চীনের নানজিং এর পূর্ব পাশে চমৎকার এক সমাধিক্ষেত্র হলো জিয়াওলিং সমাধিক্ষেত্র। চমৎকার সব বিশালকায় প্রাণী ও মানুষের জোড়া মূর্তিগুলো পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পথে যেতে যেতে ছোট্ট একটি প্রবেশপথের ভেতর শায়িত আছেন তেরো জন মিং বংশধর। সাদামাটা প্রবেশপথের সেই সমাধির ছাদটি অনেক দূর থেকেও চোখে পড়বে তার রঙিন বেশের কারণে। ছাদের লাল রংটি যেনো একেবারে সিঁদুর-লাল। কারণ এই তেরোটি মিং সমাধির মাঝে শুয়ে আছেন স্বয়ং মিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ঝু-ইউয়ানঝাং, যার নামের ‘ঝু’ অংশের অর্থই হলো ‘ভারমিলিয়ন’ বা ‘সিঁদুর-লাল’। ঝু-ইউয়ানঝাং এর সম্মানকে স্পষ্ট ও অর্থবহ করবার জন্যই হয়তো তার সমাধির সুউচ্চ ছাদটিকে এমন রঙিন রূপ দেয়া হয়েছে।

জিয়াওলিং সমাধিক্ষেত্র

জিয়াওলিং সমাধিক্ষেত্র

১৩২৮ সালে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা ঝু-ইউয়ানঝাং মাত্র ১৬ বছর বয়সে পুরো পরিবারকে হারিয়ে ফেলেন। তাকে একটি বৌদ্ধ মঠে শ্রমিক হিসেবে পাঠানো হয়। বৌদ্ধ মঠেই তিনি শিক্ষা লাভ করেন। সে সময় ইউয়ান সাম্রাজ্যে মঙ্গোলীয়দের শাসন চলছে। আর এই মঙ্গোলীয়দের বিরুদ্ধে মৌলবাদী বৌদ্ধদের বিদ্রোহ ‘সাদা পদ্ম বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত ছিলো। ধীরে ধীরে এই বিদ্রোহ ডাল-পালা মেলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে এরই একটি শাখা গড়ে ওঠে ‘লাল পাগড়ি বিদ্রোহ’ নামে। ১৩৫২ সালে এই বিদ্রোহের সাথে জড়িয়ে যান ঝু-ইউয়ানঝাং। তখন এর নেতৃত্বে ছিলেন গুয়ো-জিজিং। পরবর্তীতে গুয়ো-জিজিং এর একটি পালিত মেয়েকেই বিয়ে করেছিলেন ঝু-ইউয়ানঝাং এবং খুবই অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় ত্রিশ হাজার ইউয়ান সেনাবাহিনীসমেত লাল পাগড়ি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন তিনি।

The Hongwu Emperor

হংউ সম্রাট, মিং রাজবংশের প্রথম সম্রাট (১৩৬৮ থেকে ১৬৪৪ সিই)

১৩৫৬ সাল। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, বন্যা, প্লেগ, দস্যুর আক্রমণ, বিদ্রোহ ও আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত ইউয়ান প্রদেশের মঙ্গোলীয় অধিবাসীরা। তাদের দুর্বলতার সুযোগে ঝু-ইউয়ানঝাং দখল করে নিলেন নানজিং। নানজিং অধিকার ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। এর আগেও বহু বার তিনি চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু নানজিং ধরে রাখতে পারেন নি। তবে এই বার বুঝে-শুনেই পা বাড়িয়েছেন তিনি। নানজিংকে তিনি নতুন নাম দেন ‘ইয়িংশিয়ান’।

ঝু-ইউয়ানঝাং এরপর আরও বেশ কয়েকটি যুদ্ধে জয় লাভ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৩৬৩ সালে চেন-ইউলিয়াং এর বিরুদ্ধে পয়াং হ্রদের যুদ্ধ এবং ১৩৬৭ সালে ঝাং-শিনচেং এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তবে একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শুধুমাত্র যুদ্ধের মাধ্যমে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই তিনি একটি পরিপূর্ণ সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন এবং ১৩৬৮ সালে তিনি নিজেকে মিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রথম মিং সম্রাট ঝু-ইউয়ানঝাং ‘হংয়ু সম্রাট’ নামেও পরিচিত হন। আর তার রাজধানী হয় নানজিং।

মিং সম্রাট ঝু-ইউয়ানঝাং সে সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাবান শাসকে পরিণত হন। শুধু তা-ই নয়, মিং সাম্রাজ্য পরিণত হয় পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রে। স্থাপত্য, শিল্পকলা ও শিক্ষায় মিং সাম্রাজ্যের জুড়ি ছিলো না। মিং সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানাও ছিলো সবচেয়ে বিস্তৃত। তারা একটি চীনকেন্দ্রিক বিশ্ব গড়ে তুলবার স্বপ্ন দেখেছিলো এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছিলো।

Map of the Ming Dynasty Territory

মিং রাজবংশের অঞ্চলের মানচিত্র

ঝু-ইউয়ানঝাং এর ত্রিশ বছরের সগৌরব শাসনের পর মিং সাম্রাজ্য আরেকটি স্বর্ণযুগ উপহার দিতে সক্ষম হয় তার চতুর্থ ছেলে ঝু-ডির শাসনামলে, যিনি ‘ইয়ংলে সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত হন। ঝু-ডি নিজের ভাইয়ের ছেলেকে হত্যা করে মিং সিংহাসনে বসেন, আর মিং সাম্রাজ্যের রাজধানী বেইজিং-এ স্থানান্তরিত করেন। এ সময় তার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন ঝেং-হে। হ্যাঁ, সেই কিংবদন্তি খোঁজা অ্যাডমিরালের কথাই বলছি যিনি শ শ বিরাটকায় জাহাজ নিয়ে সমুদ্র চষে বেড়িয়েছেন; ঘুরে বেড়িয়েছেন সমগ্র এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা; উন্মুক্ত ও বিস্তৃত করেছেন চীনের বাণিজ্য-সম্ভাবনার দ্বার; আর চীনকে পৌঁছে দিয়েছেন গৌরবের চূড়ায়। ঝু-ডির আগ্রহে অসীম সাহসী ঝেং-হে একের পর এক মোট সাতটি সমুদ্র অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অসংখ্য দেশ ঘুরে তৈরী করেছেন চীনের জন্য এক অঘোষিত কলোনি। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যগুলো, যেমন, ইউরোপ, আমেরিকার বহু আগেই চীন গুরুত্বপূর্ণ এসব অনুসন্ধান অভিযান পরিচালনার সাহস দেখিয়েছিলো এবং এটি সম্ভব হয়েছিলো মিং শাসনামলেই।

Temple of Heaven, Forbidden City

স্বর্গের মন্দির, নিষিদ্ধ শহর (Forbidden City)

মিং সাম্রাজ্য শুরু থেকেই পোর্সেলেইন বা চীনামাটির বাসন তৈরীতে প্রসিদ্ধ ছিলো। তাদের নীল ও সাদা পোর্সেলেইনের কোনো জুড়ি ছিলো না। বারুদের ব্যবহারভিত্তিক অস্ত্রসামগ্রী, জাহাজ নির্মাণ, নেভিগেশন বা নৌ পরিচালনার দক্ষতা, সিল্ক বা রেশম এবং নীল ও সাদা পোর্সেলেইন চীনের বাণিজ্যকে উৎকর্ষের শীর্ষে উপনীত করেছিলো। ইউরোপের সাথে চীনের বাণিজ্য এ সময় সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলো।

পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য চীনের মহাপ্রাচীরের বেশিরভাগ অংশ মিং শাসনামলেই নির্মিত হয়েছিলো। আর ১৪০৬ সাল থেকে ১৪২০ সাল পর্যন্ত টানা নির্মাণকাজ চলেছে ‘দ্য ফরবিডেন সিটি’-খ্যাত বেইজিং এর বিখ্যাত সেই প্রাসাদের, যেটিতে সম্রাট ছাড়া অন্য কারো প্রবেশাধিকার ছিলো না। সম্রাট ঝু-ডির আমলে এটি নির্মিত হয়েছিলো। প্রায় সাত লক্ষ বিশ হাজার বর্গমিটারের এই নিষিদ্ধ শহর নির্মাণ মিং সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর মধ্যে একটি। প্রাচীন চীনা বিশ্বাসের স্বর্গীয় প্রাসাদ ‘দ্য পার্পল প্যালেস’ এরই প্রতিরূপ ছিলো এই নিষিদ্ধ শহর। চীনের শিল্প ও সংস্কৃতির এক অদ্ভূত সমারোহ ঠাঁই পেয়েছিলো এই প্রাসাদ অঙ্গনে। এ ছাড়াও সম্রাট ঝু-ডির সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খাল ‘গ্র্যান্ড ক্যানাল’ পুনঃনির্মিত হয়েছিলো।

