ভারতবর্ষের সভ্যতা যেমন অনেক পুরনো, গ্রীক সভ্যতাও তেমনি খুব প্রাচীন। গ্রীক সভ্যতার অতি প্রাচীন সাহিত্য-সমগ্রকে বলা যেতে পারে এক মূল্যবান ভান্ডার। এখানে রয়েছে দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞানের অনেক প্রাচীন তত্ত্ব। আমাদের অনেকের হয়তো জানতে ইচ্ছে করে, এসব অমূল্য সাহিত্যকর্মে ভারতবর্ষ নিয়ে বিবরণ কেমন ছিল, প্রাচীনকালে গ্রীকরা কখন থেকে প্রথম ভারতবর্ষ সম্বন্ধে জানা শুরু করে, ভারতবর্ষ নিয়ে তাদের জানার আগ্রহই বা কেমন ছিল। বৃটিশরা ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবার বহু আগে থেকেই গ্রীক, রোমান ও আরবরা প্রাচীন ভারতকে জেনে গিয়েছিলো কিছুটা। ফা হিয়েন, হিউয়েন সাঙ্গ, আল-বিরুনি, ইবনে বতুতার মতো পর্যটকরা ভারতবর্ষ সম্পর্কে অনেক মূল্যবান বিবরণী লিখে গিয়েছেন বিশ্বের জন্য।

খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে সবচেয়ে প্রাচীন বিবরণটি করে গেছেন গ্রীক ঐতিহাসিক এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের শাসনামলে সম্রাট সেলুকাসের রাষ্ট্রদূত মেগাস্থেনিস তার “ভারতবিবরণ” (The Indica) নামের গ্রন্থে। মেগাস্থেনিসই যে সর্বপ্রথম ভারতবর্ষকে গ্রীকদের কাছে উপস্থাপনা করেছিলেন, এ ধারণাটি সঠিক নয়। মেগাস্থেনিসেরও অনেক আগে গ্রীক সাহিত্যে ভারতবর্ষের উল্লেখ করে গেছেন অনেক প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যিকরা। গ্রীসের বিভিন্ন পুরোনো সাহিত্যকর্ম, এমনকি তাদের কাব্যগ্রন্থগুলো গভীরভাবে নিরীক্ষা করলে দেখা মেলে ভারতবর্ষ নিয়ে অনেক চমৎকার সব বর্ণনার। আসুন, খুলে দেখা যাক সেই গ্রীক সাহিত্যে-ভান্ডারের কিছুটা।

খ্রীষ্টপূর্ব ১২০০-৯০০ শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচীন গ্রীসে শুধু ভারতবর্ষ কেন, বিশ্বের অস্তিত্ব নিয়েই গ্রীকদের জ্ঞান ছিল বলতে গেলে শূন্য। কিন্তু এর পরিবর্তন হতে শুরু হয় আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ শতাব্দী থেকে। ঐ সময় থেকে গ্রীকরা ধীরে ধীরে পৃথিবী সম্বন্ধে ইতিহাস-সমৃদ্ধ জ্ঞান অর্জনে কিছুটা কৌতূহলী হয়ে উঠে। তাদের এই নতুন জ্ঞান আরোহনের স্পৃহা ছিল এ’র পূর্বের মহাকাব্য-যুগের জ্ঞান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাচীনকালে হোমর (Homer) এবং তার সমসাময়িক কবিরা কাব্য রচনা করতেন মূলত তাদের কল্পনাপ্রসূত জ্ঞান, ভাষার বর্ণিল ব্যবহার, এবং কিছুটা লোকশ্রুতির উপর ভিত্তি করে। আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ শতাব্দীতে হোমর তার ওডেসী (Odyssey) কাব্যে ভারতবর্ষ নিয়ে কিছুটা উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু তা’ ছিল খুবই সামান্য। দেখা যাচ্ছে, হোমরের সময়ে গ্রীকরা ভারতবর্ষ সম্মন্ধে অজ্ঞ ছিল না পুরোপুরি।

প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে ভারতবর্ষ

ইন্দো-গ্রীক রাজ্য, © Wikimedia

ধারণা করা হয়, খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০ শতাব্দী থেকে গ্রীকদের ইতিহাস বিষয়ক জ্ঞান এবং সাহিত্য চর্চার আমূল পরিবর্তন হতে থাকে। এই সময় থেকে যদিও তাদের কাব্য চর্চার অবনতি হতে থাকে দ্রুত, কিন্তু বিশ্ব-ইতিহাস এবং বিশ্বতত্ত্বের প্রতি তাদের আগ্রহ বেড়ে যায় অনেক। এই আগ্রহের ফলে, প্রথমে দর্শনের প্রতি গ্রীকদের অনুসন্ধান এবং দার্শনিক চিন্তার উৎকর্ষ হলো প্রচুর। ধীরে ধীরে দর্শনের পর ভূগোল, এবং তারপর ইতিহাসের প্রতি মানুষের অনুরাগ প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেতে থাকে। সৃষ্ট হতে থাকে এসবের উপর আলাদা আলাদা জ্ঞানচর্চার বিষয়। প্রতিষ্ঠা পেলো দর্শন, ভূগোল এবং ইতিহাসের মতো বিষয়গুলোর। তাই বলে, কল্পনা-প্রিয়তা এবং কল্পনাপ্রসূত-কাব্যের প্রতি গ্রীকদের অনুরাগ কিন্তু একেবারে বিলীন হয়ে গেলো না। দর্শন, ভূগোল, এবং ইতিহাস হয়ে পড়লো বেশীরভাগ গ্রীকদের মননের প্রধান আহার, আর কাব্য হয়ে পড়লো অপেক্ষাকৃত গৌণ।

গ্রীক চিন্তাবিদ আনাক্ষীমন্দার (Anaximander) খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ট শতকে সর্বপ্রথম একটি নিবন্ধে সমগ্র পৃথিবীর একটি ভৌগোলিক বিবরণ দেন, যেখানে ভারতবর্ষের উল্লেখ ছিল অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে। আনাক্ষীমন্দার পর হেকটয়েস (Hecataeus) এবং হেরোডোটাস (Herodotos) তাদের রচনায় ভারতবর্ষের অনেক বিস্তারিত বর্ণনা দেন। হেকটয়েস এবং হেরোডোটাসের ভারতবর্ষ নিয়ে বর্ণনার প্রধান উৎস ছিল কারিয়ানডাবাসী এক পর্যটক, যার নাম ছিল স্ক্যালাক্স (Scylax)। স্ক্যালাক্স পারস্যের সম্রাট দারিয়ুসের আমন্ত্রণে খ্রীষ্টপূর্ব ৫৪০ সালে সিন্ধু নদীর উৎস খোঁজার জন্য বের হয়ে পড়েন এক নৌযান নিয়ে। তিনি ভারতবর্ষে তার নৌ ভ্রমণের বিবরণ দেন এক গ্রন্থে।
স্ক্যালাক্সর পর, হেকটয়েস এবং তার পরে হেরোডোটাস ভারতবর্ষ নিয়ে লেখেন তাদের নিজ নিজ গ্রন্থে। হেকটয়েস তার “পৃথিবীর মানচিত্র” নামের বইতে ভারতবর্ষের অনেক জাতি এবং জায়গার নাম উল্লেখ করেন। হেরোডোটাসও তার ইতিহাস বইটির তৃতীয় ভাগের ৯৮ হতে ১০৬ অধ্যায়ে পারস্যের উপর লেখার সময় ভারতবর্ষেরও বর্ণনা দেন কিছুটা। যেমন, হেরোডোটাস তার ইতিহাস গ্রন্থে সিন্ধু, কালাটিয়াই (Kalatioi) জাতি, গান্ধারবাসী, কাশ্যপপুর, ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন অনেক বিশদভাবেই। হেকটয়েস এবং হেরোডোটাস, দু’জনই ভারতবর্ষে মরুভূমির অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন।

পরবতীতে, অন্যান্য গ্রীক ইতিহাসবিদরা তাদের রচনায় ভারতবর্ষের বর্ণনায় স্ক্যালাক্স এবং হেকটয়েসের গ্রন্থকে বেশী অনুসরণ করেছেন। যেমন, খ্রীষ্টপূর্ব ৪০৫ সালে গ্রীক চিকিৎসক এবং ইতিহাসবিদ স্টেসিয়াস (Ctesius) পারস্য এবং ভারতে অবস্থান করেছিলেন। তার ইতিহাস বর্ণনা প্রণালী স্ক্যাটেক্সের বিবরণের মতোই। স্টেসিয়াস থেকে আলেক্সান্ডারের সময় পর্যন্ত, প্রায় একশো বছর, গ্রীকরা ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তেমন একটা নতুন কিছু জানতে পারে নি। তখন কল্পনানির্ভর কাব্যগ্রন্থ আবারো হয়ে পড়ে গ্রীকদের মূল সাহিত্য-কেন্দ্রিক বিনোদনের মূল উৎস। দর্শন, ভূগোল এবং ইতিহাসের প্রতি পূর্বের আগ্রহকে দেওয়া হয় সাময়িক ছুটি। এগুলো হয়ে পড়ে বিকেলের অপরাহ্নের স্ন্যাকের মতো আনুষঙ্গিক। ঐ সময়ে যারাই ভারতবর্ষ নিয়ে লিখে গেছেন, প্রায় সবাই পূর্ববর্তী ইতিহাসবিদ যেমন স্ক্যালাক্স এবং হেরোডোটাসের সংগৃহিত ভারতবর্ষের ইতিহাস পুনাবৃত্তি করে গিয়েছেন, নতুন কোন তথ্য দিতে পারেন নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ইউডোক্সস (Eudoxus) এবং ইফরুস (Ephorus) ঐ সময়টিতে ভারতবর্ষকে নিয়ে যা’ লিখে গিয়েছেন, তা’র প্রায় সবটুকুই হেরোডোটাসের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত। ঐ সময়কার বেশীরভাগ গ্রীক সাহিত্য এবং ইতিহাসে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে প্রকাশিত নতুন চমকপ্রদ তথ্য ছিল খুবই সামান্য, এমনকি কোন কোন গ্রন্থে ভারতবর্ষ নিয়ে দেওয়া তথ্য ছিলো ভুল। পরবর্তীতে এসব অসম্পূর্ণ এবং ভুল তথ্য আলেকজান্ডারকে ভারতবর্ষ অভিযানে বিভ্রান্তি করেছিল অনেকভাবে।

আলেকজান্ডারের আমলেই ভারতবর্ষ নিয়ে জ্ঞান আরোহনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। তার সময়ে গ্রীকরা সিন্ধুনদের তীরবর্তী প্রদেশগুলো থেকে শুরু করে বিপাশা নদীর উৎপত্তি পর্যন্ত ভূ–ভাগ ভালোভাবে দেখার সুযোগ পায়। ঐ সময়ে গ্রীকরা বিপাশার পশ্চিম পার্শ্ববর্তী প্রদেশসমূহ, এমনকি হিমালয় এবং তাম্রপর্নীর মধ্যবর্তী ভূ–ভাগ সম্বদ্ধে অনেক বিস্তারিত লিখে গিয়েছেন। আলেকজান্ডারের সময়ে বর্ণিত ভারতবর্ষের বিবরণ পূর্বের বেশীরভাগ সত্য-মিথ্যা বর্ণনাকে গ্রীকদের মন থেকে দ্রুত বিলীন করে দিলো। আলেকজান্ডারের সহচররা ভারতবর্ষ নিয়ে অনেক গ্রন্থ লিখে গিয়েছিলেন, যা’র বেশীরভাগই এখন বিলুপ্ত। তবুও বিচ্ছিন্নভাবে আংশিক যেটুকু বিবরণ পাওয়া গিয়েছে, সেগুলো থেকে বোঝা যায় যে, তার সহচররা ভারতবর্ষ প্রত্যক্ষ করেই তা’ তাদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে ভারতবর্ষ

মেগাস্থিনিস পাটলিপুত্রে ভারতীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে তাঁর পরিচয়পত্র পেশ করছেন। © elinepa.org

আলেকজান্ডারের সহচরদের মধ্যে যারা ভারতবর্ষ নিয়ে লিখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্যাক্টও ডিওগণকটুস (Bacto Diognetus), নেয়ারচুস (Nearchus), এরিস্টোবুলুস (Aristobulus), ক্লিটারচুস (Clitarchus), এবং এন্ড্রোসথেনিস (Androsthenis)। এসব লেখকরা নিজেরা ভারতবর্ষে যা’ প্রত্যক্ষ করেছেন, তাই লিপিবদ্ধ করে গেছেন। গ্রীকরা সহজে অন্য জাতির মন-মানসিকতা, সমাজ-সংস্কৃতি এবং আচার-ব্যবহার বোঝার চেষ্টা করতো না। অন্য জাতির গভীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট পর্যবেক্ষণ করার সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ বা আগ্রহ কোনোটাই তাদের ছিল না। এই লেখকরা ভারতবর্ষে যেসব দেখেছেন তাই লিখে গিয়েছেন, কিন্তু কোন বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখ্যা তারা দিয়ে যান নি।

খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর মেগাস্থেনিস ছিলেন ব্যতিক্রম। মেগাস্থেনিস গ্রীক ইতিহাস-ভিত্তিক সাহিত্যকর্মে ভারতবর্ষ নিয়ে বর্ণনার সেই গদবাধা প্যাটার্ন থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসেন। যদিও তার সেই অসাধারণ গ্রন্থ “ইন্ডিকা”র বিলুপ্তি হয়েছে অনেক আগেই। মেগাস্থেনিস ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের শাসনামলে ভারতবর্ষে গ্রীক রাষ্ট্রদূত। তিনি এসেছিলেন সম্রাট প্রথম সেলুকাস নিকাটরের (Seleucus I Nicator) সাম্রাজ্য থেকে। ভারতবর্ষে প্রথম তিনি আসেন আলেকজান্ডারের উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণের সময় তার সহযোগী হয়ে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর, ভারতবর্ষের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য এবং সেলুকাসের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিরোধ। মেগাস্থেনিস এই বিবাদ মিটিয়ে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। পুরস্কারস্বরূপ সেলুকাস তাকে চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী পাটলিপুত্রে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেন।

সম্ভবত ৩০২-২৯৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দের সময়কালে তিনি চার-পাঁচ বছর ভারতবর্ষে ছিলেন। পরবর্তীতে গ্রীসে ফিরে গিয়ে ‘দ্যা ইন্ডিকা’ গ্রন্থটি রচনা করেন। ধারণা করা হয়, মেগাস্থিনিস কাবুল ও পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে পাটলিপুত্রে এসেছিলেন এবং সেখান থেকে আর অন্য কোথাও যাননি। ফলে পাটলিপুত্রের বর্ণনা তার গ্রন্থে যেভাবে বিস্তারিত উঠে এসেছে, এ অঞ্চলের অন্যান্য প্রদেশ নিয়ে তেমনটা ঘটেনি। সেসব অঞ্চল সম্পর্কে তার বিবরণ লোকশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে লেখা, অধিকাংশই নাটকীয় এবং আংশিক সত্য।

মেগাস্থেনিসের মৃত্যুর পর, পরবর্তীতে কিছু গ্রীক সাহিত্যিক, যেমন আরিয়ান (Arrian), স্ট্রাবো (Strabo), ডায়োডরোস Diodorous) প্রমূখ তাদের রচনায় মেগাস্থেনিসের হারিয়ে যাওয়া “ইন্ডিকা” থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন। ফলে ঐ সব উদ্ধৃতির মাধ্যমে “ইন্ডিকা”তে কি ছিল তা’ আংশিক হলেও জানা যায়। ১৮৪৬ সালে, জার্মানীর বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ই. এ. শোয়ানবেক (E. A. Schwanbeck) প্রচুর পরিশ্রম করে “ইন্ডিকা”র ঐসব উদ্ধৃতাংশগুলোকে এক করে “মেগাস্থেনিস ইন্ডিকা” নাম একটি সংকলন প্রকাশ করেন। ১৮৮৮ সালে জন ওয়াটসন ম্যাককিন্ড্রল (John Watson McCrindle) কলকাতা থেকে এ’র একটি ইংরেজী সংস্করণ বের করেন। এই দুটো প্রচেষ্টা থেকেই প্রাচীন গ্রীক রচনায় ভারতবর্ষ সম্পর্কে জানার সুযোগ হয় আমাদের। এখানেই হারানো “ইন্ডিকা”র পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা শেষ হয় নি। বরিশালের প্রতিভাবান বাঙালী লেখক ও অনুবাদক রজনীকান্ত গুহ ছিলেন গ্রীক ও ইংরেজী ভাষার সুপন্ডিত। তিনি বইটির মূল কপি গ্রীক থেকে বাংলায় “মেগাস্থেনিসের ভারত বিবরণ” নামে অনুবাদ করেন।

আথীনেয়স, ক্লিমেন্ট এবং জোসেফসের বই থেকে যেসব সূত্র পাওয়া যায় তা থেকে ধারণা করা হয় যে, ইন্ডিকা বইটি কমপক্ষে চারটি খন্ডে রচিত হয়েছিলো । এছাড়া মেগাস্থেনিসের ভারত বিবরণ থেকে প্রাচীনকালের ভারতবাসীদের আচার- ব্যবহার, নানা জাতির বৃত্তান্ত, ভারতবর্ষের ইতিহাস, দেবদেবী ও ধর্মানুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কেও আমরা জানতে পারি ।

ধারণা করা হয়, মেগাস্থেনিস ভাষার কারুকাজে বর্ণিল বিবরণে না গিয়ে তিনি ভারতবর্ষের নতুন অনাবিষ্কৃত বিষয়গুলো উল্লেখ করতে বেশী আগ্রহী ছিলেন। মেগাস্থেনিস ভারতবর্ষের সীমানা সঠিকভাবে নির্ণয় করে তার ভূ–বৃত্তান্ত দেন। গ্রীকদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই কাজটি মোটামুটি সফল ভাবে করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং ভারতবর্ষের দৈর্ঘ্য ১৬ হাজার স্টাডিয়ম (১ স্টাডিয়ম=৬০৬ ফুট ৯ ইঞ্চি) বের করেন। সিন্ধুনদ থেকে পাটলিপুত্র পর্যন্ত ১০ হাজার স্টাডিয়ম এবং সমুদ্র পর্যন্ত অবশিষ্ট অংশ নাবিকদের গনণা অনুযায়ী ৬ হাজার স্টাডিয়ম। স্ট্রাবোর বই থেকে মেগাস্থেনিসের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, “ভারতবর্ষের দক্ষিণ ভাগে সপ্তর্ষিমন্ডল দেখা যায় না, এবং ছায়া বিপরীত দিকে পড়ে,” যা অনেক ক্ষেত্রে সত্য।

ভারতীয় নদী সম্পর্কে আগে থেকেই গ্রীকদের অতি উচ্চ ধারণা ছিলো বলে মেগাস্থেনিস জানান। যেমন সিন্ধু নদকে প্রমত্তা ও সুবিশাল বলেছেন এবং নীল, দানিয়ুবসহ পৃথিবীর অন্যসব নদীর মধ্যে একমাত্র গঙ্গা ছাড়া সিন্ধুই সর্ববৃহৎ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি সিন্ধুর পনেরটি উপনদীর নাম লিপিবদ্ধ করে যান। ইউরোপীয়দের মধ্যে মেগাস্থেনিসই সর্বপ্রথম যিনি বাংলার গঙ্গা নদীর বর্ণনা দেন বিস্তারিতভাবে। তবে কিছু নাটকীয়তাও রয়েছে তার বিবরণে। যেমন, শিলা নামক আরেকটি অদ্ভুত এক নদীর কথা উল্লেখ করেছেন, যে নদীতে নাকি কিছুই ভাসে না, যা ফেলা হয়, তাই পাথর হয়ে ডুবে যায় নদীর অতলে! বোঝা যাচ্ছে যে, পৌরাণিক কোন কাহিনী থেকেই এমন নদীর কথা তিনি জেনেছিলেন। তিনি সিন্ধু ও গঙ্গা ছাড়াও আরও ৫৮টি নদীর কথা উল্লেখ করেছেন “ইন্ডিকা”তে।

মেগাস্থেনিস ভারতবর্ষের মাটির উর্বরতার খুব প্রশংসা করেন। বছরে দুইবার শস্য কাঁটার কথা নির্দিষ্টভাবে লিখেছেন তিনি। সাথে সাথে আবলুস, তাল, বেত, বন্যদ্রাক্ষা, আইভি, লরেল, মার্টল প্রভৃতি বৃক্ষ লতার সঠিক বর্ণনা দিয়ে গেছেন মেগাস্থেনিসে। ভারতীয় পশুর মধ্যে বাংলার বাঘ, হাতি, বানর, কুকুর, কৃষ্ণসার অশ্ব, বিদ্যুৎমাছ, সাপ, পাখাযুক্ত বৃশ্চিকসহ অনেক প্রাণীর বিবরণ দিয়েছেন তিনি। ভারতের হাতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন তার গ্রন্থে। এখানকার শাসকরা হাজারো হাতি দিয়ে কিভাবে বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতেন এবং কিভাবে বুনো হাতিকে আটক করে পোষ মানানো হতো, এসবও সঠিকভাবে লিখে গিয়েছেন মেগাস্থেনিসে।

তার লেখায় ভূ–প্রকৃতি, খনিজ সম্পদের কথা ছাড়াও ভারতীয়দের জীবন ও আচার ব্যবহার সম্পর্কে অনেক কিছুই উল্লেখ রয়েছে “ইন্ডিকা”তে। তিনিই সর্বপ্রথম ভারতীয়দের জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কে বর্ণনা করেন। তার বর্ণনায়, মোট সাতটি জাতিতে বিভক্ত ছিলো ভারতীয়রা। যেমন, পন্ডিত, কৃষক, গোপাল ও মেষপালক, শিল্পী, যোদ্ধা, পর্যবেক্ষক, মন্ত্রী বা বিচারক। চন্দ্রগুপ্তের সময়কালে পাটলিপুত্রের পৌরসভা প্রশাসন বিদেশী নাগরিক, জন্ম ও মৃত্যু, শিল্প ইত্যাদি দেখাশোনা করে এমন কমিটির ব্যাখ্যাও করেছেন মেগাস্থেনিস। তবে ভারতবর্ষ নিয়ে কিছু কাল্পনিক ও অসত্য বর্ণনার জন্য মেগাস্থিনিসের রচনা অনেকের কাছেই পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। আগেই বলা হয়েছে, গ্রীক এবং রোমান ঐতিহাসিকরা প্রাচীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে জানার জন্য “ইন্ডিকা”র উপরই নির্ভর করেছিলেন বেশী। পেরিপ্লাস এবং টলেমির সাহিত্যকর্মগুলো মেগাস্থেনিসের উপরই নির্ভর করে রচনা করা।

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইউরোপীয়ানদের চোখে ভারতবর্ষের পূর্বপুরুষদের আচার-আচরণ, ভৌগোলিক বৈশিষ্টের ধরণ, আর্থ-সামাজিক কাঠামো কেমন ছিলো, “ইন্ডিকা”র সংকলন থেকে কিছুটা হলেও জানা যায়। আরো জানতে হলে গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখতে হবে গ্রীক সাহিত্যকর্মের সেই ভান্ডারের আনাচে-কানাচে। আছে কি আমাদের সে পরিমাণ কৌতূহল?

লেখক পরিচিতি:

রিফাত আহমেদ: চেয়ারপার্সন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন। ইতিহাস, বিজ্ঞান নিয়ে লেখা staycurioussis.com (বাংলা এবং ইংলিশ) ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা।

ড. খালেদ খান: কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি ইতিহাস, সাইবার নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের সাইবার-প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ে গবেষনা করেন। প্রকাশিত করেছেন চারটি বই এবং একশো’র বেশী নিবন্ধ। তিনি staycurioussis.com (বাংলা এবং ইংলিশ) ওয়েবসাইটের চেয়ারপার্সন।