A steel engraving by Jean Antoine Théodore de Gudin depicting the Battle of Beachy Head, a naval engagement Avery likely participated in while serving in the Royal Navy

ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকের গল্প l ১৬৫০ থেকে ১৭২০ পর্যন্ত সারা বিশ্বে জলদস্যুতার স্বর্ণযুগ ছিল। সেই সময়কার জলদস্যুতার কথা আসলেই আমদের চোখের সামনে পর্তুগীজ, আরাকানী, মগ, হার্মাদ  জলদস্যুদের ছবি ভেসে উঠে। ভয়ঙ্কর জলদস্যু ছিলেন এই মগেরা। তাঁদের ভয়ে তঠস্থ হয়ে থাকতো বঙ্গোপসাগরের জাহাজের লোকজন আর সমুদ্র পারে বসবাসকারি বাসিন্দারা l অনেক সময় এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিল ঐ মানুষ গুলো। তবে জলদস্যু যে শুধু বঙ্গোপসাগরেই ছিল, তা নয়। সারা পৃথিবী জুড়েই ছিল তারা, এখনও আছে। খবরের কাগজের পাতায় বা টিভি নিউজ চ্যানেল’এ মাঝে মাঝেই ভেসে ওঠে সোমালি জলদস্যুদের কথা।

The title page of the report issued in 1696 by the High Court of Admiralty following the trial of Avery’s crew

এইসব জলদস্যুদের মধ্যে কয়েকজন আবার হয়ে গিয়েছেন কিংবদন্তি ও মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল। এইরকমই এক স্মরণীয় কিংবদন্তি হলেন হেনরি এভেরি। তার সর্ম্পকে রয়েছে নানা রকম লোহমর্ষক গল্প।
আজকে এমনি এক গল্প শুনাবো। তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পরবর্তীকালের বেশ কিছু দিকপাল জলদস্যু যেমন ক্যাপ্টেন কিড, ব্ল্যাকবেয়ার্ড ইত্যাদি। এভেরি’র জীবন নিয়ে লেখা হয়েছিল বেশ কিছু নাটকও।

An 18th-century depiction of Henry Every, with the Fancy shown engaging its prey in the background

এবার আসা যাক মূল গল্পে। এই গল্পের খলনায়ক হলেন হেনরি এভারি। তার  জন্ম  ইংল্যান্ডের প্লেমাউথে। তিনি ছিলেন একজন জলদস্যু। তিনি দ্য কিং অফ পাইরেটস নামে পরিচিত। প্রথম জীবনে তিনি এক সময় রাজকীয় নৌবাহিনীতে কাজ করতেন।
পরবর্তিকালে অসদাচরণের জন্যে তাকে নৌবাহিনী থেকে বহিস্কার করা হয়। তারপর তিনি জলদস্যুতার কাজে জড়িয়ে পড়েন। তিনি চার্লস-২ নামে যুদ্ধজাহাজে যোগ দেন। তাদের গন্তব্য ছিল ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। কিন্তু জাহাজের মালিক তাদের বেতন দেওয়া বন্ধ করায় এভেরি’র নেতৃত্বে জাহাজের নাবিকরা বিদ্রোহ করলেন এবং দখল করে নেন জাহাজটি। এটা ছিল ১৬৯৪ সালের ঘটনা। এভারি জাহাজের নতুন ক্যাপ্টেন হবার পর জাহাজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ফেঞ্চি।