Watchtower at the Great Wall of China

চীনের মহাপ্রাচীরটি কিন রাজবংশের (২২১-২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সময় শুরু হয়েছিল কিন্তু সেই মূল প্রাচীরের সামান্যই অবশিষ্ট রয়েছে। বর্তমানে লোকেরা যে প্রাচীরটিকে চিনতে পারে তা মূলত মিং রাজবংশের (১৩৬৮-১৬৬২ সিই) তৈরি করেছিল।

১৩৬৮ থেকে ১৬৪৪ সাল পর্যন্ত ২৭৬ বছর শাসন করা প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে উন্নত মিং সাম্রাজ্য তার নামের অর্থ ধরে রেখেছিলো দীর্ঘ দিন। ‘মিং’ শব্দের অর্থ ‘ঔজ্জ্বল্য’। নিজেদের নামের মতোই চীনে ঔজ্জ্বল্য বজায় রেখেছিলো মিং –রা। তবে সম্রাট ঝু-ডির মৃত্যুর পর থেকে ধীরে ধীরে কূটনৈতিক অভিযানগুলো কমে যেতে থাকে এবং একটা পর্যায়ে চীন বাইরের বিশ্বের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই সিদ্ধান্ত চীনকে একটি অব্যাহত পতনের দিকে ঠেলে দেয়।

মিং সাম্রাজ্যের বহুমুখী অভিযানগুলো এবং বহিঃর্বিশ্বের সাথে তাদের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়গুলোই মূলত তাদের উন্নয়নের চাবিকাঠি ছিলো। কিন্তু ১৪৩৩ সালে ঝেং-হের মৃত্যুর পর থেকে আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, খোঁজা সমাজকে দমনের প্রবণতা ও হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে চীন ঘোষণা করে বসে যে, চীনের পক্ষে যে কোনো ধরনের অভিযান পরিচালনার ব্যয় বহন করা কষ্টকর এবং তারা বাইরের পৃথিবীর সহায়তা ছাড়াই এককভাবে তাদের উন্নয়ন ধরে রাখতে সক্ষম। নিজেদেরকে বিশাল মহাপ্রাচীরের বেষ্টনীতে আবদ্ধ করে নতুনভাবে জীবনযাপন শুরু করলো চীনারা, যার ফলাফল ১৬৪৪ সালে অর্থনীতিতে সবচেয়ে সফল মিং সাম্রাজ্যের দুঃখজনক পতন।

Ming Dynasty Blue-and-White Porcelain

মিং রাজবংশের নীল-সাদা চীনামাটির বাসন

ইউরোপের যুদ্ধের কারণে স্পেন ও জাপানের সম্রাটদের সহযোগিতা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। মিং সাম্রাজ্যে রূপা আসা বন্ধ হয়ে গেলো, বাণিজ্যের অবনতি হতে শুরু করলো এবং কর প্রদানের প্রধান মুদ্রা রূপার দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেলো। এদিকে জনগণও কর দিতে পারছিলো না এবং ব্যাপক আর্থিক সংকট তৈরী হওয়ায় চীনা সরকারও জনগণকে সাহায্য করতে অক্ষম ছিলো। সৈন্যদের বেতনও ঠিকভাবে দেয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। অনাহারী কৃষক, শ্রমিক ও সৈন্যদের মধ্যে ধীরে ধীরে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করলো। এরই মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতক মিং জেনারেল মহাপ্রাচীরের সাংহাই প্রবেশপথ দিয়ে মাঞ্চুরিয়ার ‘মাঞ্চু’ অধিবাসীদের প্রবেশের সুযোগ করে দিলো। বিদ্রোহী সেনাবাহিনী এবং মাঞ্চুদের হাতেই ১৬৪৪ সালে মিং সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

 

রেফারেন্স: