উত্তর ইউরোপের ভাইকিংরা বিশ্বে দুর্ধর্ষ জলদস্যু হিসেবেই বেশী পরিচিত। দ্রুততম জলযান ব্যবহার করে তারা অভিযানে যেত বিভিন্ন অঞ্চলে, লুট করে আনতো সম্পদ। ঐতিহাসিকদের মতে, সপ্তম এবং দশম শতাব্দীর মধ্যে স্ক্যান্ডিনেভিয়া (সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক) থেকে বাল্টিক এবং কৃষ্ণ সাগরের মধ্যবর্তী ইউরোপে বসবাসকারী জলদস্যুরাই ভাইকিং। এদের বিস্তৃতি শুধু স্ক্যান্ডিনেভিয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ভাইকিংদের আবাসভূমি ছিল রাশিয়া, ইউক্রেন এবং আয়ারল্যান্ডেও। এরা ছিল অত্যন্ত দক্ষ নাবিক এবং সাহসী যোদ্ধা। ভাইকিংদের ছিল তুলনামূলকভাবে উন্নতমানের নৌযান। তাদের চারণভূমি সাধারণত জলপথে। তারা বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো নদী-সাগর-মহাসাগরে। জলই ছিল তাদের খেলাঘর। নবম শতাব্দীতে ভাইকিংদের সাথে প্রথম যোগাযোগ হয়েছিল উত্তর ইউরোপের আন্দালুসিয়ার মুসলমান জনগোষ্ঠীর সাথে। এই দুই জনগোষ্ঠীর সামাজিক কাঠামো, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং ভৌগোলিক অবস্থান ছিল পারস্পারিক বিপরীতমুখী। তাদের মননের বৈশিষ্ট্য ছিল একে অপরের থেকে একেবারেই ভিন্ন। ভাইকিং এবং মুসলমানদের সব কিছুই দুই মেরুর হলে কি হবে, যোগাযোগ এদের হয়েছিল ঠিকই। শুরুটি ছিল কিন্তু সংঘর্ষ, হত্যা এবং লুটপাটের মধ্যে দিয়ে। আর সমাপনী হয়েছিল বাণিজ্যিক সম্পর্ক  দিয়ে। এই বিষয়টি নিয়েই আংশিকভাবে খুলেছি আজকের ইতিহাসের ডালা। একটু  উঁকি দিয়ে দেখিই না, কি আছে এতে!

৮৪৪ সালে ভাইকিংরা স্পেনের আন্দালুসিয়ান শহর সেভিলে (Seville, পুরোনো নাম Išbīliya) মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপর করে আক্রমণ। ঐ সময় সেভিল ছিল কর্ডোভার উমাইয়া সাম্রাজ্যের একটি শহর। শহরটিতে কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একেবারেই ছিল না। উমাইয়ারা ভেবেছিলো, সেভিলের পশ্চিমে যেহেতু খোলা মহাসাগর আটলান্টিক, কে আর আসবে মহাসাগর থেকে সেভিল আক্রমণ করতে। তারা জানতো না যে, ভাইকিংদের কাছে মহাসাগর ছিল মহাসড়কের মতো। ভাইকিংরা ৮৪৪ সালের সেভিল অভিযানের আগেও নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে আস্তুরিয়াস (Asturias) রাজ্যে ছোট ছোট দলে প্রায়ই আক্রমণ করে লুটপাট করতো স্থানীয় সম্পদ। স্পেন এবং পর্তুগালের পশ্চিম উপকূলে অভিযান চালানোর পর, একটি বিশাল ভাইকিং নৌবহর ২৫শে সেপ্টেম্বর গুয়াদালকুইভির (Guadalquivir) হয়ে সেভিল পৌঁছে। ৮৪৪ সালের ১ম অথবা ৩রা অক্টোবর শহরটি দখল করে ফেলে ভাইকিংরা। তারপর শহরটিতে সাত দিন ধরে চলে নির্বিচারে হত্যা এবং লুটপাট। নারী-শিশুদের বন্দী করে দাস করে নিয়ে যায় সাথে করে। এই হত্যাকাণ্ড এবং লুণ্ঠনে বিচলিত হয়ে পড়ে কর্ডোবার উমাইয়া আমির আবদ-আর-রহমান দ্বিতীয়। সময় ব্যয় না করে তিনি দ্রুত তার প্রধানমন্ত্রী হাজিব ঈসা ইবনে সোহায়দের নেতৃত্বে ভাইকিংদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী। একের পর এক ভাইকিংদের উপর বিরামহীন আক্রমণের পর, উমাইয়া বাহিনী নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে ভাইকিংদের হটিয়ে সেভিল পুনরায় দখল করে নেয়। ভাইকিংরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় স্পেনের আন্দালুসিয়া থেকে।

ভাইকিংদের কবর থেকে উদ্ধার করা সরঞ্জামগুলোতে ‘আল্লাহ’ ‘আলী’ ইত্যাদি শব্দ লেখা বা আঁকা রয়েছে।; Source: BBC

ঐ প্রতিরোধে সাফল্যের পর, মুসলমানরা গড়ে তোলে আরো চৌকষ নৌবাহিনী এবং উপকূল রক্ষার জন্য নির্মাণ করে শহর প্রতিরোধের উঁচু প্রাচীর, উন্নতমানের যুদ্ধ-জাহাজ এবং সামরিক সরঞ্জাম। ভাইকিং আক্রমণে সেভিল শহর এবং এর আশেপাশের শহরতলী পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। সেভিলের ভাইকিং-সৃষ্ট হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ আন্দালুসিয়া এলাকার জনগণকে করেছিল আতঙ্কিত। খলিফা আব্দ-রহমান সেভিলে গড়ে তোলেন একটি বিশাল অস্ত্রাগার (দার আল-সিনা’আ) এবং অস্ত্র তৈরির কারখানা। সাথে চললো নাবিক এবং সৈন্যদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। ভাইকিংদের ভবিষ্যত আক্রমণ পরিকল্পনার তথ্য আগে থেকেই জানার জন্য উদ্ভাবন করেন জলপথের বার্তাবাহক নেটওয়ার্ক (Sea monitoring network)। সুপরিকল্পিত এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো পরবর্তীতে ৮৫৯ এবং ১০০৮ সালে ভাইকিংদের স্পেন অভিযানকে করে চরমভাবে ব্যর্থ। ৮৪৪ সালে ভাইকিংদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের নেয়া দ্রুত সামরিক সিদ্ধান্ত, তাদেরকে আন্দালুসিয়া থেকে বিতাড়িত করা এবং পরবর্তীতে শক্তিশালী নৌ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ভাইকিংরা স্পেনের আন্দালুসিয়া আক্রমণে হয়ে পড়ে সাময়িকভাবে নিরুৎসাহিত।

একাদশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ ইবনে আল হাইয়ানের (Ibn Hayyan al-Qurtubi) বর্ণনায়, সেভিল আক্রমণের আরও পনেরো বছর পর, ৮৫৯ সালে ভাইকিংরা আবারো ফিরে আসে মুসলমান অধ্যূষিত স্পেনের আন্দালুসিয়া আক্রমণ করতে। তারা জিব্রাল্টাল জলপথ দিয়ে আক্রমণ করে মরোক্কো। বন্দী করে নিয়ে যায় কিছু নাগরিককে। ভাইকিংরা ৮৫৯ থেকে ৮৬১ সাল, প্রায় তিন বছর বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় আন্দালুসিয়ায় প্রবেশ করতে। অভিযানে সফলতা না পেয়ে  ভাইকিংরা শুরু করে মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দী মুক্তি এবং দাস বেচা-কেনা। শেষে আবারো হতাশ হয়ে ৮৬১ সালে ফিরে যায় ভাইকিংরা উত্তর ইউরোপে। পর্তুগীজ ইতিহাস Lusitano Chronicle থেকে জানা যায়, ভাইকিংরা তৃতীয় এবং শেষবারের মতো আন্দালুসিয়া জয়ের চেষ্টা করে ১০০৮ থেকে ১০১৬ সালের মধ্যে, কিন্তু সাফল্য আসেনি তখনও।

যদিও ভাইকিংদের সাথে মুসলমানদের প্রথম বড় রকমের যোগাযোগ ঘটে ৮৪৪ সালে সেভিল আক্রমণ এবং পাল্টা প্রতিহতের মধ্য দিয়ে, পরবর্তীতে ঐ সংঘর্ষ রূপান্তরিত হয় কূটনৈতিক সম্পর্কে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইবনে দিহিয়ার (Ibn Diḥya) বর্ণনায় দেখা যায়, ৮৪৪ সালে পরাজয়ের পর, ভাইকিংরা খলিফা আবদ আর-রহমান দ্বিতীয়র দরবারে একটি দূত পাঠায় উমাইয়াদের সম্পর্কে জানার জন্য। খলিফা তখন কবি ইয়াহিয়া ইবনে আল-হাকামকে (আল-গজল, “দ্য গেজেল”) আয়ারল্যান্ড ভাইকিংদের কাছে দূত হিসেবে পাঠান। উদ্দেশ্য, ভাইকিংদের সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত জানা, তাদের স্পেন আক্রমের পরিকল্পনা আগাম আঁচ করা এবং ভাইকিংদের হাতে আন্দালুসিয়ার মুসলমান বন্দীদের মুক্ত করা।

৮৫৯ সালে ভাইকিংদের দ্বিতীয় আক্রমণের পর, দশম শতাব্দীতে হিস্পানিক-আরব বণিক, ইব্রাহিম ইবনে ইয়াকুব আল-তারতুশি স্লেসউইগের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বাণিজ্য শহর হেডেবিতে (Hedeby) গিয়েছিলেন ভাইকিংদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ততদিনে আন্দালুসিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে যায় আব্বাসীয়দের হাতে। আব্বাসীয়া সাম্রাজ্যের খলিফা আল-মুক্তাদির ৯২১ সালে বাগদাদ থেকে আরব পর্যটক ইবনে ফাদলানকে পাঠান উত্তর ইউরোপে ভাইকিংদের কাছে। ইবনে আল ফাদলান ভলগা নদীর উপরের দিকে ভাইকিং ব্যবসায়ীদের একটি দলের সাথে সাক্ষাত করেন। তার ভ্রমণ প্রতিবেদনে তিনি ভাইকিং রীতিনীতি, পোশাক, আচার-আচরণ, ধর্ম এবং যৌন চর্চা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সেই সাথে ভাইকিং সমাজে নৌযানের উপর কিভাবে মৃত ব্যক্তির সৎকার করা হয়, কেমন করে মৃত ব্যক্তির স্ত্রীর সহমরণের ব্যবস্থা করা হয়, তা প্রত্যক্ষ করেন নিজেই। ইবনে ফাদলান এই ভাইকিং জনগোষ্ঠীকে “রুশ (Rus)” নামে আখ্যায়িত করেন।  ধারণা করা হয়, “রাশিয়া” শব্দটি সরাসরি “রুশ” থেকেই ক্রমশ বিবর্তিত হয়েছে। ইবনে ফাদলানের বর্ণনায় আরও জানা যায় যে, ভাইকিংরা ইবনে ফাদলানের প্রতি ছিল খুবই সদয়, যদিও ভাইকিং-রাজা অজানা কারণে তার প্রতি ছিল অসন্তুষ্ট। তার ধারণা, দক্ষিণ ইউরোপ থেকে আসা আরব বণিকদের প্রতি ভাইকিংদের আচরণ ছিল লক্ষণীয়ভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ।

উদ্ধার করা কাপড়ের প্যাটার্ন গবেষণার সময় দেখা যায় আয়নাতে ধরলে আরবী শব্দগুলো দেখা যাচ্ছে; Source: BBC

দশম এবং একাদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ইউরোপের মুসলমানদের সাথে উত্তর ইউরোপের ভাইকিংদের শুরু হয় ছোট ছোট বাণিজ্য। ভাইকিং এবং মুসলমান বণিকরা একসাথে “ভোলগা ট্রেড রুটের” অংশ হিসাবে আজকের ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ (Kiev) এবং নোভগোরোডে (Novgorod) বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। রাশিয়ার নোভগোরোডের রাজা ওলেগ ছিলেন একজন ভাইকিং শাসক, যিনি স্পেনের আন্দালুসিয়াতেও ভ্রমণে গিয়েছিলেন একসময়। আরব রৌপ্য মুদ্রা দিরহামের প্রতি ভাইকিংদের ছিল অদম্য আগ্রহ। তাই একাদশ এবং দ্বাদশ শতকের মধ্যে ভাইকিংদের ইয়র্ক (York) এবং ডাবলিনে (Dublin) দিরহাম হয়ে পড়ে অতি প্রচলিত এক মুদ্রা। আল-মাসুদির এক বিবরণে দেখা যায়, উত্তর ইউরোপে ভ্রমণকারী মুসলমান বণিকেরা ভাইকিংদের হাতে তৈরী কালো নেকড়ের চামড়ার টুপি, পশমী বস্ত্র এবং চামড়ার কোট কেনায় ছিল বেশী আগ্রহী। এগুলো ভাইকিংদের তৈরী চামড়া এবং পশম সামগ্রীর মধ্যে ছিল সবচেয়ে মূল্যবান। অন্যদিকে, ভাইকিংদের চাহিদা ছিল আরব সাম্রাজ্যের স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা, অলংকার সামগ্রী এবং সিল্কের বস্ত্র। নরওয়ে এবং সুইডেন থেকে আবিষ্কৃত প্রত্নত্বাত্তিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, ভাইকিংরা দক্ষিণ ইউরোপ থেকে তথা মুসলিম বণিকদের কাছে বস্ত্র, অলংকার, মুদ্রা এবং ধাতব বস্তুর বিনিময়ে মধু, পশুর দাঁত, চামড়া এবং পশমী সামগ্রী বিক্রি করতো।

