প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির আনুষ্ঠানিক পরাজয় হলে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ হরণ করে শেষ হয় একটি মহাযুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।আর এর সাথে জার্মানিকে চড়া মূল্য দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। মিত্রশক্তির দেশগুলো জার্মানিকে খুবলে খাওয়ার জন্য হেন উপায় নেই যা গ্রহণ করেনি। তাদের এই খুবলে খাওয়ার নীতিকে তারা একটি চুক্তির ভেতরে নিয়ে আসে। ইতিহাসে এটি ভার্সাই চুক্তি নামে পরিচিত। যা ছিল জার্মান জাতির জন্য অপমানজনক এবং জার্মানির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্পষ্ট লংঘন। 

ইংরেজি সংস্করণের প্রথম পাতা

 
আমেরিকার স্বাধীনতা প্রশ্নে ব্রিটেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম ভার্সাই চুক্তি হয়েছিল ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে ১৭৮০ সালে। প্রায় দেড়শ বছর পর সেই একই শহরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন আর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ মিলিত হোন জার্মানিকে ভৌগোলিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পংগু করে দিতে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার শাস্তি হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি আত্মসমর্পণ করলে মিত্রশক্তির বিগ ফোর বলে খ্যাত চার দেশের রাষ্ট্রপ্রধান অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ, ইতালির ভিট্টোরিয়ো অরল্যান্ডো, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জর্জেস ক্ল্যামেনকু একটি চুক্তি প্রতিষ্ঠার আগে প্যারিসে এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। ১৯১৯ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখের এই সম্মেলনে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এছাড়া আরো ৩২ টি দেশ যারা কিনা যুদ্ধকালীন জার্মানির সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল তাদেরও ডাকা হয়। এই সম্মেলনে মূখ্য ভূমিকায় থাকা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ ও ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জর্জেস ক্ল্যামেনকু জার্মানির সাথে একটি চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেন এবং রূপরেখার খসড়াও প্রায় তৈরি করা হয়। উল্লেখ্য এই সম্মেলনে জার্মানি তথা পরাজিত পক্ষের কোন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। 

জার্মানির জেহানেস বেল অংকিত স্যার উইলিয়ার অরপেনের হল অফ মিররসে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ১৯১৯ সালের ২৮শে জুন চুক্তি স্বাক্ষর

প্যারিস শান্তি সম্মেলনের পরবর্তী ফলাফলে মিত্রশক্তির প্রতিনিধিবর্গ চুক্তি প্রস্তুত করে ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই নগরের প্রাসাদের মিরর হলে জার্মান প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানায়। আদতে জার্মান প্রতিনিধি দল বলে ডাকা হলেও এই দলটির সাথে  তারা যুদ্ধবন্দীদের মত আচরণ করে। প্রহরী বেষ্টিত করে নিয়ে আসা হয় চুক্তি সাক্ষর করতে। সন্ধির ধারা শুনে জার্মান এই দলটি প্রথমে আপত্তি জানালেও তাদের কোন কথা শুনা হয়নি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হুমকি দেন, এখানে বসে যদি চুক্তিতে সাক্ষর না করা হয় তবে বার্লিনে গিয়ে সই করাতে বাধ্য করা হবে জার্মানিকে। নিরুপায় জার্মানি সন্ধিতে সাক্ষর করতে বাধ্য হয়। ২০০ পৃষ্ঠার ১৫ টি ধারা নিয়ে গঠিত এই চুক্তিতে ৪৩৯ টি অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়। চুক্তির পুরোটাই জুড়ে জার্মানির ভূমি ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়ার নানা উপায় বিধৃত ছিল। এছাড়া লীগ অফ নেশনস, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ব্যাপারেও এই চুক্তিতে অনুচ্ছেদ নিয়ে আসা হয়৷ চুক্তির সাধারণ নিয়ম নীতির কোন তোয়াক্কা না করে জার্মানির উপর এই বিদ্বেষ স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা উগরে দেয়। তবুও পরাশক্তিগুলোর স্বেচ্ছাচারীতার কবলে পড়ে জার্মানি নজিরবিহীন এক ত্যাগের স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া হয় অসম সব শর্ত। এই শর্তগুলোর দিকে চোখ ফেরানো যাক।

২৮শে জুন, ভার্সাই রাজপ্রসাদ

জার্মানির পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে মিত্রপক্ষীয় মোড়লরা ঘৃণ্যভাবে দেশটির ভূমি ভাগ করে নেয়ার নীলনকশা অংকন করে এই চুক্তিতে। স্পষ্ট সার্বভৌমত্ব লংঘন করে তারা একে একে দখল করে নেয় জার্মানির ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব এলাকা৷ ফ্রান্সকে আলসাস এ লোরেন প্রদেশ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ইউপেন, মেসিনেট এবং মালমেডি অঞ্চল বেলজিয়ামকে দিয়ে দিতে হয়। উত্তর শ্লেষউইক অঞ্চল ডেনমার্কের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। প্রুশিয়া এলাকা ফেরত দিতে হয় পোল্যান্ডের কাছে। অস্ট্রিয়াকে জার্মানি থেকে আলাদা করে স্বাধীনতা দেয়া হয়। জার্মান নাগরিকদের নিজ দেশ থেকে বিতাড়ন করে অন্যদেশের অধিভুক্ত করা হয়। পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে থাকা জার্মান কলোনিগুলো মিত্রশক্তি নিজেদের মধ্যে নিজেদের খেয়ালখুশিমত ভাগ করে নিবে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছে ক্যামেরন ও টোগোকে হস্তান্তর করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার যেসব অঞ্চল জার্মানির অধীনে ছিল তা দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। চীন,থাইল্যান্ড, মরক্কো ইত্যাদি অঞ্চলে জার্মানির বিশেষ অধিকার ত্যাগ করতে হবে। ইত্যাদি নানান শর্তের গ্যাঁড়াকলে পড়ে জার্মানির সাম্রাজ্য একদম ছোট হয়ে পড়ে।
 
জার্মানির ভূমি অধিকার করেই ক্ষান্ত হয়নি মিত্রপক্ষীয় শক্তি। তারা চাপিয়ে দেয় বিশাল পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝাও। এই ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য একটি ক্ষতিপূরণ কমিশনও গঠন করা হয়। এই কমিশনকে তিন বছরের মধ্যে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়ার সময় বেঁধে দেয়া হয়। দেড় থেকে দুই হাজার কোটি ডলারের বিশাল ক্ষতিপূরণ যুদ্ধবিধ্বস্ত  জার্মানির পক্ষে বহন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। অর্থ ক্ষতিপূরণ ছাড়াও রাইন নদীকে আন্তর্জাতিক জলপথ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। জার্মানি থেকে কাঠ, কয়লা মিত্রশক্তির দেশসমূহকে নেয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। 
 
ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষণের সব বন্দোবস্ত করেও জার্মানিকে দুর্বল করে দিতে মিত্রপক্ষীয় দেশগুলো এবার দেশটির সামরিক শক্তিকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে।  আর এজন্য জোর জবরদস্তির মাধ্যমে চাপিয়ে দেয়া চুক্তিতে জার্মানির জন্য সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। অভ্যন্তরীণ শৃংখলার জন্য নামেমাত্র এক লক্ষ সৈন্যের অনুমোদন দেয়া হয়। বিমানবাহিনীকে বিলুপ্ত করা হয়। নৌবাহিনীর সদস্য সংখ্যাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। জার্মান জেনারেলদের বরখাস্ত করা হয়। জার্মান যুদ্ধজাহাজগুলোকে ইংল্যান্ডের সম্পত্তি বানানো হয়। বাধ্যতামূলক সামরিক অংশগ্রহণ বিলুপ্ত করা হয়। জার্মান দুর্গ ও সামরিক ঘাটিগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়। আর সমুদয় শর্ত বাস্তবায়নের দেখভালের জন্য জার্মানিতে ১৫ বছর মেয়াদে মিত্রবাহিনীর সৈন্য মোতায়েন করা হয়। মোটকথা জার্মানিকে নিঃশেষ করে দেয়ার সকল আয়োজনই এই ভার্সাই চুক্তিতে  সম্পন্ন করা হয়। এসকল শর্ত ছাড়াও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জার্মান সম্রাট কাইজার ও তার সেনাপতিদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়। 

একটি ব্রিটিশ সংবাদ প্ল্যাকার্ড শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণা করে

 
ভার্সাই চুক্তির ফলাফল কি হয়েছিল?
 
জার্মান জাতির জন্য চূড়ান্ত অবমাননাকর এই চুক্তি ছিল নিষ্ঠুরভাবে একপেশে একটি চুক্তি। এখানে পরাজিতের কোন মূল্যায়ন তো করাই হয়নি উপরন্তু তাদের কোন মতামতও শুনা হয়নি। জোর করে জার্মানিকে এই চুক্তিতে বাধ্য করার ফলে দীর্ঘমেয়াদে পৃথিবীকে এই ক্ষত বেড়াতে বইতে হয়েছে। কেননা এই অপমানজনক চুক্তিই পরবর্তীতে উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করেছিল যা হিটলার এবং তার নাজি বাহিনীকে জার্মানির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছিল। দ্বিতীয় ভার্সাই চুক্তিকে কেন্দ্র করে জার্মানিতে নাজি বাহিনী আরেকটি মহাযুদ্ধের দামামা বাঁধিয়ে দেয়, মেলে জনগণের সমর্থন। হিটলার তার জাত্যাভিমানী চরিত্রকে আরেকটি বিশ্বুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ঐ ভার্সাই চুক্তিরই একটি ফলাফল।
 
 
তথ্যসূত্র