আয়েনা বালমা, কা করে সজনী-পুরান ঢাকার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো রুপলাল হাউজের নূপুরের ঝংকার, মদিরার নেশা। সে সময় ঢাকায় উর্দ্ধতন ইংরেজ কর্মকর্তা সাহেবরা কোন সরকারি অথবা ব্যক্তিগত কাজে বেড়াতে এলে তাদের ঠিকানা ছিলো আহসান মঞ্জিল। শাসক ইংরেজ বা বিদেশীদের তোষণ নবাবদের দ্বায়িত্বের মধ্যেই ছিলো। কিন্তু সময়ের পথচলায় সেটিরও একটি বিকল্প গড়ে উঠেছিলো সেদিনের সেই পুরনো ঢাকায়। সেটি হলো রুপলাল হাউজ। সূত্রাপুর থানাধীন ৭৯ নং ওয়ার্ডের শ্যামবাজার মোড়ে ১২ নং ফরাশগঞ্জের রুপলাল হাউজ ঢাকার ইতিহাসের পুরনো একটি অধ্যায়।

রুপলাল দাস

বাড়িটির ইটের ভাঁজে ভাঁজে আঁটকে আছে ইতিহাসের হাজারো না বলা কথামালা। বুড়িগঙ্গার ওপারে শোভাড্যা গ্রামের মথুরানাথ পোদ্দার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে শুরু করেছিলেন পোদ্দারি ব্যবসা। তিনি তখন বাট্টা দিয়ে টাকা, আধুলি, সিকি ইত্যাদি মুদ্রা ভাঙ্গিয়ে দিতেন। মথুরানাথ তখনকার দিনে বাংলা বাজারে রাস্তার উপর চট পেতে টাকা ভাঙানোর দোকান সাজিয়ে বসতেন। মথুরানাথ খুব অল্প সময়ে বাংলা বাজারে জমি কিনে নিজস্ব দোকান দিয়ে বসেন। পরে তিনি মুদ্রা ভাঙানোর কাজ ছেড়ে দিয়ে লগ্নি ও হুন্ডির কারবারে নামেন। মথুরানাথ তৎকালিন একশ টাকায় কিস্তি আকারে বছরে ৫৭০ টাকা আদায় করতেন। ব্যবসার ধারাবাহিক উন্নতির ফলে ক্রমেই মথুরানাথ ঢাকার শ্রেষ্ঠতম ধনাঢ্য হিন্দু ব্যবসায়ীতে রূপান্তরিত হন।

পুরানো ছবিতে জৌলুসময় রুপলাল হাউজ

 
১৮৬০ এর দশকে মথুরানাথের দুই পুত্র স্বরূপ চন্দ্র দাস এবং মধুসূদন দাস জমিদারিও কিনতে শুরু করেন। দাসদের তারপরের ইতিহাস চিরো শুধুই এগিয়ে চলার বদলে যাবার। স্বরূপচন্দ্রের পুত্র রূপলাল দাস ফরাশগঞ্জে ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে নির্মিত একটি বাড়ি আরাতুন নামের এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ক্রয় করে সেটি মার্টিন এন্ড কোম্পানির একজন ইংরেজ স্থপতিকে দিয়ে পুনঃনির্মাণ করেন এবং এর নাম দেন রূপলাল হাউজ। রূপলাল হাউজ সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থাপত্যরীতির দুটি অসমান বস্তুকে বিভক্ত করা ৫০ কক্ষ বিশিষ্ট একটি দ্বিতল প্রাসাদের রুপ ধারন করে। ঘরগুলোর মেঝে ছিল কাঠের। ১০ বছর বয়সী বাড়িটি রূপলালের হাতে নতুন রুপ ধারণ করে। উত্তর ও দক্ষিণপাশে প্রশস্ত বারান্দা দুটি সেমি কোরিনথীয় স্তম্ভ বা সমায়ত ইটের থামের উপর বিভাজিত, ত্রিপদ খিলান হয়ে যায়।

রাতের রুপলাল হাউজ

তৎকালীন ঢাকার নবাব বাড়ি তথা আহসান মঞ্জিলের সাথে তুলনা করার মতো এই একটি মাত্র বাড়ি ছিল রূপলাল হাউজ। গ্রীক স্থাপত্য শৈলীতে এসেছিল এক অমর নতুনত্ব। রূপলাল হাউজের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাড়ির উপরে মাঝখানে স্থাপিত একটা প্রকান্ড ঘড়ি, যা ঢাকা শহরের সম্মুখভাগের সব নদী বা খাল থেকে দেখা যেত। নৌ-পথে চলাচলকারী মাঝি বা নৌকারোহীগণ এ ঘড়ি দেখে সময় নির্ধারণ করতেন। ১৮৯৭ সালের দিকে হঠাৎ ভূমিকম্পে ঘড়িটি ভেঙে গেলে পরবর্তী সময়ে তা আর মেরামত করা হয়নি। বুড়িগঙ্গা নদীতে শুধু বিলাস জাহাজ নয়, বাণিজ্যিক জাহাজও ঢুকত সে সময়ে। জাহাজিরা মুগ্ধ হয়ে যেত চারটি আলাদা ঘাটসহ বাড়িটার চেহারা দেখে। আর্মেনিয়ান, ব্রিটিশ আর ঢাকার ক্লাসিক চেহারা মিলিয়ে সে বাড়ি আসলেই ছিল দেখার মত। ঢাকায় আসা ইউরোপিয়ানরা মুগ্ধ হত এই বাড়ি দেখে।

সেই আমলের কাঁচ দিয়ে তৈরি দরজার উপরের কারুকার্য

এই সময়ের ঢাকার বিখ্যাত ব্যবসায়ী হোয়ে উঠেন রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। ঢাকার বণিক সমাজে বেশ নামডাক হয়েছিল দুভাইয়েরই। রূপলাল ব্যবসায়ী হিসাবে ধনাঢ্য হোয়ে উঠার পেছনে ছিলো তার মেধা, পরিশ্রম, রুচিবোধ ও মণনশীলতা যা তার সময়ে ঢাকার নবাবদেরও ছিলো না। বাড়ি কিনেই খুশী হননি তিনি- নিজের পছন্দ, চাহিদা ও রুচির সমন্বয়ে পুনঃনির্মাণ করেই নাম দিয়েছিলেন রুপলাল হাউজ।

রূপলাল হাউজের পার্শ্ব দৃশ্য

রূপলাল হাউজ সত্যিকার অর্থেই রুপ লাবন্যে নবযৌবণা দুহাত বাড়িয়ে আহবান করতো। সারা রাত সুরে লহরি, গান বাজনা, খানা পিনা, আরাম আয়েস অবাক না হওয়া প্রজন্মকে আরও বেশি করে অবাক করতো। রূপলাল নিজেও অবাক করেন আমাদের। ছাত্র হিসাবে রুপলাল এতটাই মেধাবী ছিলেন যে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্হান অধিকার করে পেয়েছিলেন মাসিক ১০ টাকার বৃত্তি। তার পিতামহ ব্যবসাজীবন শুরু করেছিলেন রাস্তায় চটের বস্তা বিছিয়ে, রুপলাল সেখান থেকে মেধার জোরেই উঠে যান ঢাকা শহরের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কাতারে। মানুষ হিসাবে ছিলেন এতটাই রুচিশীল সৌখিন যে এই বাড়ি পুনঃনির্মাণ এর কাজ তিনি দেন কলকাতার বিখ্যাত ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি মার্টিন এন্ড কোং এর হাতে। বিশাল নির্মানযজ্ঞে ব্যবহার করা হয় স্থানীয় ভাবে পোড়ানো ইট আর প্রচুর লোহা।

রূপলাল হাউজের জানালা

নির্মাণ কাজ চলেছিল দীর্ঘসময়। বিলাসী রূপলাল সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শুধু উপমহাদেশের ব্রিটিশ ভাবধারাই নয় বরং ইউরোপিয়ান স্থাপত্য হালচাল এর সর্বশেষ সব স্টাইল এর সাথে একটু একটু করে জুড়ে দিয়েছেন তার শখের পরশ। ব্যবসায়ী হলেও তার মনের মাধুরী মিশিয়ে রোমান্টিকতার ছোঁয়ায় গড়ে তুলেছিলেন নিজের স্বপ্নের সৌধ। রাতের আলো ঝলমল নাচঘরে নূপুরের ঝংকারে ভিন্ন ভিন্ন তাল, লয়, সুর আর ছন্দে বুড়িগঙ্গার স্হির জলে মিলে মিশে স্বপ্নপূরিতে পরিনত হতো রুপলাল হাউজ। ঢালাই লোহার নকশা আঁকা রেলিং, সিঁড়ি ও জানালার ফ্রেম আর দূর্ভেদ্য প্রাচীরে ঘেরা ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুরো বাড়িজুড়ে দক্ষিণ আর উত্তর পার্শ্বে বাতাস টেনে আনতে ছিল প্রশস্ত বারান্দা। দূর থেকে ফ্রেঞ্চ ক্লাসিকার স্টাইল এর রঙিন কাচে মোড়ানো জানালার ফ্রেম এর কারুকাজ ফেভিকলের মতো আঁটকে থাকতো উৎসুক নয়নে, ভাবের সঞ্চার করতো ভাবুক হৃদয়ে। রূপলালের জলসাঘরটি ছিল বুড়িগঙ্গার দিকে মুখ করা। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা সংগীত ও নৃত্যশিল্পীরা আমন্ত্রিত হোয়ে আসতেন এই জলসাঘরে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ ওয়ালিউল্লাহ খান, লক্ষীদেবী আর লক্ষ্মনৌ থেকে আসা রপবতি, যুবতী মক্ষ্মিরানীদের সুরে-তালে, মুজরার ঝংকারে ভরে থাকত এই জলসাঘর। কাজী নজরুল ইসলাম রূপলাল হাউজে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন, তার অসাধারণ পরিবেশনায় মাতিয়ে রেখেছিলেন রূপলাল হাউজ।

ঢাকার রূপলাল হাউজের ভিতরে

ইংল্যান্ডের রাণী ভিক্টোরিয়ার ঢাকা সফরকালে অতিথি হিসাবে থাকার কথা ছিল এই রুপলাল হাউজে। এটা নিয়ে তখন ঢাকার নবাব পরিবারের সাথে প্রতিযোগিতাও হয়। উচ্চ পর্যায়ের ব্রিটিশ প্রতিনিধি দল সরেজমিনে দুটো বাড়িই আগাম পরিদর্শন করেন। রূপলাল এর বিলাসবহুল বৈচিত্রময়তা এবং আর এক জীবন দেখে ব্রিটিশ সাহেবেরা থ মেরে গিয়েছিলেন পুরোপুরি। তাই ভোটাভুটি হয়েছিল। বিপুল ভোটে জিতে যায় রূপলাল হাউজ। তবে রানী শেষপর্যন্ত আর উপমহাদেশেই আসেননি সে সময়ে। তাই কোলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মত রূপলাল হাউজে মহারানী ভিক্টোরিয়ার পা পড়েনি। রূপলাল হাউজ এর অপ্রাপ্তির তালিকায় “শেষ পর্যন্ত রানী আসেননি”এটাই আজ ইতিহাস হোয়ে আছে। ১৮৮৮ সালে লর্ড ডফরিন আসেন ঢাকায়। তিনি ছিলেন সে সময় ভারতের ভাইসরয়। রূপলাল হাউজে এসময় তাঁর সম্মানে একটি বল নাচের আয়োজন করা হয়। ডফরিন সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলেন রূপলাল আতিথেয়তা এবং আয়োজনে।

রূপলাল হাউজের জরাজীর্ণ অবস্থা, ২০০৮

রূপলাল হাউজের দুঃখের গল্পটার শুরু বলা যায় ১৮৯৭ সালে ঢাকায় একটা ভূমিকম্পের পর থেকে। রূপলাল প্রচুর খরচ করে বাড়ির মেরামতির কাজ করেন। কিন্তু ইতিহাস তার নিজের নিয়মেই চলে, নদীর মতো পথ বদলায়। দাস পরিবার এর সাথে নবাবদের একটা প্রতিপত্তির প্রতিযোগিতা ছিল সব সময়ই। মুঘোল বা ব্রিটিশদের ঢাকায় ধর্মীয় সহিংসতার ইতিহাস প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন এর শেষভাগে ধর্ম হয়ে উঠেছিল নতুন ঢাকাই সমাজের নিয়ামক। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ঢাকাকে বদলে দেয় খুবই দ্রুতই। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও ধর্মের ভীত্তিতে দেশভাগের ধারণাটি ছিলো রূপলাল এর মত সম্ভ্রান্ত শান্তিপ্রিয় হিন্দু পরিবারের আধিপত্যের জন্য আতংকের কারণ। মুসলমান এলিটিদের মনোভাব রূপলালকে পরিবার পরিজন সহ ঢাকা থেকে চলে যাবার ব্যাপারে চিন্তা করাতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় দাস পরিবার এই বাড়ীটি বিক্রি করে চলে গেলেন সীমানা পেরিয়ে। দেশভাগের আর দশটি বিয়োগান্তক সম্পর্কের মত শেষ হয়ে গেল দাস পরিবারের সাথে অভিজাত ঢাকার স্মৃতি। বাড়ির মালিকানা নিয়ে দলাদলির শুরু তখন থেকেই।

রুপলাল হাউজের এখনকার অবস্থা

১৯৫৮ সালে এটির নাম হলো “জামাল হাউজ”। ১৯৭৪খ্রিঃ বাংলাদেশ হোলে বাড়িটি কিছুদিনের জন্য ছিলো রক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প। সেই রুপলালের শরিরে এখন বাসা বেঁধেছে বটবৃক্ষ। তাতে পাখিরা কিচিরমিচির করে। আশেপাশের ভবন মালিকেরা এর গা ঘেসটে তুলেছেন বহুতল সুরম্য ভবন। আর রুপলালের জলসাঘরে বসেছে মসলার দোকান আর সবজির আড়ত। আজ ভাবতেও অবাক লাগে প্রায় ২০০ বছর আগে বিদেশীরা ঢাকায় এলে ফাইভ স্টার হোটেলের বিকল্প এই রূপলাল হাউজে একরাত থাকার ভাড়া দিতেন ২০০ টাকা, ভাবুনতো আজ তার সমমূল্য কত টাকা হোতে পারে? পূণশ্চঃ শুনেছি প্রত্বতত্ত্ব অধিদপ্তর রূপলাল হাউজকে উদ্ধার করেছে অল্প কিছুদিন আগে। এটিকে সংস্কার করে রুপলালের রুপ কিছুটা হোলেও ফিরিয়ে এনে নতুন প্রজন্মের নতুন দর্শনার্থীদের উপযোগী করে তোলা হবে বলে শুনেছি। আসুন সে অপেক্ষায় থাকি, না হয় আরো কিছুটা সময়।
 
 তথ্যসূত্রঃ
১।রূপলাল হাউজ : ইতিহাসের ধূসর পাণ্ডুলিপি
২।. মুনতাসীর মামুন (১৯৯৩)। ঢাকাঃ স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী ।
৩। আদিনাথ সেন (১৯৪৮)। স্বর্গীয় দীননাথ সেনের জীবনী ও তৎকালীন পূর্ববঙ্গ। কলকাতা।
৪। হারিয়ে যেতে চলেছে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রূপলাল হাউজ।