প্রেসিডেন্ট কেনেডির জন্মদিন উপলক্ষে সাজো সাজো রব নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে, জন্মদিনের দশদিন আগে ১৯শে মে প্রেসিডেন্টের জন্মদিনের খাতিরে এই সান্ধ্যকালীন পার্টি একরকম উৎসবের চেহারা নিয়েছে। অতিথির তালিকাও নেহাত ছোট নয়। কে নেই সেই তালিকায়? বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে হলিউডের উজ্জ্বল তারকারাও। মারিয়া কালাস, ফ্র্যাঙ্ক সিনেত্রা, এলা ফিটজেরান্ড-এর মত ডাকসাইটে শিল্পীরা গাইবেন এই কনসার্টে। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথেই নিমন্ত্রিত অতিথির সমাগমে গমগম করছে ম্যাডিসন স্কোয়ারের কনসার্ট হল। গণ্যমান্য অতিথিবর্গ এগিয়ে এসে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে। পানপাত্র ছলকে পড়ছে উষ্ণ পানীয়ে, পরিবৃত ঝিলমিল রাত পার্টিতে সুন্দরী নারী পুরুষরা সবাই নিজের মতো মশগুল। এ এক মায়াবী রাত।

এক সময় মঞ্চে উঠলেন সুন্দরী লাস্যময়ী স্বর্ণকেশী মেরিলিন মনরো, হীরক দ্যুতি ছড়ানো সাদা ক্রিস্টালের গ্রাউনে স্পষ্ট তাঁর মোহময় শরীরী বিভাজিকা। এক নিমেষে সমস্ত অতিথির আকর্ষণকে টেনে নিলেন নিজের দিকে, মঞ্চের উজ্জ্বল আলোকবৃত্তের মাঝে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে অল্প সময়ের জন্য থামলেন। তারপর বিলোল কটাক্ষে দুষ্টু হাসিতে মোহময় কণ্ঠে প্রেসিডেন্ট কেনেডির দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠলেন হ্যাপি বার্থডে টু ইউ…

যেকোনো নৈশ পার্টিতে বয়সে নবীন, স্বভাবে ফ্লামবয়েন্ট কেনেডি থাকা মানেই তাঁকে ঘিরে রতি রাত। কনসার্ট শেষে কেনেডির থেকে অদূরে স্বপ্নসুন্দরী মনরোকে ঘিরে এক দঙ্গল পুরুষ যাঁদের মধ্যে কেনেডির ভাই রবার্টও আছেন। কিন্তু স্বপ্নসুন্দরীর চোখ কেনেডির দিকে, কেনেডির চোখেও কামনার আগুন। একসময় সমস্ত গুণমুগ্ধ পুরুষকে এড়িয়ে মনরো এসে বসলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডির পাশে। কেনেডির তখন তর সইছে না, মনরোর চোখেও সম্মতির আভাস, মনরোর শরীরের প্রতিটি চড়াই-উৎরাই বাঁক-উপবাঁক কেনেডিকে অস্থির করে তুলেছে। তাঁর অবাধ্য হাতের আঙ্গুল মনরোর খোলা পিঠে বেয়ে ধীরে ধীরে কোমরের দিকে এগিয়ে গেল।

এভাবেই শুরু হয়েছিল মনরো-কেনেডির উত্তাল প্রেমপর্ব, ততদিনে তৃতীয় স্বামী আর্থার মিলারের সাথে সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। মনরোর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁদের এই প্রেমপর্ব আমেরিকার জনমানসে তুমুল আলোচিত বিষয় ছিল। মনরোর রহস্যজনক মৃত্যুর প্রায় আড়াই মাস আগে এটাই ছিল মনরোর জনসমক্ষে শেষ উপস্থিতি। শোনা যায় মৃত্যুর আগে শেষ ফোনটি মনরো করেছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকেই।

মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরে আজও মেরিলিন মনরোর রহস্যমৃত্যুর যেমন কোনো কিনারা হয়নি, তেমনি এই স্বর্ণকেশী সুন্দরী লাস্যময়ী তারকা ও অভিনেত্রীর যৌন আবেদনের মুগ্ধতার রেশ এখনো স্তিমিত হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে মনরোর ব্যাপারে দর্শকের আগ্রহ কমেনি বিন্দুমাত্র। একাধারে অভিনেত্রী-গায়িকা, পিনআপ মডেল, হলিউডের বিউটি কুইন মনরো ছিলেন সৌন্দর্য এবং যৌন আবেদনের মূর্ত প্রতিমূর্তি। তাঁর ভুবনমোহিনী সৌন্দর্য, অলঙ্ঘনীয় যৌন আবেদন আর দুষ্টু হাসি অগণিত তরুণের হৃদয়ে ঝড় তুলেছিল; কেড়ে নিয়েছিল রাতের ঘুম। কিংবদন্তী এই শিল্পী মৃত্যুর এত বছর পরেও পপ কালচার এর একজন কাল্ট ফিগার ও জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক আইকন হিসেবে দর্শকের কাছে আকাঙ্ক্ষিত, স্মরণীয় এবং দর্শক এখনো মোহাবিষ্ট।

যে সময়টায় প্রতিনিধিত্ব করেছেন মনরো অর্থাৎ ৫ ও ৬ এর দশকের প্রথম দিকের সেই সময়টা ছিল সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পালাবদলের সময়। বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হচ্ছে একগুচ্ছ দেশ, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে গণ-আন্দোলন। ওদিকে ডি এইচ লরেন্স এর ‘লেডি শার্লিস লাভার’ ৩২ বছর নিষিদ্ধ থাকার পর মুক্তি পাচ্ছে ইংল্যান্ডে, হিউ হেফনার প্লে-বয় পত্রিকা ও প্লেবয় ক্লাব খুলছেন শিকাগোতে, গর্ভনিরোধক জনপ্রিয় হচ্ছে মহিলামহলে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা শুধু নয়, যৌন স্বাধীনতার উদযাপনও ছিল এই সময়ের দাবি। এমনই সময়ের এক কিংবদন্তি চরিত্র মেরিলিন মনরো।

মেরিলিন মনরোর জীবনটা ছিল রূপকথার দুঃখী রাজকন্যার মত। খ্যাতি, যশ, প্রতিপত্তি- একসময় সবই পরাজিত সৈনিকের মতো নতজানু হয়ে ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু তাঁর ভুবনমোহিনী হাসির আড়ালে লুকিয়েছিল অস্ফুট কান্নার শব্দ। ১৯২৬ সালের ১লা জুন লস অ্যাঞ্জেলসের কাউন্টি হাসপাতালে গ্ল্যাটিস পার্ল বেকারের কোলে জন্ম নেন নর্মা জেন, গ্লাটিসের তৃতীয় সন্তান ছিলেন নর্মা। অত্যাচারী প্রথম স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর গ্ল্যাটিস জনৈক মার্টিন এডওয়ার্ড মার্টেনসেনকে বিয়ে করেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। নর্মার জন্মের সময় মার্টিন নিশ্চিত ছিলেন না এই সন্তান তাঁর কিনা, গ্ল্যাটিসও আশাব্যঞ্জক উত্তর দিতে পারেননি। ফলে নর্মার পিতৃপরিচয় ছিল না। সন্তানকে মানুষ করার মতো আর্থিক সঙ্গতি বা মানসিক স্থিরতা কোনটাই ছিল না গ্ল্যাটিসের। আর্থিক অস্বচ্ছলতার দরুণ মানসিক চাপে গ্ল্যাটিস বহুবার ছোট্ট নর্মাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছিলেন। গ্ল্যাটিসের মানসিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হওয়ায় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, আর ছোট্ট নর্মার জায়গা হয় অনাথ আশ্রমে। ১১ বছর বয়স পর্যন্ত নর্মা প্রায় ডজনখানেক অনাথ আশ্রম ও পালক পরিবারে বড় হয়। এমনই এক পালক পরিবারের পালকপিতার কাছে যৌন নিগ্রহের শিকারও হয় নর্মা।

১২ বছর বয়সে মায়ের এক বান্ধবীর পরিবার তাঁকে পালনের দায়িত্ব পায়। এই পরিবার আর্থিক সমস্যার জন্য পুনরায় অনাথ আশ্রমে পাঠানোর কথা চিন্তা করলে শুধুমাত্র অনাথ আশ্রমে ফিরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে ১৯৪২ সালের ১৯শে জুন ১৬ বছর বয়সে প্রতিবেশী যুবক জেমস ডগার্থিকে বিয়ে করেন নর্মা। জেমস একটি এয়ার ক্র্যাফট প্লান্টে চাকরী করতেন। দু’বছর পর নর্মা জেমসের কোম্পানিতে কাজে যুক্ত হন। শীঘ্রই তাঁর মোহনীয় রূপের জন্য কোম্পানির শো-গার্ল হিসেবে মডেলিংয়ের সুযোগ আসে। এই সময় ফাস্ট মোশন পিকচারর্স এর এক আলোকচিত্রী ডেভিড কোনভার সাথে পরিচয় হয়। ডেভিডের মাধ্যমে বেশ কিছু পত্রিকার মডেল হিসেবে কাজ করেন। ব্লু বুক মডেল এজেন্সির সাথে যুক্ত হয়ে খুব অল্প সময়ে প্রায় ৩৩টি পত্রিকার কভার গার্ল ও পিনআপ মডেল হিসেবে নর্মাকে দেখা যায়। যার মধ্যে পিজেন্ট, ইউ এস ক্যামেরা, লাভ এন্ড পিক অন্যতম। মডেলিংয়ের ঝোঁক গ্ল্যামার জগতের হাতছানির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান স্বামী জেমস। নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে নর্মা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন।

Monroe with her first husband, James Dougherty, c. 1943–44. They married when she was 16 years old. Source: Wikipedia

১৯৪৭ সালের ‘টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স স্টুডিও’-র সাথে কাজের সুযোগ আসে ‘ডেঞ্জারাস ইয়ার’ ও ‘স্কুডা হো স্কুডা হে’ নামক ছবিদুটিতে ছোট্ট রোলে অভিনয় করেন। ইতিমধ্যে নর্মা নিজের নাম পাল্টে ফেলেন, এখন থেকে তিনি মেরিলিন মনরো। পরে স্টুডিওর তরফে কোন কাজ না পাওয়ায় মনরো আবারও মডেলিং-এ ফিরে যান। অবশ্য মনরো মনেপ্রাণে অভিনেত্রী হতে চাইতেন। তাই এক্টরস্‌ ল্যাবটারী থিয়েটার নামের অভিনয় স্কুল থেকে অভিনয়ের পাঠ নিতে শুরু করেন। ‘ফক্স’-এর এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার জোসেফ এম স্কীনকের সাথে মনরোর পরিচিতি এবং নিছক বন্ধুত্বের বাইরের ক্যাজুয়াল যৌন সম্পর্কের জন্য স্কীনকের সাহায্যে স্কীনকের বন্ধু ‘কলম্বিয়া পিকচার্স’-এর হ্যারি কোহনের সাথে মনরোর পরিচয় হয় এবং কলম্বিয়া পিকচার্স মনরোকে পরবর্তী ছবির জন্য চুক্তি করে। খুব অল্প বাজেটের একটি ছবি ‘লেডিস অফ দ্য কোরাস’ ছবিতে একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেন। এখানে নাতাশা লাইটেস নামের এক অভিনয় শিক্ষিকার সাথে পরিচয় হয় মনরোর। কলম্বিয়া পিকচার্সের ওই জার্মান প্রশিক্ষকের সাথে মনরো ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ বছর কাজ করেছেন। শেষের দিকে প্রায় দু’বছর মনরো ও নাতাশা লাইটেস সমকামী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ‘লেডিস অফ দ্য কোরাস’ খুব ভালো চলল না। ১৯৫০-এ ‘লাভ হ্যাপি’ নামের আরো একটি ছবিতে অভিনয় করেন। এটারও সেই একই দশা। এদিকে গ্ল্যামার জগতে থাকতে গেলে ঠাটবাট বজায় রাখা খুবই দরকার, কিন্তু সেভাবে ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে একটি পানীয় কোম্পানির হয়ে মডেলিংও সুযোগ আসে। ‘মোনা মনরো’ নাম নিয়ে ঐ পানীয় কোম্পানির জন্য ন্যুড ফটোশ্যুট করেন মনরো।

Photo of Monroe taken by David Conover in mid-1944 at the Radioplane Company. Source: Wikipedia

‘এ টিকিট টু টোমাহক’, ‘রাইট ক্রশ’, ‘দ্য ফায়ারবল’ ছবিগুলিতে খুব ছোট চরিত্রে অভিনয়ের পর ‘দ্য এপসল্ট জঙ্গল’ ও ‘অল এবাউট ইভ’ ছবি দর্শক মহলে সাড়া ফেলে। ছোট্ট চরিত্র হলেও এই ছবিতে মনরোর লাস্যময়ী অভিনয় তাঁকে রাতারাতি তারকায় পরিণত করে। ‘টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরির ফক্স’ আগামী সাত বছরের জন্য সাথে চুক্তি করে মনরোর সাথে। ফক্স এর সাথে চুক্তি মনরোকে হলিউডের রাস্তা প্রশস্ত করতে সাহায্য করেছিল। এইসময় ‘এম জিএম’-এর ‘হোম টাউন ষ্টোরী’ ফক্স-এর ‘অ্যাজ ইয়াং অ্যাজ য়্যু ফীল’, ‘লাভ নেস্ট’, ‘লেটস মেক ইট লিগাল’- ছবি দর্শকের মন জয় করে, যদিও সমালোচক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। অভিনয় প্রতিভার তুলনায় তাঁর যৌন আবেদন আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এই সময়ে প্রায় প্রতিটি সিনেমাতে পর্দায় তাঁকে একজন যৌন আবেদনময়ী নারী হিসেবে দেখা যেত, পর্দায় তাঁর খোলামেলা পোশাক ঝড় তুলেছিল সমালোচকের কলমে আর লাখো পুরুষের হৃদয়ে। এলিজা কাজান, নিকোলাস রে, ইয়েল ব্যানার, পিটার লফোর্ড-এর মত চিত্র পরিচালকদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার খবর হলিউড গসিপ কলামগুলোতে নিয়মিত পরিবেশিত হতে থাকে। এই সময় মনরো তাঁর বাদামী চুলের রঙ পাল্টে প্লাটিনাম সোনালী আভা আনেন তাঁর এই স্বর্ণকেশদাম এক নতুন ও অনন্য স্টাইল স্টেটমেন্ট হিসাবে পরিচিতি লাভ করে, এটা ছিল মনরোর একান্ত নিজস্ব ট্রেডমার্ক। ১৯৫২-র মার্চে একটি বিতর্কের মুখোমুখি হোন মনরো, কিছু বছর আগে একটি ক্যালেন্ডারের জন্য নুড ফটোশ্যুট করেছিলেন। তা সামনে আসতে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে, কিন্তু ভক্তদের সহানুভূতি আদায়ে ব্যর্থ হননি মনরো। ‘ক্ল্যাশ বাই নাইট’, ‘ডোন্ট বদার টু নক’, ‘উই আর নট ম্যারিড’ ছবিতে তার প্রতিফলন পড়ে। পরে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনি কেন ন্যুড ফটোশ্যুট করেছিলেন?” তখন মনরো বালিকাসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিলেন, “ন্যুড কোথায় আমার সাথে তো একটি রেডিও ছিল!”

Monroe in The Asphalt Jungle (1950). This was one of her first performances noted by critics. Source: Wikipedia

‘উই আর নট ম্যারিড’ ছবিতে ক্যারি গ্রান্টের বিপরীতে শিশুসুলভ বোকা সুন্দরী সেক্রেটারির ভূমিকায় অভিনয় করেন মনরো। বারবার একই রকম চরিত্রে অভিনয় করতে করতে বিরক্ত, কিন্তু ততদিনে হলিউড টাইপকাস্ট করে ফেলেছে মনরোকে। প্রোডাকশন হাউজগুলির সাথে মনরোর সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে, নিয়মানুবর্তিতার অভাব ও কাজের প্রতি খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য, পছন্দমত শট না হলে বারবার রিটেক পরিচালকদের বিরক্তির কারণ হয়। জার্মান অভিনয় শিক্ষিকার নাতাশা লাইটেসের বক্তব্য অনুযায়ী, “নিরাপত্তার অভাব বোধ করতেন মনরো, দর্শক তাঁর অভিনয় নয়, বরং তাঁর যৌন আবেদনকে পছন্দ করত। এ এক অদ্ভুত মানসিক যন্ত্রণা! চেয়েছেন অভিনেত্রী হতে, কিন্তু দর্শকের চোখে মনরো যৌনতার প্রতীক ছাড়া আর কিছু নয়; যৌনতা ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার নেই। সবকিছু হারিয়ে ফেলার ভয় তাড়া করে বেড়াতো মনরোকে।” উৎকণ্ঠা নিদ্রাহীনতার উপশম হিসেবে ড্রাগ ও মাদক হয়ে উঠেছিল একমাত্র সঙ্গী।

Monroe with Keith Andes in Clash by Night (1952). The film allowed Monroe to display more of her acting range in a dramatic role. Source: Wikipedia

