মহাস্থান শব্দের আবিধানিক অর্থ  বিখ্যাত স্থান। কেউ কেউ মনে করেন যে স্থানটির আসল নাম মহাস্থান বা বিখ্যাত স্থানের  জায়গা  আবার স্থানীয় মুসলমানসদের মতে স্থানটির নাম মহাস্থানগড় যা একটি স্থানীয় কিংবদন্তীর ওপর প্রতিষ্ঠিত। বগুড়া শহরের উওরে ১৮ কি. মি. দুরে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পাশে শিবগঞ্চ থানার রায়নগর ইউনিয়নে করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে ত্রদেশের সর্ব প্রাচীন  নগরীর ধ্বসাস্থানগড় অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য হতে জানা যায় যে খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী হতে ১৫শ শতাব্দীর মধ্য মহাস্থানগরড় ত্রকটি সমৃদ্ধশালী জনপদরুপে গড়ে ওঠে। এভাবে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এই গড় মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, পাল, মুসলিম এবং আরও অইেশ হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল। প্রাচীন ঘেরা ত্রই নগরীর দৈর্ঘ্য ৫০০০ ফুট এবং প্রস্থ ৪৪০০ ফুট। চারপাশের ভূমির উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। প্রাচীন এই নগরীতে প্রায় আট কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল শহরতলী। নগরকেন্দ্রের বাইরেও ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসা কেন্দ্র।

মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক নগরী। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে এটি পুণ্ড্র রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী ছিল।

এখানকার মাটিচাপা পড়া বসতিস্তরগুলোতে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকে শুরু করে নানা আমলের সোনা তামা, লোহা ব্রোঞ্চ প্রভৃতি ধাতু এবং পাথর ও পোড়ামাটির দ্রব্যসামগ্রী পাওয়া গেছে। এসব দ্রব্যের মধ্যে আছে বুদ্ধমূর্তি দেব-দেবীর এবং নানা প্রাণীর মূর্তি, অলংকার, মাটির পাত্র, পোড়ামাটি ও পাথরে খোদিত চিত্রকলা, লোহা বর্শা, তামার পদক, খেলনা, সিল, বর্শা, ক্ষুর, চাকু ইত্যাদি। সে যুগে এখানে পুরাকৌশল বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্থাপত্য বিদ্যা বা আর্কিটেকচার অনেক উন্নতি লাভ করেছিলো।

রাজা পরশুরাম পাথরটিতে বলী দিতেন

পাচিলসহ পাকা ইমারত, ইটের সিঁড়ি, বারান্দাসহ বহুতল অট্রালিকা, ইট-পাথর বাঁধানো রাস্তা, কুয়ো, পানি নিশ্কাশনের নালা প্রভৃতির ধ্বংসাবশেষের মাধ্যমে এখানকার সভ্যতা যে কতখানি উন্নত ছিল তা বুঝতে পারা যায়। মহাস্থানগড়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল গুলোর মধ্যে রয়েছে মহাস্থানগড়, মঙ্গলকোট, গোকুলমেধ, স্কান্ধধাপ, ভাসুবিহার, শবদল দীঘি, গোবিন্দ ভিটা, বৈরাগীর ভিটা। এছাড়াও রয়েছে মানকালির কুন্ডু, পরশুরামের প্রাসাদ ঢিবি, জিয়ত কুন্ডু, কুপ, খোদার পাথর ভিটা নামের ঢিবি, তোতারাম পন্ডিতের ধাপ, মুনির ঘোন, নরসিংহের ধাপ ইত্যাদি।

নরপতির ধাপ (ভাসু বিহার)

১৮৮০ সালে বুকানন হ্যামিলটন নামে একজন ইউরোপীয় মহাস্থানগড় এবং এর সংলগ্ন অঞ্চল ঘুরে ফিরে দেখেন। এরপর পরবর্তী আশি বছর ধরে মোট ৩ পর্বে মহাস্থানগড়ে খনন কাজ পরিচালিত হয়েছে এবং তা এখনো অব্যহত রয়েছে। তৃতীয় পর্বে বাংলা-ফরাসী যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৩ হতে এ পর্যন্ত বৈরাগীর ভিটা, পূর্ব বাহুর মাঝামাঝি অংশ এবং মাজার এলাকায় খনন অব্যাহত রয়েছে। এসব খননের মাধ্যমে উন্মোচিত হচ্ছে ইতিহাসের নানা চমকপ্রদ দিক।

মহস্থানগড়ে প্রাপ্ত একটি প্রাচীন লিপি

মহাস্থানের এসব তাৎপর্যপূর্ণ সাইটসমূহের সমন্বিত জ্ঞানলাভের জন্য অবশ্যই আসতে হবে মহাস্থানগড় জাদুঘরে। এখানে রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের বিপুল সংগ্রহ। মহাস্থান জাদুঘরের ভ্রমণ মানেই অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বিশাল এক সঞ্চয়। অবশেষে সমগ্র বগুড়া জেলা জুড়েই এত প্রাচীন কীর্তির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে যে তা গুণে শেষ করা যায় না। এখানে এলেই জানতে পারা যায় বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতি কত-সমৃদ্ধ। আর দেশকে না জানলে দেশের প্রতি ভালবাসা জন্মাবে কেমন করে?

জিয়ৎ কুণ্ড