Henry Avery

জাহাজ ফেঞ্চি মান্দাব প্রণালীতে পৌঁছুলে সেখানে তিনি থমাস টিউ সহ চারজন জলদস্যুদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। ফেঞ্চি ছিল সেই সময়ের সব চেয়ে দ্রুতগামী জাহাজ। এই জাহাজ নিয়েই জলদস্যুদের নিয়ে আফ্রিকা উপকূল থেকে পাঁচটি জাহাজ লুট করে এবং লোহিত সাগরে এসে মক্কা ফেরত জাহাজ গঞ্জ – ই – সাওয়াইয়ের ধন – সম্পদ লুট করেছিল।
গঞ্জ – ই – সাওয়াই ছিল সুরাট বন্দরের সব থেকে বড় মোঘল জাহাজ, যার অর্থ ‘অসীম সম্পদ’। ব্যবসা শেষে লভ্যাংশ হিসেবে গঞ্জ-ই-সাওয়াই এর সাথে ছিল বিশাল পরিমানের টাকা পয়সা, সোনা রুপা। সেই সময়ে মুঘলদের ২৫টি জাহাজের একটি বহর মক্কা থেকে ফিরছিল। গঞ্জ – ই – সাওয়াই জাহাজ সুরক্ষার জন্য ইব্রাহিম খানের কাছে ছিল ৮০ টি কামান এবং ৪০০ টি বন্দুক। জাহাজে হজ্জ যাত্রীদের সাথে আরও ছয়শ-এর মত যাত্রী এবং মক্কা থেকে কেনা কিছু তুর্কি দাসিও ছিল।

Treasure

রাতে বেশিরভাগ জাহাজ এভরির জাহাজের পিছনে চলে যায়। জলদস্যুরা প্রথমে যে জাহাজটিকে আক্রমণ করেছিল সেটি ছিল ফতেহ মোহাম্মদ নামে ছোট সৈন্যদলের জাহাজ। কিন্তু এই জাহাজটি তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল না। প্রধান লক্ষ্য ছিল গঞ্জ – ই – সাওয়াই। ফতেহ মোহাম্মদ জাহাজের ক্যাপ্টেনকে হত্যা করে সেখান থেকেও প্রায় ৫০,০০০ পাউন্ড সমমূল্যের সোনা দখল করে। এরপরেই তারা গঞ্জ – ই -সাওয়াইকে আক্রমণ করে। গঞ্জ – ই সাওয়াই তখন সুরাট থেকে ছিল মাত্র ৮ দিনের দূরত্বে।
গঞ্জ – ই – সাওয়াই এর তুলনায় ফেঞ্চি ছিল একটি হালকা জাহাজ। এই ফেঞ্চিকে আসতে দেখে গঞ্জ – ই -সাওয়াই মোটেও ভয় পায়নি। বরং তারাই প্রথম আঘাত হানে। কিন্তু কপালের ফের, দুৰ্ভাগ্যবশতঃ তাদের একটি কামান ব্লাস্ট করে অনেক সৈন্য মারা যায় ও জাহাজের এক দিকে আগুন ধরে যায়। পুরো জাহাজে তখন বিশৃঙ্খল অবস্থা। সকলে দিশেহারা।

A woodcut from The Pirates Own Book showing the Fancy engaging the Gunsway

ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে আক্রমণ করে এভারি। কিন্তু বিজয় অতটাও সহজ ছিল না। মোঘল সৈন্যরা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। টানা ২ ঘন্টা যুদ্ধ শেষে এভারি জয়ী হয়।
তারপর শুরু করে লুঠতরাজ। জাহাজে ছিলেন মক্কা থেকে হজ করে ফেরা নারী সহ প্রচুর মুসলিম তীর্থযাত্রী এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের পৌত্রী এবং তাঁর সহচরীরা ছিলেন। এঁদেরকে নির্মম ভাবে হত্যা করেন এভেরি আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা। মেয়েদের হয় সম্মানহানি। সন্মান বাঁচানোর জন্য অনেক মহিলা জাহাজের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন, অনেকে ঝাঁপ দেন জলে। দখল করলেও তারা জানতো না ধন – সম্পদ গুলো কোথায় লুকানো আছে। তা খুঁজে পেতে তারা যাত্রীদের উপর আরও নির্যাতন চালায়। এক সময় তারা সেগুলো খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। সম্রাটের পৌত্রীর ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল তা অবশ্য সুনিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। অনেকে বলেন যে এভেরি নিজের সাথে নিয়ে চলে যান সম্রাটের পৌত্রীকে এবং বিয়ে করে নেন তাঁকে।
লুট করা সম্পদের মধ্যে ছিল ৫০০,০০০ সোনা ও রুপার মুদ্রা, যা বর্তমান ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১১০০ হাজার কোটি রুপি। পরবর্তীতে জলদস্যুরা নিজেদের মধ্যে ১,০০০ রুপার মুদ্রা করে ভাগাভাগি করে নেয়, যা তাদের সারা জীবনের আয়ের থেকেও অনেক বেশি ছিল।