১৯৫৩-র ‘নায়াগ্রা’, ‘জেন্টেলম্যান প্রেফার ব্লন্ডস্‌’ এবং ‘হাউ টু ম্যারি এ মিলিয়েনিয়ার’ ছবি তিনটি বিপুল জনপ্রিয় এবং আলোচিত হয়। ‘নায়াগ্রা’ বক্সঅফিসে ৬ মিলিয়ন আয় করে, যদিও মহিলামহলে সমালোচিত হয়েছিল ছবিটির বিষয়বস্তুর জন্য। ফটো প্লে অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে মনরো সেরা নবাগত অভিনেত্রীর সম্মান পান এই ছবির জন্য। ‘জেন্টেলম্যান প্রেফার ব্লন্ডস্‌’ ছবিটি জন্য প্রথমবার মনরোর অভিনয় নিয়ে চিত্র সমালোচক এবং সংবাদমাধ্যম ইতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করে, প্রথমবার মনরোর অভিনয় সব শ্রেণীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে, বক্সঅফিসে প্রোডাকশন খরচের দ্বিগুণ আয় করে ছবিটি এবং নির্মাতাদের পকেট ভরায়।

Monroe and Arthur Miller at their wedding in June 1956. Source: Wikipedia

১৯৫৩-র ডিসেম্বরে বিখ্যাত বা কুখ্যাত প্লে­বয় ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যার কাভারে এবং পিনআপে সম্পূর্ণ উন্মুক্তভাবে নিজেকে মেলে ধরেন মেরিলিন মনরো। হৈ চৈ পড়ে যায় আমেরিকান সংবাদ মাধ্যমে। এই প্রথম কোন তারকা নিজের কেরিয়ারের মধ্যগগনে থাকাকালীন ন্যুড ছবি প্রকাশ করেছেন, যদিও ঐ ছবি অনেক আগের। অবশ্য একথা অস্বীকার করার উপায় নেই মেরিলিন মনরো নগ্নতাকে শিল্পে প্রতিষ্ঠিত করেন। মনরো ছিলেন প্লেবয়ের ‘ফার্স্ট সুইটহার্ট অফ দ্য মান্থ’, প্লেবয়ের প্রথম সংখ্যার ছবি এক ইতিহাসের সূচনা করে প্লেবয় পত্রিকাকে সেক্স পত্রিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

Monroe with Lemmon and Curtis in Some Like It Hot (1959), for which she won a Golden Globe. Source: Wikipedia

একই ধরনের চরিত্র এবং সহকর্মীদের তুলনায় কম পারিশ্রমিকের কারণে নির্মাতাদের সঙ্গে মনোমালিন্য চরমে ওঠে ফলে মনরো সিদ্ধান্ত নেন এই বৈষম্যের সুষ্ঠু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী ছবিতে অভিনয় করবেন না। হলিউডও মনরোকে বয়কট করে। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মনরো এই সময় দীর্ঘদিনের বন্ধু বেসবল তারকা জো ডি মিয়াগোর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর এক নতুন রূপে দেখা যায় মনরোকে; গায়িকা মনরোকে চিনলো দর্শক। বেশ কিছুদিন কোরিয়াতে তিনি একজন গায়িকা হিসেবে নিয়মিত স্টেজ শো করতে থাকেন। অবশ্য খুব বেশিদিন হলিউড মনরোর মতো তারকাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি, আবারও ডাক পড়ে হলিউডে। শুরু হয় ‘দ্য সেভেন ইয়ার ইচ’ ছবির কাজ। এই ছবিতেই ম্যানহাটনের সাবওয়েতে হাওয়ায় মেরিলিন মনরোর সাদা স্কার্ট উড়ে যাওয়ার একটি ঐতিহাসিক দৃশ্য ছিল। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৭ সালে। এই ছবির শুটিংয়ের সময় ব্যক্তিজীবনে আবারও এক বড় আঘাত আসে। মাত্র নয় মাসের বিবাহিত জীবনে ইতি টানেন দ্বিতীয় স্বামী জো ডি মিয়াগো। হতাশাগ্রস্ত একাকী মনরো ড্রাগ আর মাদককে আরো কাছে টেনে নেন, কিন্তু অভিনয়ের প্রতি এক অসম্ভব ভালোবাসার জন্য মেথড অ্যাক্টিং শেখায় মনোনিবেশ করেন। এইসময়ই আলাপ হয় নাট্যকার আর্থার মিলারের সাথে। অভিনয়ের কর্মশালার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কাছাকাছি এসে যান দুজনেই। ইতিমধ্যে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে আর্থার মিলারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। অনেকেই এ সময় মনরোকে মিলারের সঙ্গ ত্যাগ করার পরামর্শ দিলেও এবং হলিউড থেকে পুনরায় বহিষ্কারের সম্ভাবনা থাকলেও মনরো মিলারের সঙ্গ ত্যাগ করেননি, বরং পাশে দাঁড়ান মিলারের।