এদিকে উত্তর ইউরোপ এবং অন্যান্য অঞ্চলে বারবার পরাজয়ে হতাশ হয়ে বেশীরভাগ ভাইকিং খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং অনেকেই চলে যায় ফ্রান্সে। একাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরেশিয়ায় তুর্কি উপজাতিদের মধ্যে ইসলামের প্রসার এবং বাল্টিক সাগর, নরওয়ে, সুইডেনের চারপাশে খ্রীষ্টধর্মের সমসাময়িক বিস্তারের সাথে সাথে, ভাইকিংরা তাদের চিরাচরিত পৌত্তলিক বিশ্বাসের শিকড় থেকে বের হয়ে খ্রীষ্ট ধর্মের দিকে আগ্রহী হয়ে পড়ে। পারস্য পণ্ডিত শরফ আল-জামান মারওয়াজি একটি উদাহরণ লিপিবদ্ধ করে তার বর্ণনায় দেখিয়েছেন, একদল ভাইকিং খ্রীষ্টান উগ্রপন্থীদের বাড়াবাড়িতে অসন্তুষ্ট হয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। পরবর্তীতে আরও জানা যায় যে, কিছু ভাইকিং স্পেনের জলসীমানায় যুদ্ধে পরাজয়ের পর আন্দালুস এলাকায় বসতি স্থাপন করতে থাকে স্থায়ীভাবে। ইতিহাসবিদ ওমর মুবাইদিনের নিবন্ধে বলা হয়েছে, ভাইকিংরা আইবেরিয়ান উপদ্বীপে (দক্ষিণ ইউরোপ) মুসলমান ও খ্রীস্টান উভয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযান চালায়। অবশেষে, ভাইকিংদের ক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায় এসব অভিযানে বারবার পরাজয়ে হতাশ হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব সেভিলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করে। এই ইসলামগ্রহণকারী ছোট ভাইকিং সম্প্রদায়টি কর্ডোবা এবং সেভিলে পনির তৈরী এবং সরবরাহের জন্য ছিল অত্যন্ত বিখ্যাত। অ্যান্ড্রু মার (Andrew Marr) ২০১২ সালে তার বিবিসি ডকুমেন্টারি, “হিস্ট্রি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড: ইনটু দ্য লাইট” এ দেখিয়েছেন, কীভাবে রাশিয়ার ভাইকিংরা ইসলাম গ্রহণের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল।

একাদশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ ইবনে আল হাইয়ানের (Ibn Hayyan al-Qurtubi) বর্ণনায়, সেভিল আক্রমণের আরও পনেরো বছর পর, ৮৫৯ সালে ভাইকিংরা আবারো ফিরে আসে মুসলমান অধ্যূষিত স্পেনের আন্দালুসিয়া আক্রমণ করতে। তারা জিব্রাল্টাল জলপথ দিয়ে আক্রমণ করে মরোক্কো। বন্দী করে নিয়ে যায় কিছু নাগরিককে। ভাইকিংরা ৮৫৯ থেকে ৮৬১ সাল, প্রায় তিন বছর বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় আন্দালুসিয়ায় প্রবেশ করতে। অভিযানে সফলতা না পেয়ে  ভাইকিংরা শুরু করে মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দী মুক্তি এবং দাস বেচা-কেনা। শেষে আবারো হতাশ হয়ে ৮৬১ সালে ফিরে যায় ভাইকিংরা উত্তর ইউরোপে। পর্তুগীজ ইতিহাস Lusitano Chronicle থেকে জানা যায়, ভাইকিংরা তৃতীয় এবং শেষবারের মতো আন্দালুসিয়া জয়ের চেষ্টা করে ১০০৮ থেকে ১০১৬ সালের মধ্যে, কিন্তু সাফল্য আসেনি তখনও।

২০১৫ সালে উদ্ধার করা ‘ আল্লাহ্‌’ লেখা আংটিটি এখন সুইডিশ হিস্টোরি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। ; Source: BBC

যদিও ভাইকিংদের সাথে মুসলমানদের প্রথম বড় রকমের যোগাযোগ ঘটে ৮৪৪ সালে সেভিল আক্রমণ এবং পাল্টা প্রতিহতের মধ্য দিয়ে, পরবর্তীতে ঐ সংঘর্ষ রূপান্তরিত হয় কূটনৈতিক সম্পর্কে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইবনে দিহিয়ার (Ibn Diḥya) বর্ণনায় দেখা যায়, ৮৪৪ সালে পরাজয়ের পর, ভাইকিংরা খলিফা আবদ আর-রহমান দ্বিতীয়র দরবারে একটি দূত পাঠায় উমাইয়াদের সম্পর্কে জানার জন্য। খলিফা তখন কবি ইয়াহিয়া ইবনে আল-হাকামকে (আল-গজল, “দ্য গেজেল”) আয়ারল্যান্ড ভাইকিংদের কাছে দূত হিসেবে পাঠান। উদ্দেশ্য, ভাইকিংদের সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত জানা, তাদের স্পেন আক্রমের পরিকল্পনা আগাম আঁচ করা এবং ভাইকিংদের হাতে আন্দালুসিয়ার মুসলমান বন্দীদের মুক্ত করা।

৮৫৯ সালে ভাইকিংদের দ্বিতীয় আক্রমণের পর, দশম শতাব্দীতে হিস্পানিক-আরব বণিক, ইব্রাহিম ইবনে ইয়াকুব আল-তারতুশি স্লেসউইগের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বাণিজ্য শহর হেডেবিতে (Hedeby) গিয়েছিলেন ভাইকিংদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ততদিনে আন্দালুসিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে যায় আব্বাসীয়দের হাতে। আব্বাসীয়া সাম্রাজ্যের খলিফা আল-মুক্তাদির ৯২১ সালে বাগদাদ থেকে আরব পর্যটক ইবনে ফাদলানকে পাঠান উত্তর ইউরোপে ভাইকিংদের কাছে। ইবনে আল ফাদলান ভলগা নদীর উপরের দিকে ভাইকিং ব্যবসায়ীদের একটি দলের সাথে সাক্ষাত করেন। তার ভ্রমণ প্রতিবেদনে তিনি ভাইকিং রীতিনীতি, পোশাক, আচার-আচরণ, ধর্ম এবং যৌন চর্চা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সেই সাথে ভাইকিং সমাজে নৌযানের উপর কিভাবে মৃত ব্যক্তির সৎকার করা হয়, কেমন করে মৃত ব্যক্তির স্ত্রীর সহমরণের ব্যবস্থা করা হয়, তা প্রত্যক্ষ করেন নিজেই। ইবনে ফাদলান এই ভাইকিং জনগোষ্ঠীকে “রুশ (Rus)” নামে আখ্যায়িত করেন।  ধারণা করা হয়, “রাশিয়া” শব্দটি সরাসরি “রুশ” থেকেই ক্রমশ বিবর্তিত হয়েছে। ইবনে ফাদলানের বর্ণনায় আরও জানা যায় যে, ভাইকিংরা ইবনে ফাদলানের প্রতি ছিল খুবই সদয়, যদিও ভাইকিং-রাজা অজানা কারণে তার প্রতি ছিল অসন্তুষ্ট। তার ধারণা, দক্ষিণ ইউরোপ থেকে আসা আরব বণিকদের প্রতি ভাইকিংদের আচরণ ছিল লক্ষণীয়ভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ।

ভাইকিং পোশাকে আল্লাহ, Source: BBC

দশম এবং একাদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ইউরোপের মুসলমানদের সাথে উত্তর ইউরোপের ভাইকিংদের শুরু হয় ছোট ছোট বাণিজ্য। ভাইকিং এবং মুসলমান বণিকরা একসাথে “ভোলগা ট্রেড রুটের” অংশ হিসাবে আজকের ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ (Kiev) এবং নোভগোরোডে (Novgorod) বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। রাশিয়ার নোভগোরোডের রাজা ওলেগ ছিলেন একজন ভাইকিং শাসক, যিনি স্পেনের আন্দালুসিয়াতেও ভ্রমণে গিয়েছিলেন একসময়। আরব রৌপ্য মুদ্রা দিরহামের প্রতি ভাইকিংদের ছিল অদম্য আগ্রহ। তাই একাদশ এবং দ্বাদশ শতকের মধ্যে ভাইকিংদের ইয়র্ক (York) এবং ডাবলিনে (Dublin) দিরহাম হয়ে পড়ে অতি প্রচলিত এক মুদ্রা। আল-মাসুদির এক বিবরণে দেখা যায়, উত্তর ইউরোপে ভ্রমণকারী মুসলমান বণিকেরা ভাইকিংদের হাতে তৈরী কালো নেকড়ের চামড়ার টুপি, পশমী বস্ত্র এবং চামড়ার কোট কেনায় ছিল বেশী আগ্রহী। এগুলো ভাইকিংদের তৈরী চামড়া এবং পশম সামগ্রীর মধ্যে ছিল সবচেয়ে মূল্যবান। অন্যদিকে, ভাইকিংদের চাহিদা ছিল আরব সাম্রাজ্যের স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা, অলংকার সামগ্রী এবং সিল্কের বস্ত্র। নরওয়ে এবং সুইডেন থেকে আবিষ্কৃত প্রত্নত্বাত্তিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, ভাইকিংরা দক্ষিণ ইউরোপ থেকে তথা মুসলিম বণিকদের কাছে বস্ত্র, অলংকার, মুদ্রা এবং ধাতব বস্তুর বিনিময়ে মধু, পশুর দাঁত, চামড়া এবং পশমী সামগ্রী বিক্রি করতো।

এদিকে উত্তর ইউরোপ এবং অন্যান্য অঞ্চলে বারবার পরাজয়ে হতাশ হয়ে বেশীরভাগ ভাইকিং খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং অনেকেই চলে যায় ফ্রান্সে। একাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরেশিয়ায় তুর্কি উপজাতিদের মধ্যে ইসলামের প্রসার এবং বাল্টিক সাগর, নরওয়ে, সুইডেনের চারপাশে খ্রীষ্টধর্মের সমসাময়িক বিস্তারের সাথে সাথে, ভাইকিংরা তাদের চিরাচরিত পৌত্তলিক বিশ্বাসের শিকড় থেকে বের হয়ে খ্রীষ্ট ধর্মের দিকে আগ্রহী হয়ে পড়ে। পারস্য পণ্ডিত শরফ আল-জামান মারওয়াজি একটি উদাহরণ লিপিবদ্ধ করে তার বর্ণনায় দেখিয়েছেন, একদল ভাইকিং খ্রীষ্টান উগ্রপন্থীদের বাড়াবাড়িতে অসন্তুষ্ট হয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। পরবর্তীতে আরও জানা যায় যে, কিছু ভাইকিং স্পেনের জলসীমানায় যুদ্ধে পরাজয়ের পর আন্দালুস এলাকায় বসতি স্থাপন করতে থাকে স্থায়ীভাবে। ইতিহাসবিদ ওমর মুবাইদিনের নিবন্ধে বলা হয়েছে, ভাইকিংরা আইবেরিয়ান উপদ্বীপে (দক্ষিণ ইউরোপ) মুসলমান ও খ্রীস্টান উভয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযান চালায়। অবশেষে, ভাইকিংদের ক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায় এসব অভিযানে বারবার পরাজয়ে হতাশ হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব সেভিলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করে। এই ইসলামগ্রহণকারী ছোট ভাইকিং সম্প্রদায়টি কর্ডোবা এবং সেভিলে পনির তৈরী এবং সরবরাহের জন্য ছিল অত্যন্ত বিখ্যাত। অ্যান্ড্রু মার (Andrew Marr) ২০১২ সালে তার বিবিসি ডকুমেন্টারি, “হিস্ট্রি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড: ইনটু দ্য লাইট” এ দেখিয়েছেন, কীভাবে রাশিয়ার ভাইকিংরা ইসলাম গ্রহণের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল।