খাবারের দোকান ছাপিয়ে ইতিহাস হয়ে উঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটের সামনে দিয়ে কখনো যদি আপনি যান কিংবা ডাকসু ভবনের মূল ফটকে যদি আপনি পা মাড়ান তবে হলদে রঙা মঠ সদৃশ একটি স্থাপনা আপনার দৃষ্টি এড়িয়ে যাবেনা। পোস্টারের তোপে ছেয়ে থাকা এই ছোট্ট দালানটির সামনে একটি আবক্ষ মূর্তিও দেখা যাবে। তিনি মধুদা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে খুঁজে বার করে জগন্নাথ হলের মাঠে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। এই মধুদার নামেই গড়ে উঠা রেস্তোরা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ মধুর ক্যান্টিন নামে। মূলত ক্যান্টিন হলেও এই ভবনটি এক ধরণের অঘোষিত রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের। শ্লোগান আর মিছিল মিটিং এ সয়লাব থাকা মধুর ক্যান্টিন কিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের আষ্টেপৃষ্টের সাথে জড়িয়ে পড়ল সেই গল্পই আমাদের আজকের নৈবেদ্য।

মধুর ক্যান্টিন

উনিশ শতকের প্রথম দিকের জলসাঘর, যা পরবর্তীতে মধুর ক্যান্টিনে রূপান্তরিত হয় © Wikipedia

মধুর ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত হয় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আজকে আমরা মধুর ক্যান্টিনের যে রূপ দেখি সেটি ছিল প্রকৃতপক্ষে ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহর জলসাঘর। সে আমলে নবাব আহসানউল্লাহর মালিকানায় থাকা ঢাকার তিনটি বাগানবাড়ির একটি ছিল শাহবাগে। আর এই শাহবাগের বাগানবাড়ির এই দালানটিতে বসত নবাবী নাচের আসর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেলে ব্যবসায়িক অবস্থার কথা বিবেচনা করে আদিত্য চন্দ্র দে নামের একজন ব্যবসায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পাশে খাবারের ব্যবসা শুরু করে দেন। তখনকার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিল্ডিং ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ব্রিটিশরা যখন পলাশী থেকে পুলিশ ব্যারাক প্রত্যাহার করে নেয় তখন আদিত্য চন্দ্র পুলিশের কাছ থেকে ২০ টাকায় দুটি ছনের ঘর কিনে নেন। এর একটিতে তিনি নিজে থাকতেন এবং অন্যটিকে ব্যবহার করতে থাকেন খাবারের দোকান হিসেবে। ১৯৩৪ সালের দিকে আদিত্য চন্দ্রের পুত্র মধু দোকানে বাবার সাহায্যকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে আদিত্য চন্দ্র মারা গেলে মধু তার ব্যবসার দায়িত্ব নেন। ঘটনা পরম্পরায় ডাকসুর উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় মধুর রেস্তোরা। নবাবের সেই জলসাঘর ধীরে ধীরে পরিণত হয় ছাত্র রাজনীতির আঁতুড়ঘরে।

মধুর ক্যান্টিন: খাবারের দোকান যখন রাজনৈতিক কার্যালয়

মধুর ক্যান্টিন জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল ১৯৪৮ সাল থেকে। ৪৮ পরবর্তী যত জাতীয় আন্দোলন হয়েছে বাংলাদেশে তার সব কটাতে মধুদার ক্যান্টিন ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছিল ক্যান্টিন থেকে আরো বেশি কিছুতে। বাংলাদেশের অনেক প্রখ্যাত রাজনীতিক, সংস্কৃতিকর্মী, সাহিত্যিক, সমাজকর্মী নিজেদের জীবনের সেরা সময়গুলো কাটিয়েছেন এই ক্যান্টিনে। নিষ্পেষিত পাক শাসনে বিদ্রোহের ঝান্ডাধারী ছাত্ররা এখানে বসে জাতীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন। আন্দোলন পরিকল্পনা, গোপন সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি জন অভ্যূত্থানের পেছনে সাহস ও শক্তির কুটির ছিল সবার ভালবাসার মধুদার ক্যান্টিন৷ ক্যান্টিন লাগোয়া গোলঘরে চলত ব্যানার পোস্টার তৈরির কাজ। ভয় ছিল ধরপাকড়ের, তখন মধুর ক্যান্টিনের উপর নজর পড়েছিল পাকিস্তানিদের। তাই সতর্ক থাকতে হত। ছোট ছোট মিষ্টি আর চা বিস্কুটের এই খাবার দোকান যেন পরিণত হয়েছিল ছাত্র রাজনীতির সদর দপ্তরে যেখানে বীজ উপ্ত হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

মধুর ক্যান্টিন

মধুর রেস্তোরার নামফলক © Wikipedia

বেশিরভাগ ছাত্রই খেয়ে বিল দিতেন না!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মধুর ক্যান্টিনে খাবারের বিল না দেয়ার প্রসঙ্গের স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে,

“মধুর দোকানে বাকি খাওয়া ছাত্রদের একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল তার জীবদ্দশায়। খাতায় নামাঙ্কিত ছাত্ররা খেয়ে চলে যেত। বন্ধুদের আপ্যায়ন করে বিদায় নিত। এক সময় মধু খাতা নিয়ে বসে জানতে চাইতেন কে কে এসেছিল। তাদের নামের পাশে ধার্য্য হত একটা অঙ্ক। ছাত্ররা বলত, মধুও কবুল করতেন, এই বেহিসেবি হিসেবে কখনো লাভ হতো তাদের কখনো মধুর। কৃত্রিম বাদানুবাদও হত মাসের পাওনা নিয়ে। তাতে কোন পক্ষেরই জয় পরাজয় হতো না। ছাত্রদের ঋণ গড়াতো মাসের পর মাসে; মধুর চাপ ছিল যত, আদায় তত ছিল না। বহুজন জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে পরিশোধ করেছেন মধুর ঋণ”

ছাত্ররা খাচ্ছে, কেউ বিল দিচ্ছে তো কেউ দিচ্ছে না। এই নিয়ে অবশ্য মধুদার তেমন ভ্রুক্ষেপও বোধহয় ছিল না৷ এমনিভাবে তিনি মিশে গিয়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে। বাংলা ভাষার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বুদ্ধদেব বসু বিল না দেবার প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছেন,

“দাম দেবার জন্য পকেটে হাতড়াবার প্রয়োজন নেই, লিখে রাখো এই বলেই যথেষ্ট। এই আদিত্যের এবং আমার পুরনো পল্টনের মুদিখানায় সিগারেটের দেনা সম্পূর্ণ শোধ না করে আমি ঢাকা ছেড়েছিলাম। সে কথা ভেবে আজকের দিন আমার অনুশোচনা হয়”।

মধুর ক্যান্টিন

মধুদা স্মৃতি ভাষ্কর্য © Wikipedia

মধুদার প্রয়াণ

রাজনীতি না করেও মধুদা হয়ে উঠেছিলেন আপাদমস্তক রাজনৈতিক চরিত্র। সৎ ও বন্ধুবাৎসল মধুদা ছিলেম সবার আপন। তিনি নিজে অনেক সময় রাজনৈতিক পোস্টার দেয়ালে সেঁটেছেন, রেখেছেন নিজের সংগ্রহে। স্বাভাবিকভাবেই চক্ষুশূল হয়েছেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী খুঁজে খুঁজে বের করে মধুদাকে। জগন্নাথ হলের পাশের ফ্ল্যাটে থাকা মধুদার পরিবারের প্রথম শিকার তার স্ত্রী, গুলি করা হয় তার এক পুত্রবধূ ও কন্যাকে। গুলি চালানো হয় মধুর শরীরেও। কিন্তু তখনো তিনি বেঁচেছিলেন। এক বিহারি এই খবর সেনাবাহিনীর কাছে পৌছে দেয়। ফিরে এসে জগন্নাথ হলের মাঠে হত্যা করা হয় তাকে। বিদ্রোহী যুবকদের ভ্রমর মধুদা নাম লেখান ইতিহাসে। মধুতাকে স্মরণে স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন মধুস্মৃতি কবিতা।

আপনার নীল লুঙ্গি মিশেছে আকাশে
মেঘে ভাসমান কাউন্টার। বেলা যায়,
বেলা যায় ত্রিকালজ্ঞ পাখি ওড়ে, কখনো স্মৃতির খড়কুটো ব্যাকুল জমায়।
আপনার স্বাধীন সহিষ্ণু মুখ
হায় আমরা তো বন্দি আজো-মেঘের কুসুম থেকে জেগে উঠো ক্যাশবাক্স রঙিন বেলুন হয়ে ওড়ে।
বিশ্বাস করুন,
ভার্সিটি পাড়ায় গিয়ে আজো মধুদা মধুদা বলে খুব ঘনিষ্ঠ ডাকতে সাধ হয়।