Monroe, Betty Grable, and Lauren Bacall in How to Marry a Millionaire, her biggest box office success of 1953. Source: Wikipedia

 
১৯৫৬-র ২৯শে জুন তৃতীয়বারের মতো নাট্যকার আর্থার মিলারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মনরো। একমাত্র মিলারের সাথেই জীবনের সেরা সময় তিনি কাটিয়েছিলেন। এই বছরের ‘বাস স্টপ’ ছবিতে প্রথমবারের জন্য মনরো তাঁর চিরপরিচিত যৌন আবেদনের খোলস ছেড়ে অভিনয় করেন। অভিনয় নিয়ে পরিচালক জন লেনন প্রথমে যথেষ্ট সন্দিগ্ধ ও আতঙ্কিত থাকলেও পরে মত বদলান এবং জন লেনন পরে মন্তব্য করেছিলেন চ্যাপলিনের পর কমেডি আর ট্র্যাজিডির এমন সংমিশ্রণ ইতিপূর্বে অন্য কেউ করেনি। ছবিটি বেশ প্রশংসিত হয় এবং বক্স অফিসে প্রায় ৪ মিলিয়ন আয় করে। মনরো এই বছর নিজের প্রযোজনা সংস্থাও খোলেন এবং ‘দ্য প্রিন্স এন্ড দ্য শোগার্ল’ ছবিতে অভিনয় ও প্রযোজনা করেন। এই ছবি করার সময় নানা জটিলতা ও ব্যক্তিজীবনে নানা সমস্যার দরুন বেশ ভালোরকম ড্রাগ আসক্ত হয়ে পড়েন মনরো। মুক্তির পর ছবিটি আমেরিকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেলেও ইউরোপে ভালোই প্রশংসিত হয় এবং অভিনয়ের জন্য বাফটা সম্মানও পান। এরপর মাদকাসক্তি, বেশ কয়েকটি গর্ভপাত ও ব্যক্তিজীবনের সমস্যা একেবারে ভঙ্গুর করে দেয় মনরোকে, অবশ্য এত কিছুর পরেও ১৯৫৯-এর ‘সাম লাইক ইট হট’ ছবিতে একজন গায়িকার ভূমিকায় অভিনয় দিয়ে আবারো দর্শকের মন জয় করে নেন। বড় সাফল্য আসে এই ছবি দিয়ে, অসাধারণ অভিনয়ের জন্য গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার পান মনরো।

Monroe’s dramatic performance in Bus Stop (1956) marked a departure from her earlier comedies. Source: Wikipedia

১৯৬১-র ‘দ্য মিসফিট’ ছবিটি ছিল মনরোর শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। এই ছবিতে তিনি এক বিধবার ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই ছবিটি করার সময় তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে, ফলে বহু দিন শ্যুটিং বন্ধ ছিল। এই ছবির পর মিলার এবং মনরো বিবাহিত জীবনে ইতি টানেন। এই ছবিটি দর্শকের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এরপর মাদকাসক্তি এবং অনিয়ন্ত্রিত ওষুধের প্রভাবে শারীরিক ও মানসিক অবস্থা এতটাই অবনতি ঘটে যে বেশ কিছুদিন মনরোকে হসপিটালে কাটাতে হয়। অবশ্য এই সময় প্রাপ্তন স্বামী জো ডি মিয়াগোকে পাশে পান এবং জো ডি মিয়াগোর বন্ধু গায়ক ফ্রাঙ্ক সিনেত্রার সাথে অল্পকিছুদিনের জন্য গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। জীবনে বহু মানুষের সাহচর্য্য পেলেও সমস্ত জীবন মনরো নিঃসঙ্গ একাই ছিলেন। মৃত্যুর আগের কয়েক মাস প্রেসিডেন্ট কেনেডির সাথে ঘনিষ্টতা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলেও কেনেডির বোনের বয়ান অনুযায়ী কেনেডির ভাই রবার্টও মনরোর প্রেমাস্পদ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।
একাকীত্ব, হতাশা, শারীরিক অসুস্থতা, গর্ভপাত, অনিয়ন্ত্রিত ওষুধের ব্যবহার, অতিরিক্ত মাদকাসক্তি ধীরে ধীরে মনরোকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কেনেডির জন্মদিনের পার্টির প্রায় দুমাস পরে ১৯৬২-র ৫ই আগস্ট নিজের বাসভবনে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় মনরোকে। মৃত্যুর রিপোর্টে ড্রাগ ওভার ডোজকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হলেও মনরোর মৃত্যু নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। নানান ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, মৃত্যুর জন্য প্রেসিডেন্ট কেনেডিকেও অনেকে দায়ী করেন যদিও বাস্তবে তার প্রমাণ মেলে না। তবে এতকাল পরে এসেও মনরোর মৃত্যু শুধুই রহস্য হয়ে আছে। সে জট আর খোলেনি। কিন্তু একথা ঠিক জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা মনরোর ছিল। তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করেনি হলিউড। হতে চেয়েছিলেন বড় অভিনেত্রী, কিন্তু তার বদলে নির্বোধ সুন্দরী, ‘ডাম্ব ব্লন্ড’ হয়েই থাকতে হয়। নিজেই বলেছেন, “আমি কখনো মেরিলিন মনরো হতে চাইনি, মেরিলিন হচ্ছে নর্মাকে লুকিয়ে রাখার একটি চাদর।” মেরিলিন মনরো বলতেই চোখের সামনে যে ছবি ফুটে ওঠে তা হল বহুপুরুষের সঙ্গী, যৌনতার প্রতিমূর্তি, সমকামী, মাদকাসক্ত, এক লাস্যময়ী সুন্দরী, ডাম্ব ব্লন্ড।
 
সত্যি কি তাই? আসলে মেরিলিন মনরো কি এমনই ছিলেন? বিখ্যাত জ্যাজ শিল্পী এলা ফিটজেরান্ডকে হলিউড নাইট ক্লাব গান গাইবার বুকিং দিত না কালো হওয়ার অপরাধে! নাইট ক্লাবের মালিককে মেরিলিন মনরো বলেন এলা ফিটজেরান্ডকে গান গাওয়ার সুযোগ দিলে মনরো প্রতিরাতে প্রথম সারির টেবিলে বসে গান শুনবেন। এরপর এলা ফিটজেরান্ড নিয়মিত বুকিং পেতেন। কথা রেখেছিলেন মনরোও, প্রতি সন্ধ্যায় হাজির হতেন গান শুনতে। ‘ডাম্ব ব্লন্ড’ নির্বোধ সুন্দরী মেরিলিন মনরোর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল অসংখ্য ধ্রুপদী সাহিত্য, নাটক, কবিতা, দর্শনের বই। কিছু বইয়ের প্রথম সংস্করণ ছিল তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে। প্রতিটি বইয়ের পাতায় পাতায় চিরকুটে পাওয়া যায় তাঁর হাতে লেখা নোট।
বেশিরভাগ মানুষ মেরিলিন মনরোর বাহ্যিক রূপটাকে দেখেছে, তাঁর ব্যক্তিত্বের বহু অজানা দিক চাপা পড়ে গেছে তাঁর এই লাস্যময়ী সৌন্দর্যের নীচে। শতাব্দীর সবচেয়ে অপ্রশংসিত মানুষ ছিলেন মেরিলিন মনরো। ভুল মূল্যায়ন হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে, তবে তাঁর ক্যারিশমাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। হয়তো সেই জন্যই তাঁর মৃত্যুর পর আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। একই দিনে প্রায় ১২ জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়।
আসলে মেরিলিন মনরো একটা যুগের নাম! ছোটবেলার দুর্ভাগ্য, জীবনের নানান উত্থান-পতন, খ্যাতি যশ, শেষ জীবনের নিঃসঙ্গতা! এই শিল্পীর জীবন প্রদীপ মাত্র ৩৬ বছরে নিভে গেলেও দর্শক ও ভক্তদের হৃদয়ে মেরিলিন মনরোর জায়গা আজও অমলিন, আজও অধরা তাঁর সৌন্দর্যের রহস্য।
লেখা ও ডিজাইন- বাপ্পাদিত্য
 
লেখাটি প্যারালাল ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া