ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মীরজাফরের নাম যতবার উঠে এসেছে, জগৎশেঠের নাম ততবেশি শোনা যায় না। যাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন, তাদের মধ্যে জগৎশেঠ ছিলেন অন্যতম। 

রাজা বল্লাল সেনের সময় বাংলার স্বর্ণ ব্যাবসায়ীরা একেবারেই ঘরে বসে যায়। ঠিক তখনই বাংলার ব্যাংকিং জগতে মাথা ঢোকানোর সুযোগ পেয়ে যায় বিদেশী শেঠরা।

মোঘল আমলে মাড়োয়াররা ভারতীয় উপমহাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। মাড়োয়ারের পালি বাজার ছিল পশ্চিম ভারতের সমুদ্র উপকূল ও উত্তর ভারতের ব্যবসার সংযোগস্থল। এখন থেকেই ইউরোপীয়রা ভারতীয় পণ্য এবং ভারতীয়রা ইউরোপীয়, আরব, আফ্রিকা ইত্যাদি দেশের পণ্য আমদানি – রপ্তানি করতো। মাড়োয়াররা ছোট বেলা থেকেই এই ব্যবসাগুলো বুঝতো। কিন্তু বিরূপ, শুষ্ক আবহাওয়া ও অনুর্বর অঞ্চলের কারণে তারা নিজেদের জন্মভুমিতে টিকতে পারেনি এবং ১৬৫২ সালে হিরানন্দ সাহু নাম একজন মাড়োয়ার বাংলার পাটনায় এসে বসবাস শুরু করেন।  

পরবর্তীতে তিনি পাটনা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হন এবং একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তখন থেকেই তারা ছোট খাটো ধার দিয়ে ব্রিটিশদের ব্যাবসায় বিনিয়োগ করতো। ভারতবর্ষে তখনও তারা পরিচিত হয়ে ওঠেনি।

বাংলা ছিল মোঘল আমলের সব থেকে সম্মৃদ্ধশালী সুবাহ। আর ঢাকা ছিল তার রাজধানী। সেই সময় শুধু ঢাকার নদী বাণিজ্য পথ থেকেই বছরে আয়ের পরিমান ছিলো এক কোটি টাকারও বেশি। ডাচ, ফরাসি, ইংরেজরাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের ব্যবসায়ীরা প্রচুর পণ্য কিনতো এই ঢাকা থেকে। হিরানন্দ সাহুর ব্যবসা ছিল সেইসব ব্যবসায়ীদের অর্থ ধার দেয়া ও টাকা ভাঙানো। ঢাকার এই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার প্রধান শর্তই ছিল সময়মতো টাকা ধার পাওয়া ও পরিশোধ করা। যার ফলে হিরানন্দ সাহুর ব্যবসা রাতারাতি ফুলে ফেঁপে উঠেছিল।

তার সাত ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মানিকচাঁদ বাবার ব্যবসায় জড়িত ছিল। মুর্শিদকুলি খান ঢাকা থেকে মুকসুদাবাদে (বর্তমান মুর্শিদাবাদ) রাজধানী সরিয়ে নিলে মানিকচাঁদ নতুন রাজধানীতে তাদের নতুন কুঠি খোলেন। ঢাকা থেকে রাজধানী সরানো হলেও নায়েব সুবেদারী থেকেই যায় এবং টাকা ছাপানোর টাকশালও রয়ে যায়। টাকশালটি ছিল বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে পরবর্তীতে যা মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করা হয়। মানিকচাঁদের ব্যবসা তখন খুব রমরমা অবস্থা। ঢাকা ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ কুঠি।  ঢাকার বাইরেও কলকাতা, বেনারস, হুগলি ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যবসার জায়গায় তাদের নতুন নতুন কুঠি খুলতে শুরু করেন। মুর্শিদাবাদে মানিকচাঁদ ছিলেন নবাবের খুব প্রিয় মানুষ এবং পরবর্তীতে নবাবের ব্যাংকার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯১৪ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যুর পরে তার ছেলে ফতেহ চাঁদ এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৭২৩ সালে সম্রাট মাহমুদ শাহ তাকে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি প্রদান করেন। এতে বোঝা যায়, দিল্লিতেও তারা তাদের কুঠি খুলতে সমর্থ হয়েছিল।

তখনকার বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ থেকে জানা যায়, এই মাড়োয়ারি হিন্দু পরিবারটি ছিল ভারতবর্ষ ও মোঘল সাম্রাজ্যের সব থেকে বড় ধনী। তাদের লেনদেনকে ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডের সাথে তুলনা করা হয়েছিল। শেঠেরা সরকারি রাজস্ব জমা গ্রহণ করতো, জমা দিতো ও নবাবরা এর মাধ্যমেই তাদের বার্ষিক যায় দিল্লিতে পাঠাতো। শেঠদের কুঠি থেকে পরে নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা দিল্লির দরবার থেকে হুন্ডি হিসেবে কাটা হতো। ডাচ বিবরণীতে এই শেঠদের সব থেকে বড় মানি চেঞ্জার হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। বাংলার বাইরে থেকে যেসব মুদ্রা বাংলা বিহারে আসতো সবই পরিবর্তনের বাটা নির্ধারণ কত শেঠের কুঠি। এছাড়া দামি ধাতু ভাঙিয়ে টাকশাল মুদ্রা করতে শেঠের কুঠি বাটা নিতো। 

