ঝি ঝি পোকা ডাকছে। মানে বিকেল ৫ টা বেজে গেছে একটু পরেই নামবে অন্ধকার। এত তাড়াতাড়ি অন্ধকার নামার কারণ এখানকার ঘন গাছ-পালা। পাখিরা শেষ বারের মত তাদের ভাব আদান – প্রদান করছে বুঝা যাচ্ছে তাঁদের কিচিরমিচির শব্দের আধিক্য শুনে। সূর্য অস্ত হতেই গা থমথমে পরিবেশ। তারওপর পাতায় জমে থাকা বৃষ্টি ফোঁটা পরার টুপটাপ শব্দ। এমন সময় নদীর তীরের মন্দিরটায় রাজপত্নী সন্ধ্যাপ্রদীপ দিচ্ছে। আর রাজা শ্রী বীরেন্দ্র কুমার কাছারি বাড়িতে দিনের শেষ হিসেব টা দেখছেন। কাজ শেষে মস্ত বড়ো একটা ঘরে গেলেন যেখানে হাজারো বই।কলেরগান চালিয়ে গান শুনছেন আর হাতে একখানা বই নিয়ে পড়ছেন ফাঁকে ফাঁকে ফুক দিচ্ছেন হুঁকায়। সংগ দিচ্ছেন বৃদ্ধ পুষা কুকুর। পুজা পার্বণে বিশাল আয়োজন, গান, বাজনা, খাজনা, ইত্যাদি নিয়ে জগদল বাড়ি সারাক্ষণ মেতে থাকে। হঠাৎ বাংলা ভাগ l ১৯৪৭ দেশ ভাগের ভয়াবহ অবস্থা। রাজবাড়ি ছেড়ে রাজা পাড়ি দিলেন ওপার বাংলায়। সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর সব পোষা কুকুর। কিন্তুু গেলো না রাজার পাশে থাকা সংগ দেওয়া বৃদ্ধ কুকুরটি l হয়তো বাড়ির মায়া ছাড়তে পারে নি। রাজবাড়িটি চলে গেল পাকিস্তান সরকার এর দখলে। বিরাট এই বাড়িতে নিরবতা আর কুকুরটির অসহায় চাহনি এই বুঝি মালিক এলো। রাজবাড়িতে অতিথি এলো সরকারি চাকরি সূত্রে থাকতে। কুকুরটির নিঃসঙ্গতার অবসান হলো। অতিথির ছেলে কুকুরটির নাম দিলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার। টাইগার আর ছেলের পরিবার এর বেশ ভাব হলো। টাইগার এখন ওদের সাথেই খায় তবে থালায় ঝোল মাখা ভাত। একদিন ছেলেটিসহ তাঁর ভাইবোন সবার ম্যালেরিয়া হলো, ঘন জঙ্গল মশার উপদ্রব বলে কথা। তাঁরা সকালে মন্দির এর চাতালে বসে রোদ পোহাচ্ছিল। এমন সময় মন্দির হতে বেরিয়ে এলো বিরাট এক কেউটে সাপ। ছেলেটি দূরে সরে গেলেও তাঁর ছোট ভাই শাহীন সবে বসতে শিখেছে, সে সাপের মুখে পড়েছে। ফণা তুলবে এমন সময় টাইগার এসে ঝাঁপিয়ে সাপটিকে কামড় দিয়ে ছিঁড়ে ফেললো। সেই ছেলেটি হলো বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্র হুমায়ুন আহমেদ। দু দিন পর টাইগার এর শরীরের মাংস গলতে শুরু করলো, সাপের কামড় এর জন্য এমন হয়েছিল। কুকুরটির মৃত্যু আর্তনাত সইতে না পেরে হুমায়ুন পিতা গুলি করে কুকুরটিকে মুক্তি দিয়েছিল। এ জগদল রাজবাড়ির আঙিনায় একদিন রাজা – প্রজার ভিড় ছিলো। বাংলা সাহিত্যের নন্দিত লেখক হুমায়ুন এর ছোটবেলার কত স্মৃতি ছিলো। এ আঙিনায় উপকার এর মহান দৃষ্টান্ত টাইগার এর ত্যাগ নিয়ে হুমায়ুন এর নিয়তি গল্প লেখা হয়েছিল। কে জানতো এই জগদল রাজবাড়ি হবে ধ্বংসস্তুপ, আবর্জনা ফেলার স্থান, রাজবাড়ির নান্দনিক নকশা নেই, সাজসজ্জা নেই, শুধু দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা ইটের কয়েকটা দেওয়াল। হয়তো এটাই নিয়তি l সেটা মানুষ সৃষ্ট বা প্রকৃতি সৃষ্ট হোক না কেন জন্মে সজ্জিত হলে বিনাশ হতেই হবে।

Contributed by Jerin Akter