ইউরোপে যখন প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ চলছে তখন ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলিমরা একে অন্যের কাছ থেকে শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে নিজেদেরকে মেলে ধরেছিল। ১৫৫৫ সালে সম্রাট আকবর যখন ভারতের ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন তখনকার মুঘল সাম্রাজ্যের আয়তনের তিনগুণ হয়ে দাঁড়ায় ১৬০৫ সালে, সম্রাটের মৃত্যুর বছরে। আকবরের সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে উভয় ধর্মের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাম্রাজ্যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটেছিল। আকবর এটা টের পেয়েছিলেন যে বৃহৎ এই সাম্রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনসংখ্যাকে পাশ কাটিয়ে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাই তিনি হিন্দুদের বড় বড় পদে বসিয়ে, হিন্দু সংস্কৃতিকে মূল্যায়ন করে নিজের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা তৈরি করে নিয়েছিলেন এবং সাম্রাজ্যে স্থিতিশীলতা নিয়ে এসেছিলেন। আকবরের আমলে হিন্দু সংস্কৃতিকে কতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল তার একটা উদাহরণ পাওয়া যায় সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারতের পারসিয়ান অনুবাদে। মহাভারতের পারসিয়ান অনুবাদের নাম দেওয়া হয়েছিল রাজমনামা বা যুদ্ধের গল্প। প্রায় দুই বা চার বছর সময় নিয়ে সম্রাটের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মহাভারতের ফার্সি অনুবাদ সম্পন্ন হয়। এই অনুবাদ কার্য শেষ করা হয় সংস্কৃত পণ্ডিত ও ফার্সি পণ্ডিতের যৌথ উদ্যোগে।
১৫৭৪ সালে সম্রাট ফতেহপুর সিক্রিতে মক্তব খানা নামে একটি অনুবাদ বিভাগ চালু করেন। আকবরের উদ্দেশ্য ছিল ফার্সি প্রাধান্যের তার সাম্রাজ্যে হিন্দু মহাকাব্যের অনুবাদ তার সাম্রাজ্যকে অধিক ইসলামীকরণ থেকে মুক্ত করে হিন্দু প্রজাদের আত্মীকরণ করতে সহায়তা করবে। যেহেতু হিন্দুস্তান হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। তিনি মনে করেছিলেন হিন্দু মহাকাব্যের (মহাভারত ও রামায়ণ) তাকে হিন্দুদের নিকট আরো জনপ্রিয় করে তুলবে। এছাড়া সম্রাট আকবর ছিলেন মনেপ্রাণে এক আন্তঃধর্মীয়, আন্তঃসাংস্কৃতিক চর্চার একজন পৃষ্ঠপোষক। রাজনৈতিক কারণ বাদ দিলেও সম্রাট তার কর্মকাণ্ডে সবসময় আন্তঃসাংস্কৃতিক একটা আবহ তৈরি করে আনন্দ পেতেন। সেই আদর্শ থেকেই মহাভারতের এই ফার্সি অনুবাদ রাজমনামায় তিনি হাত দেন। তিনি ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থগুলোও আরবি থেকে ফার্সিতে অনুবাদ করিয়েছিলেন যাতে উভয় ধর্মের মানুষ তাদের পবিত্র গ্রন্থ একটি অভিন্ন ভাষায় পড়তে পারে।
এক লক্ষ লাইন বা শ্লোকের মহাভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের অনুবাদ রীতিমতো এলাহি একটা ব্যাপার ছিল৷ এই অনুবাদ কার্য শেষ করতে ১৫৮৪-৮৬ অর্থাৎ দুই বছর সময় লেগে। যদিও ঐতিহাসিক বাদায়ূন বলেছিলেন মোট চার বছর লেগেছিল রাজমনামা অনুবাদে। মুসলিম ফার্সি পণ্ডিত ও সংস্কৃত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মিলিত প্রচেষ্টায় এর অনুবাদ কার্য সম্পন্ন করা হয়। এই অনুবাদ কার্য সম্পন্ন করা হতো কয়েকটি ধাপে। প্রথম ধাপে সংস্কৃত পণ্ডিতরা মহাভারতের কাহিনি ব্যাখ্যা করতেন, পরের ধাপে মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদ নকিব খান তার ফার্সি অনুবাদ করতেন এবং তার পরের ধাপে আকবরের সভাকবি ফৈজি এই ফার্সি অনুবাদের কাব্য বা গদ্যরূপ দিতেন। ফার্সি শব্দ রাজম এর অর্থ ছিল যুদ্ধ এবং নামা শব্দের অর্থ ছিল গল্প। রাজমনামা মানে যুদ্ধের গল্প। ১৫৮৪-৮৬ সালের প্রথম পাণ্ডুলিপিতে ১৭৬ টি চিত্র আছে। এই প্রকৃত পাণ্ডুলিপিটি বর্তমানে রাজস্থানের জয়পুরে সংরক্ষিত আছে। সমসাময়িক ঐতিহাসিক বাদায়ূন তার মুন্তাখাব-ই-তাবারিক বইতে রাজমনামা অনুবাদ প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন এভাবে,
“ভারতের পণ্ডিতদের জড়ো করে মহামতি সম্রাট মহাভারতের অনুবাদ করতে মনস্থির করেন। প্রায়ই রাতে সম্রাট নকিব খানকে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা করতেন যিনি কিনা মহাভারতের সংস্কৃত গল্প ফার্সিতে অনুবাদের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তৃতীয় রাতে সম্রাট আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং নকিব খানের সাথে অনুবাদ কাজে সহযোগিতা করতে বলেন। তিন চারমাসে ১৮ টি অধ্যায়ের মধ্যে আমি মাত্র দুইটি অধ্যায়ের কাজ শেষ করতে পারি। তারপরে নকিব খান একটি সর্গ শেষ করেন। আরেকটি সর্গ সুলতান হাজি থানেশরী শেষ করতে সমর্থ হোন। তারপরে ফৈজি এই অনুবাদকৃত ফার্সি অংশকে গদ্য ও কাব্যে রূপান্তর করেন। যদিও তিনিও মাত্র দুইটি অধ্যায়ের বেশি রূপান্তর করতে পারেননি। “
অনেক ভুল ত্রুটি সংশোধন করে হাজী থানেশরের মাধ্যমে আরো হিন্দু পণ্ডিতদের সাহায্যে অবশেষে রাজমনামা সম্পন্ন হয়। রাজমনামা নামটি দিয়েছিলেন স্বয়ং সম্রাট। অনুবাদ কার্য শেষ হলে এর অনেক অনুলিপি তৈরি করা হয় এবং সাম্রাজ্যের আমীরদের কাছে এটি বণ্টন করা হয়। রাজমনামার অনেক অনুলিপিতে নকিব খানের জবানে এই উক্তিটি দেখতে পাওয়া যায়,
“আব্দুল লতিফ হোসাইনীর পুত্র নকিব খান দেড় বছর সময় নিয়ে সংস্কৃত থেকে ফার্সি ভাষায় এর (মহাভারত) অনুবাদ করেন। বেশ কয়েকজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত যেমন, দেব মিশ্র, মধুসূদন মিশ্র, সত্যবধন,চতুর্ভুজ, শাইক ভবন এই বইটি পড়েন এবং আমাকে হিন্দিতে ব্যাখ্যা করে দেন। এই অধম (নকিব খান) তারপর বইটিকে ফার্সি ভাষায় লেখা শেষ করেন”
বইটির ভুমিকা লিখেছিলেন সম্রাট আকবরের রাজকীয় ঐতিহাসিক আবুল ফজল। এর দ্বিতীয় কপি ১৫৯৮-৯৯ সালের দিকে শেষ করা হয়। ১৫৮৪-৮৬ সালে যে কপিটি সম্পন্ন করা হয়েছিল সেই কপি থেকে নতুন এই কপি আরো বিস্তৃত আকারে সম্পন্ন করা হয়। নতুন এই কপিটিতে ১৬১ টি চিত্র সম্বলিত। এই কপি রাজকীয় পরিবারের সকল সদস্যকে উপহার হিসেবে দেয়া হয় যাতে তারা হিন্দু ধর্মকে বুঝতে পারে। সম্রাট আকবর চেয়েছিলেন বইটিকে সাম্রাজ্যের সবকটা প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে। তাই এই বইটি হাতে তৈরি এবং চিত্র সম্বলিত হয়। মূল রাজমনামা বইটি এখন রাজস্থানের জয়পুরের সিটি প্যালেসে সংরক্ষিত আছে। রাজমনামার সাথে আছে ফার্সি ভাষায় অনুবাদকৃত রামায়ণও। ১৬৯০ সাল থেকে এই দুই বইটি প্যালেসটিতে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। পারিবারিক বিবাদের জের ধরে রাজমনামার মূল পাণ্ডুলিপি ইতিহাসবিদ ও চিত্র ইতিহাসবিদদের কাছে এখনো অধরাই রয়ে গেছে। এই রাজমনামা ইতিহাসের এক শক্ত দলিল যেখানে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির পাশাপাশি ভারতে সম্রাট আকবরের শ্রেষ্ঠতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।