন করে নিমার্ণ করেছেন। এরকম বাস্তবতার সম্মুখীন আমরা আমাদের জীবনে হয়ত একাধিকবার হয়েছি। কি রাজনৈতিক চাল, কি জোরের জবরদস্তিমূলক ব্যবহার_ ইত্যাদী ঘটনা পুরো কাহিনিকে চিত্তাকর্ষক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। আরো নানা রচনা মধুসূদনের প্রতিভাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে পৌছে দিতে সহায়তা করে তা আর নতুন করে বলা নিরর্থক।

পরিশেষে শুধু বলা যায়_মধুসূদনের আবির্ভাব বাংলা, বাঙালি সাহিত্যের এক বিপ্লব হিসেবেই বলা যায়। নতুনকে সাদরে গ্রহণ করে, পুরাতন জঙ্গমহীনতাকে বাদ দিয়ে, একটা নতুন সমাজ বিনির্মাণে যথার্থই প্রভাব ফেলেছে। দেশপ্রেম, সংস্কৃতিপ্রেম যেমন ছিল তারথেকেও বড় কথা মধুসূদনের মাঝে মানবপ্রেমের সুমহান উপস্থিতি ছিল। হয়ত মাঝের ঘটনাগুলো মধুসূদন সম্পর্কে একটু বিরক্তির জন্ম দিতে পারে তবে সেটাকে বৃহত্তর ঘটনার স্বার্থে নেহাতই দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়াটাই ভালো হবে। তাই বলা যায়_মধুসূদনের সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন ততদিন, যতদিন বাঙালি পাঠক বেঁচে থাকবে। (সমাপ্ত)

বি.দ্র._ পুরোটাই ব্যক্তিগত মন্তব্য-উপলব্ধি। তাই যথোপযুক্ত সমালোচনা একান্ত কাম্য।