তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের সূর্য যখন প্রায় অস্তমিত, ঠিক সে সময় ইস্তাম্বুলের রাজপ্রাসাদে ১৯১৬ সালের ৪ জানুয়ারি জন্ম নেয় এক ফুটফুটে মেয়ে শিশু। মেয়েটির নাম রাখা হয় নিলুফার হানিম সুলতান গোজতেপি। তার অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে তাকে ‘সৌন্দর্যের দেবী’ বলা হতো। তিনিই ছিলেন ‘হায়দ্রাবাদের কোহিনূর’। কিন্তু তুরস্কের রাজকন্যা হায়দ্রাবাদে গেলেন কি করে?
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্কের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এক পর্যায়ে অটোমান খেলাফতকে বিলুপ্ত করা হয়। সে সময় ওসমানী রাজপরিবারের ১২০ জন সদস্যের সবাইকে তুরস্ক থেকে বহিঃষ্কার করা হয়। নিজ দেশে স্থান না পেয়ে অসহায় শেষ খলিফা আব্দুল মজিদ ১৯২৪ সালে গোটা পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। খলিফা পরিবারের সবাই তখন ছিলেন ক্ষুধার্ত, গৃহহীন ও দরিদ্র।
![](https://bangla.staycurioussis.com/wp-content/uploads/2023/05/তুর্কি-রাজকন্যা-নিলুফার-933x1024.jpg)
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে রাজকন্যা নিলু © medium.com
সাদামাটা এক সাধারণ জীবন কাটাতে শুরু করেন তারা। ঐ সময় হায়দ্রাবাদের নিজামরা ছিলেন ভারতবর্ষে স্থায়ী হওয়া পারস্যের একটি অভিজাত বংশের অন্তর্গত। তারা খলিফা পরিবারের জন্য প্রতি মাসে ৩০০ পাউন্ড পাঠিয়ে বিপদাপন্ন ওসমানী রাজকন্যাদের লেখাপড়ার খরচ পরিচালনাসহ তাদের পুরো পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণের ভার নেন।
মাত্র দুই বছর বয়সে বাবা-হারা আট বছর বয়সী নিলুফার চাচার ছায়ায় বড় হতে থাকেন প্যারিসে। ষোলো বছর বয়সে ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের প্রিন্সলি স্টেট হায়দ্রাবাদের শেষ নিজামের দ্বিতীয় ছেলে মুয়াজ্জম জাহের সাথে তার বিয়ে হয়ে যায়। নিজামের বড় ছেলের সঙ্গে আগেই বিয়ে ঠিক হয়েছিলো নিলুফারের চাচাতো বোন ও আব্দুল মজিদের মেয়ে দুরুশেহভারের। নিজামেরই ইচ্ছা ছিলো, ছোট ছেলের বিয়েটাও যেনো একই অনুষ্ঠানে হয়ে যায়।
![তুর্কি রাজকন্যা নিলুফারের হায়দ্রাবাদী কোহিনূর](https://miro.medium.com/v2/resize:fit:786/format:webp/1*6x-b1MIXX2XpWYPzcuh4kg.jpeg)
দুররু শেহভার (বাঁয়ে) এবং তার চাচাতো বোন নীলুফারের দ্বৈত বিবাহ © medium.com
ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত ফ্রান্সের নিস শহরে অনুষ্ঠিত হয় বিয়েটি। এই বিয়ের পেছনে অবশ্য দুই পরিবারের রাজনৈতিক কারণও ছিলো। নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক হলেও খলিফার পরিবারের উপর সমস্ত মুসলিম জাহানের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিলো। ঐ দিকে মুঘলরা ক্ষমতা হারাবার পর নিজামরাই অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের সবচাইতে ধনী মুসলিম হিসেবে আবির্ভূত হন। তাছাড়া আগেই বলেছি, নিজামদের সাথে পারস্যের অভিজাত বংশের ছিলো রক্তের সম্পর্ক। নির্বাসিত খলিফা পরিবারের সদস্যরা নিজাম পরিবারের সাথে আত্মীয়তা তৈরীতে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে।
ভারতবাসীরাও খেলাফত আন্দোলনে ছিলো বেশ সক্রিয়। এমন অবস্থায় ভারতের মুসলিম নেতাদের মধ্যে ধারণা হয়েছিলো যে, ওসমানী খলিফার মেয়েদের সাথে নিজামের ছেলেদের বিয়ে হলে মুসলিম উম্মাহ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং নিজামরাও মুসলিম বিশ্বের প্রধান নেতা হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। তাই তুর্কি রাজকন্যাদের বহু পানিপ্রার্থী থাকা সত্ত্বেও সবাইকে পেছনে ফেলে নিজামরাই জয়ী হলেন; আর পেছনে পড়ে রইলেন ইরাক, ইরান ও আরব দেশের রাজপুত্ররা।
দুই পরিবারের এই বিয়ের সম্পর্কের মাধ্যমে ভারতবর্ষ পরিচিত হয় তুর্কী আভিজাত্য ও সংস্কৃতির সাথে। বিয়ের পর জাহাজে করে প্রথমবারের মতো ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন নিলুফার, সাথে ছিলেন বোন দুরুশেহভার। জাহাজে আসতে আসতেই নিলুফাররা ভারতীয় আদব-কায়দা রপ্ত করতে শুরু করলেন। কিভাবে নিজামদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করতে হবে, কিভাবে শাড়ি পরতে হবে, সেই শিক্ষাও তিনি জাহাজে অবস্থানকালেই নিতে শুরু করলেন।
![তুর্কি রাজকন্যা নিলুফারের হায়দ্রাবাদী](https://bangla.staycurioussis.com/wp-content/uploads/2023/05/প্রিন্সেস-নীলুফার.jpeg)
প্রিন্সেস নীলুফার ও প্রিন্স মুয়াজ্জম জাহ
নবদম্পতিরা হায়দ্রাবাদে পৌঁছালে ১৯৩২ সালের ৪ জানুয়ারি নিজামদের চৌমহল্লা প্রাসাদে বিশাল এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়। নতুন জায়গায় স্বাধীনচেতা নারী নিলুফার নিজেকে একটু একটু করে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।
ভারতবর্ষে আসার পর সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও একটু একটু করে বহু অভিজাত পরিবারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বেগুনী চোখ, নীল-কালো কোঁকড়ানো চুলের এই অসাধারণ সুন্দরী নারী ভারতবর্ষে অল্প সময়েই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। তার মানবতাবাদী চেতনা, অপরূপ সৌন্দর্য এবং নিজেকে উপস্থাপন করার অতুলনীয় দক্ষতা তাকে সর্বজনের প্রিয়পাত্র করে তুলেছিলো।
ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ করে ফ্রান্সে বেড়ে ওঠা নারী নিলুফারের সব পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার অদ্ভূত ক্ষমতা ছিলো। ভারতীয় শাড়িতে অভ্যস্ত না হওয়া সত্ত্বেও খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই এই শাড়িকে তিনি নিজের করে নিয়েছিলেন। এতো সুন্দর করে তিনি শাড়ি পরতেন যে, ভারতবর্ষের মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখতেন।
শুধু শাড়িই নয়, পর্দা-প্রথার এই মুসলিম সমাজে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সুন্দর সুন্দর গাউন, এমনকি কাঁধ-খোলা পোশাক পরেও একইভাবে দ্যুতি ছড়িয়েছেন এই তুর্কি শাহজাদী। তিনি ভারতীয় শাড়িকে পাশ্চাত্যয়ন করবার নানা রকম চেষ্টা করেছেন। প্রাচ্য এবং পশ্চিমের সংস্কৃতির মিশেলে ‘শাড়ি’ নামের পোশাকটিকে তিনি সবার কাছে উপস্থাপন করেছেন। নিলুফারের শাড়ি মুম্বাইয়ের শীর্ষ ডিজাইনাররা তৈরী করতেন বিশেষভাবে। প্যাস্টেল রং ছিলো তার খুবই প্রিয়। শাড়িতে প্যাস্টেল রং এর ব্যবহারের মাধ্যমে চিরাচরিত ভারতীয় গাঢ় রঙের শাড়িকে তিনি পরিণত করলেন স্নিগ্ধ ও শেডেড এক পোশাকে। আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠলেন সেই সময়কার তরুণীদের আইকন।
![তুর্কি রাজকন্যা নিলুফারের হায়দ্রাবাদী](https://bangla.staycurioussis.com/wp-content/uploads/2023/05/Nilufar.jpg)
স্নিগ্ধ রাজকুমারী নীলুফার শাড়িতে
বিশ্ববাসীর কাছে নিলুফার গ্রহণযোগ্য করে তুলে ধরেছিলেন ভারতবর্ষের সংস্কৃতিকে। এক পর্যায়ে হলিউড, বলিউড থেকেও তিনি একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব পেতে শুরু করলেন। তবে এসবে তেমন কোনো আগ্রহ তিনি দেখান নি। নিজেকে ফ্যাশনের জগতে প্রতিষ্ঠিত করবার কোনো ইচ্ছে না থাকলেও প্যারিস এবং লন্ডনের ফ্যাশন শোগুলোতে তাকে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিলো। অনেক সময় পুত্রবধূদের সৌন্দর্যের বড়াই করবার জন্যই নাকি নিজাম জমকালো পার্টির আয়োজন করতেন বলে জনশ্রুতি ছিলো।
নিকাব ছেড়ে জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে চিরাচরিত পর্দা প্রথাকে ভেঙে ফেলবার মতো সাহসী কাজ করেছিলেন নিলুফার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নার্সিং প্রশিক্ষণ নিয়ে দুস্থদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এই আত্মবিশ্বাসী নারী। বিমান আক্রমণের সময় কিভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হবে, সেই বিষয়ের উপরও সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতেন নিলুফার। ১৯৪৬ সালে তার গৃহকর্মী রাফাত বাচ্চা প্রসবের সময় রক্তক্ষরণে মারা গেলে এই ঘটনা তাকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। নিলুফার যেনো নিজের অজান্তেই বলে ওঠেন, “আর কোনো রাফাত নয়!” আজও তার এই কথা স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
রাফাতের মতো আর কোনো নারীর ভাগ্যে যেনো এমন মৃত্যু না ঘটে সে জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করতে শুরু করলেন। তিনি হায়দ্রাবাদে নারী ও শিশুর জন্য একটি হাসপাতাল তৈরী করলেন। শুধু তা-ই নয়, দরিদ্র মায়েদের খাদ্য ও আর্থিক সাহায্যেরও ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি, যেনো সবাই সুষ্ঠুভাবে চিকিৎসা সেবা লাভ করতে পারেন।
![](https://bangla.staycurioussis.com/wp-content/uploads/2023/05/Ottoman-Princesses-1024x576.jpg)
হায়দ্রাবাদে নিলুফার হাসপাতাল
হাসপাতালের কাজ কিছুটা বাকি রেখেই ১৯৪৮ সালে ভারতবর্ষ ছেড়ে তিনি প্যারিসে চলে যান। আর কখনোই হায়দ্রাবাদে তিনি ফিরেন নি। হায়দ্রাবাদের মানুষেরা তাকে ভালোবেসে হাসপাতালের নাম ‘নিলুফার’-ই রেখেছিলেন। আজও সেই হাসপাতাল শহরের সেরা প্রসূতি হাসপাতাল হিসেবে দণ্ডায়মান।
এতো কিছুর পরও নিলুফারের সংসার কিন্তু সুখের হয় নি। স্বামীর সাথে খুব একটা ভালো সম্পর্ক তার ছিলো না। স্বামী কবিতা ও গান নিয়ে পড়ে থাকতেন। নিজামের কাছে এ ব্যাপারে নালিশ করেও কোনো লাভ হয় নি। আসলে সম্পূর্ণ দুই জগতের দুই বাসিন্দা ছিলেন নিলুফার ও মুয়াজ্জম। ১৯৫২ সালে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে তাদের মধ্যে। এই বিচ্ছেদের পেছনে আরও একটি কারণ ছিলো। নিলুফার শত চেষ্টা করেও মা হতে পারেন নি। আর তাই হয়তো স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাদের সম্পর্কটাও বেশি সফল হতে পারে নি।
![রাজকন্যা নিলুফার](https://miro.medium.com/v2/resize:fit:640/format:webp/1*H-WHEDW4qOLxansG4CRo3g.jpeg)
প্রিন্সেস নীলুফারের 100তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধ © medium.com
প্রায় এগারো বছর একা থাকার পর নিলুফার ১৯৬৪ সালে অ্যাডওয়ার্ড পোপ নামের একজনকে বিয়ে করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান নিলুফার এবং প্যারিসেই তাকে সমাহিত করা হয়। তার সৌন্দর্য, স্টাইল ও মানবপ্রেম মৃত্যুর পরও তাকে বিশ্বদরবারে সুপরিচিতি করে রেখেছিলো।
রেফারেন্স: