জায়গাটি তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় খ্যাত তক্ষশীলা। গ্রীক দিগ্বীজয়ী বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সাথে দেখা করতে এসেছে বিশ বছর বয়সী একজন যুবক। যুবকের চোখে-মুখে বিস্ময়। অবাক চাহনিতে অপলক তাকিয়ে দেখছে সে ঘোড়সওয়ারী আলেকজান্ডারকে, আর ভাবছে কিভাবে এমন দিগ্বীজয় সম্ভব করলেন এই ব্যক্তি, তাও আবার মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে। যুবক তখনও জানতো না, আলেকজান্ডারের চেয়েও বিশাল এক জয় তার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। এই অপেক্ষা বেশিদিনের নয়। কিছুকাল পরই ঘটতে যাচ্ছে সেই অবিস্মরণীয় ঘটনা, রচিত হবার পথে একটি কালজয়ী ইতিহাস। এই গল্পের শেষ কিন্তু এখনও হয় নি, বরং যেখানে আলেকজান্ডারের শেষ, সেখানেই এই গল্পের শুরু। আর গল্পটির নায়ক আলেকজান্ডারের সাথে দেখা করতে আসা এই বিশ বছরের যুবক। যুবকের নাম চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

ইস্তানবুল প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীর আলেকজান্ডারের মূর্তি

খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। একজন সাধারণ তরুণ থেকে তিনি হয়ে ওঠেন একজন দুর্দমনীয় রাজা, গড়ে তোলেন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য, মৌর্য সাম্রাজ্য। যে শক্তিশালী নন্দরাজের মুখোমুখি হতে স্বয়ং আলেকজান্ডারের সৈন্যরাও সাহস পায় নি, সেই নন্দরাজ এই অসম সাহসী তরুণের কাছে পরাজিত হয়ে মগধ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খুব দ্রুতই মগধের মুকুট নিজের মাথায় পরেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গল্প জানতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে প্রায় ২৩০০ বছর আগের পাথরের নগরী তক্ষশীলায়, যেটি বর্তমান পাকিস্তানের ইসলামাবাদ থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। তক্ষশীলা ছিলো তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চার জায়গা। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সম্ভ্রান্ত ও রাজবংশীয় পরিবার থেকে এখানে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে আসতো। এখানেই পড়ালেখা করেছেন ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করা প্রাচীন পৃথিবীর সেরা দার্শনিক, রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদ ব্রাহ্মণ চাণক্য, যিনি কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত। ধারণা করা হয়, ‘কৌটিল্য’ তার ছদ্মনাম। তিনি ছিলেন কুটিলা গোত্রের। ‘কুটিলা’ থেকেই ‘কৌটিল্য’ নামটি এসেছে। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ ‘অর্থশাস্ত্র’ বা ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ নামক বই, যাকে বিশ্বকোষের চেয়ে কোনো অংশে কম বলা যায় না। এই বইটিতেই এক জায়গায় লেখককে ‘বিষ্ণুগুপ্ত’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ‘বিষ্ণুগুপ্ত’ তার বাবার দেয়া নাম ছিলো। আর ‘চাণক্য’ নামটি এসেছে তার গ্রামের নাম ‘চানকা’ থেকে। এই জ্ঞানী ব্যক্তি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, কারণ তিনি মনে করতেন, অর্জিত জ্ঞান মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে না পারলে সেই অর্জন মূল্যহীন। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর কোনো কাঠ, পাথর কিংবা মাটির তৈরী মূর্তির মাঝে বাস করেন না, ঈশ্বর বাস করেন আমাদের আত্মার মাঝে।

দূরদর্শী চাণক্য ভারতবর্ষে বিদেশী শক্তি তথা গ্রীকদের আধিপত্য বিস্তারের পূর্বাভাস পেয়েছিলেন। তাই তিনি ভারতবর্ষের ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে ভারতবর্ষকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন, আর এ জন্যই তৎকালীন সবচেয়ে শক্তিশালী নন্দরাজের কাছে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মগধে নন্দরাজের দরবারে গিয়ে তিনি অপমানিত হন। মূর্খ ও অত্যাচারী নন্দরাজ তার গুরুত্ব বুঝতে পারে নি। আর বিতাড়িত চাণক্য নিজের এমন অপমান মেনে নিতে পারেন নি। তাই তখন থেকেই মগধের অধীশ্বর নন্দরাজকে ধরাশায়ী করার উপায় খুঁজতে থাকেন তিনি। কথায় আছে, মন দিয়ে খুঁজলে ঈশ্বরকেও পাওয়া যায়। আর তাছাড়া বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান চাণক্যের জন্য তা মোটেও কঠিন কিছু ছিলো না। একদিন তিনি পথে কয়েকজন কিশোরকে খেলতে দেখে থামলেন, লক্ষ করলেন যে একজন রাজাও আছে এই খেলায়। যে ছেলেটি রাজা হওয়ার অভিনয় করছিলো, তার রাজাসুলভ আচরণ ও কর্তৃত্ব খাটানোর ভঙ্গি চাণক্যকে এতোটাই মুগ্ধ করে ফেলেছিলো যে ঠিক তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, এই ছেলেকেই তিনি ভবিষ্যতের একজন যোগ্য রাজা হিসেবে গড়ে তুলবেন, যে মগধ অধিকার করে তার অপমানের প্রতিশোধ নিবে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই যে সেই ছোট্ট রাজা ছিলেন, এ সম্পর্কে বোধহয় সন্দেহের কোনো অবকাশ আর থাকে না। হ্যাঁ, পাটালিপুত্রের ১৫০০ কিলোমিটার দক্ষিণের একটি গ্রাম থেকে আসা পিতৃহীন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই ছিলেন জ্ঞানী চাণক্যের সবচেয়ে কাছের শিষ্য ও বন্ধু। তক্ষশীলায় পড়াশোনা করার সময় মাত্র ২০ বছর বয়স থেকেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শিক্ষক ও কাছের বন্ধু চাণক্যের সংস্পর্শে রাষ্ট্র পরিচালনার জ্ঞান, দিগ্বীজয়ের কৌশল, সৈন্য সংগ্রহ, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখার উপায় সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ অব্দে মারা যাওয়ার আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

চাণক্য

শিক্ষক চাণক্যের পরামর্শেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্প্রতি তক্ষশীলার অভিযান প্রায় শেষ করে আনা আলেকজান্ডারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, মগধের রাজাকে পরাজিত করার জন্য সহযোগীতার অনুরোধ করতে আলেকজান্ডারের সাথে দেখা করেছিলেন তিনি, যদিও শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিলো তাকে। কেননা সে সময়ের সুপরিচিত আলেকজান্ডারের সামনে তিনি তখন ছিলেন নাম না জানা একজন সাধারণ প্রজামাত্র। অথচ কিছুকাল পরই আলেকজান্ডারের মতোই তিনি নিজেও একজন দিগ্বীজয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, আর অত্যন্ত দ্রুত গড়ে তুলেছিলেন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নন্দ সাম্রাজ্য দখল করেন ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। কিন্তু এই জয় খুব সহজে লাভ করেন নি তিনি। তখন নন্দরাজ ছিলেন ধননন্দ। আলেকজান্ডারের সৈন্যদলের নন্দভীতির কারণে আলেকজান্ডার শেষ পর্যন্ত ভারতবর্ষ জয় অসম্পূর্ণ রেখেই ফিরে যান এবং ফেরার পথে ব্যবিলনে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে মারা যান। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর এমন সুবর্ণ সুযোগকে চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হাতছাড়া করতে চান নি। ১০০০ অশ্বারোহী, ৭০০ হস্তিবাহিনী এবং ৬০,০০০ পদাতিক সৈন্যের অধিকারী শক্তিশালী ধননন্দের সাথে প্রথম দুই দফা যুদ্ধে পরাজিত হয়েও দমে যান নি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তৃতীয় দফায় আবারো যুদ্ধে নামেন তিনি এবং মগধের মুকুট ছিনিয়ে আনেন অত্যাচারী রাজার হাত থেকে। রাজ্য হারিয়ে পরাজিত ধননন্দ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাম্রাজ্য বিস্তার

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাত জন সেনাপতি নিজেদের মধ্যে রাজ্য ভাগ করে নিয়েছিলো এবং ভারতবর্ষ পড়েছিলো সেনাপতি প্রথম সেলিউকাস নিকাতোরের ভাগে। মগধ জয়ের পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য উত্তর ভারত থেকে বাকি গ্রীক সৈন্যদের উৎখাত করেন ও প্রথম সেলিউকাস নিকাতোরকে পরাজিত করেন। সেলিউকাস আবারো তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে একটি মৈত্রীচুক্তি হয়েছিলো, আর এই মৈত্রীচুক্তির কারণে সেলিউকাস নিজের মেয়ে হেলেনাকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এ সময় সেলিউকাসের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মেগাস্থিনিসকে চন্দ্রগুপ্তের দরবারে পাঠানো হয়। মেগাস্থিনিস এর বই ‘ইন্ডিকা’-তে মৌর্য বংশের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ইপসাসের যুদ্ধের জন্য সেলিউকাসকে তিনি ৫০০ টি যুদ্ধহস্তী দিয়েছিলেন।

তামিল ও কলিঙ্গ অঞ্চল বাদে ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য প্রায় সব অঞ্চলই মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য আর গড়ে ওঠে নি। শিক্ষক চাণক্যই ছিলেন রাজা চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী। মেগাস্থিনিস এর ‘ইন্ডিকা’-তে উল্লেখ আছে যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের চার লক্ষ সৈন্য ছিলো।

রাজ্যজয়ে চেষ্টার কোনো ত্রুটি না করা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যখন একেবারে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছেন তখন হঠাৎ করেই ঘটলো এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। জীবনে যা কিছু চেয়েছিলেন তার প্রায় সবটাই যখন অর্জিত হয়ে গেছে, তখন সহসাই একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন উজ্জ্বল বেগুনী ও সোনালী বর্ণের এমব্রয়ডারীর সবচেয়ে উন্নতমানের মসলিন পোশাক পরিধানকারী উচ্চাভিলাসী রাজা, এ বিশাল জয়, বিশাল সাম্রাজ্য ত্যাগের সিদ্ধান্ত।

মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর তার দেখা হয় জৈন আচার্য ভদ্রবাহুর সাথে, যার কাছে তিনি আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন। ভদ্রবাহু তার সাম্রাজ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভিক্ষের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং সত্যি সত্যি প্রায় বারো বছর যাবৎ তার রাজ্যে খরা দেখা দিয়েছিলো, যা মারাত্মক দুর্ভিক্ষে রূপ নিয়েছিলো। মহাস্থানগড়ে পাওয়া ব্রাহ্মীলিপি থেকে জানা যায়, ফসলহানি হওয়ার সময় কোনো এক মৌর্য রাজার কাছ থেকে একজন সামন্তরাজের কাছে নির্দেশ আসে যে প্রজাদের যেনো রাজভান্ডার থেকে সম্পদ দেয়া হয়। এই রাজা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন একজন দানশীল রাজা।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মূলত ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু ভদ্রবাহুর প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে ৪২ বছর বয়সে তিনি জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন এবং প্রাণের সিংহাসন ছেড়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত রাজা তার গুরুর সাথে দক্ষিণের কর্ণাটকে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি সাধু-সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করেন। বিধাতার খোঁজে বেরিয়ে পড়া দিগ্বীজয়ী রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জৈন ধর্মাচার ‘স্বেচ্ছা উপবাস’ শুরু করেন এবং তপস্যারত অবস্থায় মারা যান।

রুদ্রপাটনা শামাশাস্ত্রী

এসব ছোট ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো হয়তো আমাদের অগোচরেই রয়ে যেতো, যদি ১৭৯৩ সালে কোলকাতা থেকে স্যার উইলিয়াম জোনস এবং ১৯০৫ সালে সংস্কৃত পন্ডিত রুদ্রপাটনা শামাশাস্ত্রী আমাদের সামনে তুলে না ধরতেন। রুদ্রপাটনা শামাশাস্ত্রী কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ বইটিকে প্রথম ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। এই বইতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও মৌর্য বংশের যাবতীয় তথ্যের উল্লেখ আছে। গ্রীক ইতিহাসবিদ প্লুতার্ক ‘স্যান্ড্রোকোটাস’ নামক এক ব্যক্তি এবং কিভাবে তিনি নন্দ রাজাকে হারিয়ে মগধ দখল করেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। আবার পরবর্তীতে বিশাখাদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক থেকে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোনস জানতে পারেন কিভাবে নন্দরাজকে হারিয়ে চন্দ্রগুপ্ত নামক যুবক মৌর্য সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এরপর দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে তিনি বলেন, স্যান্ড্রোকোটাস ও চন্দ্রগুপ্ত একই ব্যক্তি। অনেক গ্রীকো-রোমান লেখাতেই স্যান্ড্রোকোটাসের উল্লেখ পাওয়া গেছে, কিন্তু ভারতীয় কোনো লেখাতেই এই নামের কোনো হদিস পাওয়া যায় নি। তাই ধারণা করা হয়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই গ্রীক ও রোমানদের কাছে ‘স্যান্ড্রোকোটাস’ নামে পরিচিত ছিলেন।

ধর্মভেদেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে নিয়ে মতভেদ আছে। তিন ধর্মে তিনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাকে। বৌদ্ধ ধর্মে বলা হয়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ক্ষত্রিয় গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এবং একটি ছোট রাজ্য থেকে এসেছে, কিন্তু পরবর্তীতে বাবার মৃত্যুর পর একজন শিকারীর কাছে পালিত হন তিনি। জৈন ধর্মে বলা হয়, হিমালয়ের পার্বত্য রাজা পর্বতেশ্বর বা পর্বাতক বা পুরুষোত্তমের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলো চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। হিন্দু পুরাণে বলা হয়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নিচু (শুদ্র) জাতোদ্ভব। হিন্দু পুরাণে তার শিক্ষক চাণক্যের কথা বেশি বলা হয়েছে, চাণক্যকে ‘কিং মেকার’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

২০০১ সালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সম্মানে ইস্যুকৃত স্ট্যাম্প

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মায়ের নাম ছিলো মুরা। ধারণা করা হয়, ‘মুরা’ নাম থেকে ‘মৌর্য’ শব্দটি এসেছে। মৌর্য বংশকে শাক্য বংশের একটি শাখা মনে করা হয়, যে শাক্য বংশে গৌতম বুদ্ধ জন্ম নিয়েছিলেন। চন্দ্রগুপ্তের মা মুরা ছিলেন শুদ্রাণী বা শুদ্র জাতের। বিশাখাদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন নন্দ রাজ্যের একজন রাণীর দাসী। অত্যাচারী নন্দ রাজা সুন্দরী মুরাকে ধর্ষণ করে এবং এর ফলে মুরার গর্ভসঞ্চার হয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জন্ম হয়। পরবর্তীতে লোকলজ্জার ভয়ে শিশু চন্দ্রগুপ্ত ও দাসী মুরাকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করা হয়। সুতরাং, নন্দ বংশের পতনের পেছনে যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ব্যক্তিগত প্রতিশোধপরায়ণতা কাজ করে নি, এ কথা হলফ করে বলা যায় না।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উপাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘চন্দ্রশ্রী’, ‘প্রিয়দর্শন’ ও ‘ভ্রিশাল’। ‘ভ্রিশাল’ অর্থ হলো শুদ্রের সন্তান। তার তিনজন স্ত্রী ছিলেন- মহাপদ্ম নন্দের মেয়ে নন্দিনী, গ্রীক বংশোদ্ভূত সেলিউকাসের মেয়ে হেলেনা এবং দুর্ধরা। দুর্ধরার গর্ভেই তার একমাত্র ছেলে বিন্দুসারের জন্ম হয়। অবশ্য দুর্ধরার গর্ভে কেষ্ণক নামক আরেকটি ছেলের জন্ম হয়েছিলো প্রথমে, কিন্তু জন্মের তিন দিনের মধ্যে সেই শিশুপুত্র মারা যায়। তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার সময় মৌর্য সাম্রাজ্যের দায়িত্ব বিন্দুসারকে দিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বিন্দুসারের ছেলেই হন মৌর্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট, দ্য গ্রেট অশোক।

শ্রাবণবেলগোলায় এই পদচিহ্ন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের বলে মনে করা হয়।

কিং মেকার চাণক্যের বিশ্বাস ছিলো, শত্রুপক্ষ চন্দ্রগুপ্তকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করতে পারে। তাই বিষের প্রতি অনাক্রম্যতা তৈরীর উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিদিন চন্দ্রগুপ্তের খাবারে অল্প পরিমাণে বিষ মিশিয়ে দিতেন। চন্দ্রগুপ্ত এই ব্যাপারে জানতেন না। তাই একদিন সেই বিষমিশ্রিত খাবার তিনি গর্ভবতী দুর্ধরার সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছিলেন। এতে দুর্ধরা মারা যায় এবং তার গর্ভের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য চাণক্য তার পেট কেটে বাচ্চা বের করে আনেন। এই শিশুই পরবর্তীকালের মৌর্য বংশের দ্বিতীয় সম্রাট বিন্দুসার।

সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর থেকেই মৌর্য সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে এবং পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই শেষ সম্রাট বৃহদ্রথকে তারই সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ হত্যা করে শুঙ্গ সাম্রাজ্যের সূচনা করে, আর এভাবেই ভারতবর্ষের সবচেয়ে বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্য চিরতরে হারিয়ে গেছে।