Henry Every’s encounter with Emperor Aurangzeb’s granddaughter and her retinue.

লুটপাট চলাকালীন সময়ে ৯ জন ক্রু কোনোরকমে পালিয়ে সূরাটে চলে আসে এবং সেখানকার গভর্নর ইতিমাদ খানকে জাহাজে আক্রমণের বীভৎস বর্ণনা দেন। গভর্নর সাথে সাথেই মোঘল যুদ্ধ জাহাজের সাথে ফ্রেঞ্চ ও ডাচদের আরও ৪ টি জাহাজ সংগ্রহ করে গঞ্জ – ই – সাওয়াইকে উদ্ধারের জন্যে পাঠায়। কিন্তু তারা খালি হাতে ফেরত আসে। তখনও সেটি  নিখোঁজ ছিল। ২/৩ দিন পর গঞ্জ – ই – সাওয়াই ফেরত আসে। বেঁচে থাকা যাত্রীদের মুখে অত্যাচারের বীভৎস বর্ণনা শুনে সুরাতের জনগণ ভীষণ খেপে উঠে এবং ব্রিটিশদের ফ্যাক্টরিকে ঘেরাও করে। তারা নিশ্চিত ছিল এই জলদস্যুরা ব্রিটিশ ছিল এবং বোম্বের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদস্যদের সাথে তাদের গভীর যোগাযোগ ছিল। কারণ কিছুদিন আগেই চাইল্ডস ওয়ারে ব্রিটিশরা মোঘলদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। তারা মনে করেছিল সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই ছিল এই আক্রমণ।

An 1837 woodcut from The Pirates Own Book by Charles Ellms depicting Henry Every receiving three chests of treasure on board his ship, the Fancy

এই ঘটনাতে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কারণ ওই জাহাজে মোঘল সাম্রাজ্যের সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারের বহু মহিলা ছিলেন। তাছাড়া সেই জাহাজে তার নিকট আত্মীয়ও ছিল। চুপ তো থাকা যায় না l তাই তিনি তাঁর রাজত্বের সমস্ত ইউরোপীয়দের বাণিজ্য বন্ধ করার কঠোর নির্দেশ দেন। তবে সম্রাট ছিলেন একজন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি বুঝতেন ব্যবসা ছাড়া চলবে না,এই জন্য বিদেশী সংস্থাগুলোকে ভারতীয় জাহাজের নিরাপত্ত্বা বিধান নিশ্চিত করার জন্যে তাদেরকে বাধ্য করলেন।
আওরঙ্গজেবের বাণিজ্য জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং সেই অনুযায়ী তারা একটি সশস্ত্র দল সরবরাহ করতে সম্মত হয়। এইভাবেই আওরঙ্গজেব চূড়ান্তভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করেছিলেন।

Avery sells his Jewels, an engraving by Howard Pyle which appeared in the September 1887 issue of Harper’s Magazine

ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন তখন তৃতীয় উইলিয়াম। ডাকাতির মূল হোতাকে ধরে দিতে তাঁর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে ভারতবর্ষের অধিপতি সম্রাট আওরঙ্গজেব ও ট্রেডিং জায়ান্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং সেই কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনে পরিচালনা বোর্ড হেনরি এভারির মাথার দাম ৫০০ ডলার রেখে ধরিয়ে দেবার ঘোষণা দেন। শুরু হল চিরুনি তল্লাশি। এভারির ক্রুদের বেশ কয়েকজনকে ইংল্যান্ডে আটক করা হয়েছিল। অবশ্য এভারি নিজে কখনও ধরা পড়েনি। নির্মম এই ঘটনার জন্য সেই সময়ই পৃথিবীর মোস্ট ওয়ান্টেড খুনি হিসেবে পরিচিত হন এভারি। গুজব আছে, ইংল্যান্ডের ডেভনে তিনি সারা জীবন দারিদ্র্যের মধ্যে কাটিয়েছেন।  মোঘল সাম্রাজ্যের রাজকন্যার সাথে সংসার বাঁধেন। তাদের একটি পুত্র জন্ম নেয়, যে টম সিমিলাহো নামে পরিচিত। ইউরোপীয়রা তাকে মুলাত্তো টম নামে জানতো। সেই ছেলে পূর্ব  মাদাগাস্কারে নিজের জন্য একটি রাজ্য তৈরি করে। এখনও মাদাগাস্কারে বসবাস করা জলদস্যুদের বংশধরদের মুলাত্তো বলে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ২০১২ সালে রোড আইল্যান্ডের মিডলটাউনে  জিম বেইলি নামে এক লোক তার বাগানে খোঁড়াখুঁড়িতে অষ্টাদশ শতকে তৈরি একটি জুতার বকলেস ও কয়েকটি গাদাবন্দুক পেয়েছিল। তারপর  আরও অনুসন্ধান চালানোর পরে পুরোনো একটি পয়সা খুঁজে পান। যার ওপরে আরবিতে কিছু লেখা আছে দেখে।
০১৪ সালের পর বিভিন্ন সময়ে খোঁড়াখুঁড়িতে সেই একই আমলের আরও অন্তত ১৫টি আরবি মুদ্রার সন্ধান পাওয়া যায়, যার মধ্যে ১০টি পাওয়া যায় ম্যাসাচুসেটসে, তিনটি রোড আইল্যান্ড, আর দুটি কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে। এইসব নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে গবেষণার পর কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যের প্রত্নতত্ত্ববিদ সারাহ স্পোর্টম্যান দাবি করেন, আসলে হেনরি এভারি ও তার সঙ্গীদের অনেকেই নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী বসবাস শুরু করেছিলেন। আর আমেরিকার মাটিতে পা রেখে ক্রীতদাস ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন এভারি। তিনি কিছু ক্রীতদাস নিয়ে ১৬৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রোড আইল্যান্ডের নিউ পোর্টে গিয়ে হাজির হন। অষ্টাদশ শতকে এই রোড আইল্যান্ড ক্রীতদাস ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র ছিল।
যাইহোক, এভাবেই ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা ভারত উপমহাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে গেছে এবং পাশাপাশি উপমহাদেশের মহিলাদের হত্যা ও ধর্ষণের মত ন্যাক্কারজনক কাজ করেছে।

এরকম অনেক ছোটোখাটো  ইতিহাস আছে মোঘল সাম্রাজ্য ও আমাদের এই উপমহাদেশের, যা আমরা জানার চেষ্টা করব।

A 17th-century Arabian silver coin top that research shows were struck in 1693 in Yemen, rests near an Oak tree Shilling minted in 1652 by the Massachusetts Bay Colony, below, and a Spanish half-real coin from 1727, right, on a table, in Warwick, RI. (Ap Photo/Steven Senne)

তথ্যসূত্র:
1. An 1837 woodcut from The Pirates Own Book by Charles Ellms depicting Henry Every receiving three chests of treasure on board his ship, the Fancy
২. উইকিপিডিয়া ও  ইন্টারনেট।