ঋষিকেশ দাস ছিলেন ব্রিটিশ আমলে ঢাকার একজন নব্য ধনী ব্যবসায়ী। সে সময় ঢাকার খানদানি পরিবারগুলো তেমন গুরুত্ব দিত না ঋষিকেশ দাসকে। সে কারণে ১৯৩১ সালে পুরান ঢাকার টিকাটুলিতে ঋষিকেশ দাস একটি বাগানবাড়ি তৈরী করেন। বাগানে প্রচুর গোলাপ ফুলের গাছ থাকায় এর নাম লোকের মুখে মুখে হোয়ে যায রোজ গার্ডেন, আর রাস্তাটির নামও হয় তার নামেই ঋষিকেশ দাস লেন। পরে আর্থিক কারণে তিনি ভবনটি খান বাহাদুর আবদুর রশীদের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।

রোজ গার্ডেন নামফলক

১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে ১৯৭০-এটি বেঙ্গল স্টুডিও ও মোশন পিকচার্স লিমিটেড রোজ গার্ডেন প্যালেসের ইজারা নেয়। ঢাকা শহরের টিকাটুলি এলাকায় অবস্থিত রোজ গার্ডেন প্রাসাদ যা সংক্ষেপে রোজ গার্ডেনে চিত্রায়িত হয় রহমান শবনম ও সুভাস দত্ত অভিনিত হারানো দিন সিনেমাটি। ছবিটি নির্মাণ করেন পুরান ঢাকারই সন্তান আবু নূর মোহাম্মদ এহতেশামুর রহমান (১২ অক্টোবর ১৯২৭ – ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০২), এহতেশাম, ঢাকা সিনেমার আইকন, মাইল ফলক কিংবা প্রবাদ ব্যাক্তিত্ব বলতে পারেন।

আবু নূর মোহাম্মদ এহতেশামুর রহমান

ব্রিটিশ ভারতের ক্যাপ্টেন থেকে নির্মাতা এহতেশাম ১৯২৬ সালের ১২ অক্টোবর পুরান ঢাকার বংশালে জন্মগ্রহণ করেন। মালিটোলা, নাজিরাবাজার, সূত্রাপুর, লালবাগ, সদরঘাট, রাজার দেউড়ি এলাকায় কেটেছে তাঁর শৈশব। পড়াশোনা শেষ করে এই নির্মাতা যোগ দেন ব্রিটিশ ভারতের সেনাবহরে তখন তার পদবীঢ ছিলো ক্যাপ্টেন । ১৯৪৬ সালে নিজের উদ্যোগে নাটোর, সান্তাহার, লালমনিরহাটে তিনটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করেন তিনি। এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ১৯৫৯ সালে “এ দেশ তোমার আমার” এবং পরবর্তিকালে তিনি রাজধানীর বুকে (১৯৬০), তালাশ, চকোরী (১৯৬৭), চান্দা (১৯৬২), নতুন সুর (১৯৬২), সাগর (১৯৬৫) চাঁদ আর চাঁদনি (১৯৬৮), দাগ, পীচ ঢালা পথ (১৯৭০), শক্তি ইত্যাদি বিখ্যাত সিনেমা তৈরি করেন।

বাবা মোহাম্মদ ইউসুফ ছিলেন ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক এবং মা মোছাম্মত কানিজ ফাতেমা ছিলেন একজন গৃহিণী। তার পিতামহ ছিলেন হাকিম হাবিবুর রহমান। তার ছোট ভাই চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক মুস্তাফিজ। তার সহকারী পরিচালকরা ছিলেন জহির রায়হান এবং কামাল আহমেদ, আজিজুর রহমান প্রমুখ। গত শতকের ’৫০, ’৬০ ও ’৭০–এর দশকে এহতেশামের ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠিা পেয়েছেন অনেক অভিনয়শিল্পী, গায়ক ও চিত্রগ্রাহক। এহতেশামের হাত ধরেই অভিনয়ে আসেন শবনম, রহমান, সুভাস দত্ত আজিম, শাবানা, নাঈম, শাবনাজ, শাবনূরের মতো তারকারা। উর্দু ভাষায় নির্মিত চকোরী ছবি দিয়ে নাদিম বেগকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এহতেশাম। পরে পাকিস্তানে তুমুল জনপ্রিয়তা পান অভিনেতা নাদিম বেগ। এহতেশামের মেয়ে ফারজানাকে বিয়ে করেন নাদিম বেগ। এ ছাড়া গোলাম মুস্তাফা, খান জয়নুল, রানী সরকার, সুমিতা দেবী, এবং সদ্য প্রয়াত সাদেক বাচ্চুকেও খুঁজে পান তিনি।

এহতেশামের ছবিতেই প্রথম সংগিত পরিচালনা শুরু করেন খাস ঢাকাইয়া রবিন ঘোষ ও প্রথম নারী সংগিত পরিচালক ছিলেন ফেরদৌসী রহমান। ক্যাপটেন এহতেশামের “হারানো দিন” সিনেমার অন্ততঃ দুটি গান খাস ঢাকাইয়া রবীন ঘোষের সুরকৃত এবং ফেরদে্ৗসী রহমানের কন্ঠে আজও কিংবদন্তির মতো। “আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি”, এবং “বুঝি না মন যে দোলে বাঁশিরও সুরে,” বলুনতো এ দুটি গান শুনে কে তার অতিতে ফিরে যান না। এ গান দুটি লিখে দিয়েছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি আজিজুর রহমান। কুষ্টিয়ার এক সম্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার কবি আজিজুর রহমানের লিখিত দুই হাজার গানের তালিকায় আছে পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা আমারই দেশ ভাই রে এবং আকাশের ঐ মিটি মিটি তারার সাথে কইবো কথা, নাই বা তুমি এলে, এরকম জনপ্রিয় অনেক গান। হারানো দিন সিনেমাটিতে সুভাস দত্তের লিপসিংএ “অভিমান করো না, তুমি কিছু বোঝ না” এ গানটিতে নারী ছলনাময়ী এই প্লেব্যাকটি যিনি করেন তিনি হানিফ সংকেতের ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের নিয়মিত শিল্পি নজমুল হুদা বাচ্চু। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক নাজমুল হুদা বাচ্চু ১৯৩৮ সালের ১১ জুলাই মাগুরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এহেতেশাম-মুস্তাফিজ ভাইদের চান্দা, জোয়ার এলো, ফির মিলেঙ্গে হাম তুম, কার পাপে সহ আরো অনেক চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছিলেন। এছাড়া তিনি সূর্য দীঘল বাড়ী, সারেং বৌ, চন্দ্রগ্রহণ, শ্রাবণ মেঘের দিন, শঙ্খনীল কারাগার এর মত চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন।

রোজ গার্ডেন প্যালেসের বহির্দৃশ্য

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৯ সালে রোজ গার্ডেনকে সংরক্ষিত ভবন হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু আদালতে মামলা করে ১৯৯৩ সালে মালিকানা স্বত্ব ফিরে পান কাজী আবদুর রশীদের ছেলে কাজী আবদুর রকীব। ২০১৮ এ বাংলাদেশ সরকার এ ভবনটি ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ দুই হাজার ৯০০ টাকা মূল্যে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২২ বিঘা জমির উপর স্থাপিত সাত হাজার বর্গফুটে আয়তনের এই ভবনটির উচ্চতা ৪৫ফুট বা এখনকার একটি চারতালা বিল্ডিং যেমন। প্রাসাদটির স্থাপত্যে করিন্থীয়-গ্রীক শৈলী অনুসরনে তৈরি মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় পাঁচটি কামরা আর একটি বড় নাচঘর আছে। নিচতলায় আছে আটটি কামরা। প্রবেশ ও বর্হিগমনের জন্য স্থাপিত পশ্চিম দিকের ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই দেখা যাবে একটি বিস্তীর্ণ খোলা প্রাঙ্গণ। পূর্বাংশের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি আয়তকার পুকুর। পুকুরের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের মাঝামাঝি এ ভবনেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন হয়।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এই বাড়িতেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ) গঠনের পরিকল্পনা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেম এর নেতৃত্বাধীন তত্কালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্রাসাদে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয় এবং নাম রাখা হয়“পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ”। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল তত্কালীন পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল, আর আজ বাংলাদেশের ভাগ্য বদলে দেয়ার দ্বায়িত্ব নিয়েছেন রাজনীতির মহিরুহ এই আওয়ামী লীগ এবং এর সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কণ্যা শেখ হাসিনা। রেজাউল করিম মুকুল, ২১ নভেম্বর, ২০২০খ্রিঃ।