১৬৫০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বসবাস শুরু করে এবং মোঘলদের কাছ থেকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার অনুমতি নেয়। তারা বছরে তিন হাজার টাকা প্রদানের বিনিময়ে এ অধিকার পায়। তারা হুগলি ও কাশিমবাজারে বাণিজ্যকেন্দ্র খোলে এবং কলকাতা গোবিন্দপুর ও সুতানটি নামে তিনটি গ্রাম কিনে সেখানে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু মুর্শিদকুলি খানের সময় থেকেই ব্রিটিশদের সাথে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের ভুয়া ফরমান নিয়ে নবাবের সাথে তাদের দ্বন্দ্বের শুরু হয়। বলা হয় এটি ছিল পরবর্তী পলাশীর যুদ্ধের কারণ। আসলে আরও অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ ছিল ফরাসিদের সাথে বাঙালির সুসম্পর্ক। ব্রিটিশদের সাথে ফরাসিদের ৭ বছরের একটি দীর্ঘ যুদ্ধ হয়। সেই কারণেই বাঙালির সাথে ফরাসিদের এই সম্পর্ক তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই এই পলাশীর যুদ্ধ শুধু মাত্র একটি খন্ড যুদ্ধ নয়, বরং এটি ছিল সমস্ত বিশ্বের যুদ্ধ।

১৭১৭ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত শেঠদের ব্যবসা ছিল খুবই জাকজমকপূর্ণ। ১৭৪০ সালে সিংহাসন লাভের লড়াইয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা আলীবর্দী খাঁকে সাহায্য করেছিল। এমনকি সরফরাজ খানের মৃত্যুর পর তারা আলীবর্দী খাঁয়ের জন্যে দিল্লির ফরমানেরও ব্যবস্থা করেছিল। এভাবেই তারা নবাবদের তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতো।

পলাশীর যুদ্ধের পিছনে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা দায়ী ছিল। আর এই অর্থনীতির রাশ ছিল এই জগৎশেঠদের হাতে। বলা হয়, পলাশীর চক্রান্ত সফল করার উদ্দেশ্যেই তারা ব্রিটিশদের ৩ কোটি টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা ভেবেছিলো ব্রিটিশরা তাদের ব্যবসার মুনাফা নিয়ে এই দেশ থেকে চলে যাবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি, ব্রিটিশরা মনে মনে অন্য পরিকল্পনা এঁটেছিলো। পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা মুর্শিদাবাদের কোষাগার লুট করে। সেসময় মুর্শিদাবাদের কোষাগারে ছিল প্রায় ৪০ কোটি টাকা। শেঠরা এই লুটের বিরোধিতা করেছিলো। তারা চায়নি তাদের পরবর্তী পুতুল নবাব খালি হাতে তার রাজত্ব শুরু করুক।

পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার বাণিজ্য শেঠদের জন্য নিরপেক্ষ হয়ে যায়। জগৎশেঠ মাহতাব রাই ও রাজা স্বরূপচাঁদ নিজেদের তৈরী ষড়যন্ত্রে নিজেরাই ডুবে মরলেন। টাকশালের ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লেন। ব্রিটিশরাও আর তাদের কাছ থেকে টাকা ধার করেনি। অন্যদিকে সারা ভারত জুড়ে গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট ব্যাবসায়ীর দল। ব্যবসার পতন ঠেকানো তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলো। ১৭৪০ সালের পর জগৎশেঠরা যেভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই ১৭৫৭ সালের বিশ্বাসঘাতকতা তাদেরকে মিশিয়ে দিয়েছিলো মাটির সাথে। পরবর্তীতে মীর কাশিম ১৭৬৩ সালে শেঠ পরিবারের উত্তরাধিকারী দুই ভাইকে হত্যা করে এই শেঠ পরিবারের পতন ঘটায়।

১৭৭৩ সালে রাজধানী কলকাতাতে স্থানান্তরিত হলে এবং বাংলার নবাবের কাছ থেকে ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমতা চলে এলে জগৎ শেঠ পরিবারের কার্যক্রম চিরকালের মতো অবসান ঘটে।

 

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

হিন্দু দেব-দেবীর ধারণা প্রাচীন মধ্য এশীয় বিশ্বাসেরই প্রতিরূপ নয় তো?

সিংহবাহনের ওপর এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য নিয়ে চার হাতবিশিষ্ট এক দেবী যুদ্ধবাজ ভঙ্গিমায় আসীন নিজের সন্তানদের প্রতিরক্ষার জন্য। খুব পরিচিত লাগছে তাই না? নিশ্চয়ই দেবী দুর্গার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এ তো দুর্গা নয়, ব্যাক্ট্রিয়ান মাতৃদেবী ‘নানায়াহ’ বা ‘ননা’...

মহাবীর কর্ণের অন্তিম যাত্রা

সূর্যদেব অস্তে চলে যাচ্ছেন। গোধূলিবেলার লালচে আলোতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার এই জন্মের শত্রুকে। তার গান্ডিব ধরা উদ্ধত হাতে চকচক করছে অঞ্জলিক বাণ, যা আমার মস্তক ছেদ করার জন্য একটু পরেই ছুটে আসবে।পান্ডব বীর অর্জুন, যে আমার চরম শত্রু আবার আমার সহদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।ওই...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...