দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়া এক ভয়াবহ সময় পার করেছিল সত্তরের দশকে খেমাররুজ সরকারের আমলে। খেমাররুজ গেরিলাদের এই দল কম্বোডিয়ায় নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করে নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে কায়েম করেছিল এক ত্রাসের রাজত্ব। তাদের নেতা পল পট সমাজতান্ত্রিক গেরিলা থেকে স্বৈরশাসক প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছিলেন একজন কুখ্যাত চরিত্র হিসেবে। কৃষিভিত্তিক স্বপ্নের দেশ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পল পট হত্যা করেছেন এক মিলিয়নের বেশি কম্বোডিয়ান নাগরিককে। ধ্বংস করেছেন শহর, আধুনিক নগর কাঠামো। তার গঠিত সন্ত্রাসী দল আংকা জোরপূর্বকভাবে নাগরিকদের কৃষি খামারে কাজ করতে বাধ্য করত। অবর্ণনীয় নির্যাতনে ধুকে ধুকে মারা গেছে সাধারণ কম্বোডিয়ানরা। একজন বামপন্থী গেরিলা থেকে নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক পল পটের জীবনবৃত্তান্তে চোখে ফেরানো যাক।

অন্যান্য খেমাররুজ নেতাদের সাথে পল পট (সর্ব বামে)

কম্বোডিয়ার এই কুখ্যাত খেমাররুজ নেতার প্রকৃত নাম ছিল সালথ সার। ১৯২৫ সালে কৃষক বাবার ঘরে জন্ম নেয়া সালথ সার তার ৬ বছর বয়সে বড় ভাইয়ের সাথে রাজধানী নমপেনে পড়াশোনা শুরু করেন। পড়াশোনায় তেমন ভাল ছিলেন না সালথ সার। অমনোযোগী হওয়ার দরুন প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি তিনি। যার কারণে নমপেনের একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুতারের কাজ শিখেন প্রায় এক বছর৷ ১৯৪৯ সালটা ছিল সালথ সারের জীবনের জন্য এক মোড় পরিবর্তনকারী বছর৷ সে বছর তিনি বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে উচ্চশিক্ষার জন্য গমন করেন। প্যারিসে পড়তে গিয়ে সর্বপ্রথম বাম রাজনীতির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন সালথ সার এবং ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। সেখানে বামপন্থী কম্বোডিয়ান কিছু জাতীয়তাবাদীর সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে সালথ সারের। সমাজতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে তিনি এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তার পড়ালেখায় ছেদ পড়ে এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে পড়েন। ফলশ্রুতিতে তার বৃত্তি বাতিল হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালে রাজধানী নমপেনে ফিরে আসেন সালথ সার এবং ১৯৫৬-১৯৬৩ পর্যন্ত সেখানকার এক প্রাইভেট স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ইতিমধ্যে কম্বোডিয়ায় তার সমাজতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড বেশ বিস্তৃত করে ফেলেছেন তিনি৷ ১৯৬৩ সালে সালথ সার তার নতুন নাম পল পট গ্রহণ করেন।

খেমাররুজ গেরিলা গঠন

ফ্রান্স থেকে ফিরে এসে কম্বোডিয়ায় লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি বামপন্থী আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। তার বেশকিছু ছাত্র জুটে যায় যারা পল পটের আদর্শে আস্থা রাখতে সম্মত হয়। পট গোপনে কম্বোডিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। এক পর্যায়ে দুর্বল এসব কমিউনিস্ট পার্টিদের নিজের আয়ত্তে এনে নতুন একটি দল গঠন করেন পল পট যার নাম দেয়া হয় কমিউনিস্ট পার্টি অফ কম্পূচিয়া ইন কম্বোডিয়া। এটি বহুলভাবে পরিচিত হয় খেমাররুজ নামে। ধীরে ধীরে এই দলটি গেরিলা সংগঠনে পরিণত হয়।  তবে তারা ছিল নিরস্ত্র। নিরস্ত্র অবস্থায়ই তারা কম্বোডিয়ার রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়। কম্বোডিয়ার রাজতন্ত্র বামপন্থী দলগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করলে পল পটের উত্থান ত্বরান্বিত হয়।

পল পটের উত্থান ও নৃশংসতা

কম্বোডিয়া রাজ সরকার বামপন্থী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে পল পট এই সিদ্ধান্তকে লুফে নেন। পালিয়ে গিয়ে ভিয়েতনাম সীমান্তে একটি গেরিলা ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। সেখানে তার উত্তর ভিয়েতনাম সরকারের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। বামপন্থী গেরিলা হওয়ায় তার সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথেও ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ভিয়েতনামের কোলে লালিতপালিত হয়ে পল পট হয়ে উঠেন পুরোদস্তুর সমাজতান্ত্রিক গেরিলা নেতা। কিন্তু সহসাই পল পটের সাথে ভিয়েতনাম সরকারের সম্পর্কের চিড় ধরে৷ সব ধরণের সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়া হয় সোভিয়েত ইউনিয়নেরও পক্ষ থেকে৷ এই ঘটনা পল পটের আদর্শকে পালটে দেয়। তিনি সমাজতন্ত্রকে ছুঁড়ে ফেলে নতুন এক ভিন্নধারার সমাজতজন্ত্রের উন্মোচন করেন যেখানে কৃষিভিত্তিক এক ধরণের অবাস্তব এক রাষ্ট্র কাঠামোর ধারণা ছিল। সীমান্তবর্তী এলাকায় পল পট তার খেমাররুজ বাহিনীদের নিয়ে সেই অগ্রযাত্রা শুরু করে দেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকের বেশ ধরে জনপ্রিয়তা বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে খেমাররুজদের। শহুরে অনেক বামপন্থী কর্মীরা পালিয়ে গিয়ে খেমাররুজদের দল ভারী করতে থাকে।

খেমাররুজ দলের সদস্য যখন বাড়ছিল

নাটকীয়ভাবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও খেমাররুজদের পক্ষে যায়। এমন এক সময়ে কম্বোডিয়ায় রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু সেই সেনাবাহিনীর সরকারও তেমন একটা শক্তিশালী ছিল না৷ সেনা সরকারের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে খেমাররুজরা রাজধানীর দিকে আগাতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল খেমাররুজরা রাজধানী নমপেন দখল করে। খেমাররুজদের ক্ষমতা দখল কম্বোডিয়ার ইতিহাসকে বদলে দেয়। পল পট হয়ে উঠেন স্বৈরাচারী। তার কৃষিভিত্তিক অবাস্তব রাষ্ট্র কাঠামো বাস্তবায়নের জন্য তিনি শহর ব্যবস্থা ভেংগে দেন। গাড়িবাড়ি, অবকাঠামো ধ্বংস করে সবাইকে গ্রামে গিয়ে ক্ষেত খামারে কাজ করার নির্দেশ দেন। ভিনদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের তরিকা হ্রাস করেন পল পট। আধুনিক ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ খেমাররুজ সরকার বাস্তবিক অর্থেই কম্বোডিয়াকে একটি উন্মুক্ত কারাগারে রূপান্তরিত করে। পল পটের পেটোয়া বাহিনী আংকার হাতে মারা পড়তে থাকে সাধারণ নিরীহ কম্বোডিয়ান। যারা খামারে কাজ করতে চাইত না তাদের হত্যা করত আংকার সদস্যরা। কখনো মুখে প্লাস্টিল ঢুকিয়ে, কখনো পানিতে চুবিয়ে, দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হত তাদের।

১৯৭৫ সালে খেমাররুজ গেরিলারা কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন দখল করে নেয়

পল পট ঘোষণা দেন তার দেশ শূন্য বছর থেকে সবকিছু শুরু করবে।  আর এজন্য নাগরিকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের আহ্বান জানান তিনি৷ যারাই কাজে অবহেলা দেখাত তাদের উপরই নেমে আসত ভয়াবহ নির্যাতন। এভাবে কম্বোডিয়ায় প্রায় ১০ লক্ষের উপর নাগরিক খেমাররুজ সরকারের নির্যাতনে বলি হয়। কিন্তু পল পটের এই নৃশংসতা ও একগুঁয়েমি বেশিদিন থাকেনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের উপর জয়ী ভিয়েতনামী বাহিনী এবার আরো শক্তিশালী হয়ে পল পটকে উৎখাত করতে মাঠে নামে। ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামের বাহিনী নমপেন দখল করে খেমাররুজ সরকারকে উৎখাত করে৷ পল পট পালিয়ে যান থাইল্যান্ড সীমান্তের দুর্গম অরণ্যে। পরবর্তী ১৫ বছর পল পট আবার খেমাররুজদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত খেমাররুজদের ভেতরে ভাংগন দেখা দেয়। পল পটের কমান্ড ভেংগে পড়ে। ১৯৯৮ সালে খেমাররুজরা পল পটকে কম্বোডিয়ার সরকারের কাছে হস্তান্তর করার চেষ্টা করলে আত্নহত্যা করে বসেন এই কুখ্যাত গেরিলা নেতা। আর এরই সাথে শেষ হয় কম্বোডিয়ার ত্রাস ইতিহাসের খলনায়ক সালথ সার এর অধ্যায়।

কম্বোডিয়ার নানা স্থানে আজও ছড়িয়ে রয়েছে খেমাররুজদের বর্বরতার চিহ্ন