মিশরীয়, ভারতীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার সমসাময়িক আরও একটি নগর সভ্যতা ছিলো পূর্ব এশিয়ায়। সভ্যতা মানেই তো বহু ধাপ পেরিয়ে একটু একটু করে শীর্ষে পৌঁছানো। চীনা শ্যাং সাম্রাজ্যও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। শ্যাং-রা নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা বিকশিত করার চেষ্টা করেছিলো এবং সেই চেষ্টারই ফলস্বরূপ গড়ে উঠেছিলো আরও অনেকগুলো নগর সভ্যতা। প্রাচীনতম এই সংস্কৃতি তৈরীই ছিলো তাদের মৌলিকত্ব।
প্রায় তিন হাজার সাতশো পঞ্চাশ বছর আগে শ্যাং জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। যুদ্ধের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তারা উদ্বিগ্ন ছিলো। তারা নিষ্ঠুর, কিন্তু বুদ্ধিমান ছিলো। আশেপাশের সমস্ত অঞ্চল ও রাজ্য জয় করে আস্তে আস্তে তারা প্রতিষ্ঠা করেছে একটি স্থায়ী সাম্রাজ্য। এটিই প্রথম চীনা সভ্যতা, যা থেকে প্রচুর তথ্য মিলেছে। চমৎকার সব পাত্র মিলেছে সম্রাটদের সমাধিতে।
বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার সাথে সাংস্কৃতির বিনিময়ের ক্ষেত্রে তাদের যোগাযোগের খুব একটা সুযোগ ছিলো না। তাই যা কিছু তাদের সংস্কৃতিতে বিকশিত হয়েছিলো, তা তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা থেকেই সৃষ্টি। হোয়াংহো নদীর পাশেই এই সভ্যতা গড়ে ওঠায় নদীর সম্পূর্ণ সুবিধা নিয়েই ছিলো তাদের জীবনযাপন।
বেশ লম্বা সময় ধরেই শাসন করেছিলো শ্যাং রাজবংশ। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৬৬ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০২৭ সাল পর্যন্ত ছিলো তাদের রাজত্ব। অ্যানিয়াং ছিলো শ্যাং সাম্রাজ্যের মূল রাজধানী। তবে হোয়াংহো নদীর ভাঙনের ফলে সৃষ্ট বন্যার কারণে বার বার তাদের রাজধানী স্থানান্তরিত করতে হয়েছিলো।
শ্যাং সাম্রাজ্য বিকশিত হয়েছিলো ব্রোঞ্জ যুগে এবং ব্রোঞ্জকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছিলো তাদের সংস্কৃতি। ব্রোঞ্জের তৈরী প্রত্নবস্তুগুলোর কারিগরী উৎকর্ষতা এক উন্নত সংস্কৃতির প্রমাণ বহন করে।
কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ছিলো শ্যাং সাম্রাজ্যে। তবে কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো উন্নত পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারে নি তারা। প্রধান খাদ্য হিসেবে যব ও গম চাষ প্রাধান্য পেলেও পাশাপাশি ধানও চাষ করা হতো। এ ছাড়াও জীবিকা হিসেবে শিকারকেও বেছে নিয়েছিলো শ্যাং-রা। পাশাপাশি পশুপালনের মাধ্যমেও শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলে তারা। কুকুর, শুয়োর, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, মোরগ প্রভৃতি ছিলো তাদের গৃহে পালিত পশু। শুয়োর ও কুকুরের মাংসই ছিলো তাদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার।
শ্যাং-দের গ্রামের ঘরগুলো মাটির তৈরী হলেও শহরের বাড়িগুলো অত্যন্ত উন্নত মানের ছিলো, যার কারিগরী দক্ষতা চোখে পড়বার মতো। খনন থেকে পাওয়া প্রত্নবস্তুগুলোও তখনকার কারিগরদের অসামান্য দক্ষতারই প্রমাণ বহন করে। খনি থেকে উত্তোলিত ধাতুকে চোখ ধাঁধানো অসাধারণ সব বস্তুতে পরিণত করা হতো। শ্যাং সমাধিগুলোতে পাওয়া পাত্র, ছুরি, কুঠার তারই প্রমাণ বহন করে। ঝিনুক ও শিং দিয়ে তৈরী হতো চমৎকার সব গহনা। এছাড়াও হাতির দাঁত ও সবুজ পাথর জেইডের তৈরী গহনাগুলো ছিলো দেখার মতো। সে সময় কড়ির মূল্য ছিলো অপরিসীম। মুক্তার বিকল্প হিসেবে কড়ি ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়। তবে মূলত ব্রোঞ্জ দিয়েই তাদের শিল্প সত্তার বিকাশ ঘটেছিলো।
চীনামাটির পাত্র কিন্তু চীনেই উৎকর্ষতা পেয়েছিলো। শ্যাং যুগে কুমোরদের হাতে তৈরী এসব চীনামাটির পাত্রগুলোই তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। কারুকাজ করা পাত্র, কাপ ও মুখোশগুলো ছিলো নয়নাভিরাম। চাকার ব্যবহার শুরু করার কারণে শ্যাং সভ্যতার বিকাশ দ্রুততার সাথে এগিয়ে যায়। চাকা তৈরিতে তারা কাঠ ব্যবহার করতো। চাকা ও ঘোড়া দিয়ে তৈরী রথ ছিলো সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের চলাচলের মাধ্যম। রথ গুলোতে ধাতু ব্যবহারের মাধ্যমে নকশা করার রেওয়াজও ছিলো তাদের। ঘোড়া ছিলো তাদের পরম প্রাপ্তি। আর তার সজ্জার জন্যও তৈরী করা হতো বিভিন্ন ধরনের অলংকার।
শ্যাং সমাধিগুলো পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, তাদের মধ্যে বলি-প্রথা বিদ্যমান ছিলো। কোনো মৃতের কবরে বলিকৃত মানুষটিকেও তার সাথে সমাহিত করা হতো। কোনো সম্মানিত ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার ক্রীতদাসদেরকে হত্যা করে তাদেরকেও সেই ব্যক্তির সাথে দাফন করা হতো, যেনো পরবর্তী জীবনে তারা তাদের মালিককে অনুসরণ করতে পারে। এমন কিছু সমাধিও আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে প্রায় দুই হাজার ক্রীতদাসকে কবর দেয়া হয়েছিলো। ধনী ও অভিজাত ব্যক্তিদের মৃত্যুর পর তাদের সাথে তাদের ব্যবহৃত ঘোড়া ও গাড়িগুলোকেও সমাহিত করবার রীতি ছিলো।
এ ছাড়াও পূর্বপুরুষের পূজার প্রচলন ছিলো শ্যাং-দের মাঝে। তারা বিশ্বাস করতো, মৃত্যুর পরের জীবন আরও মহিমান্বিত, মৃতদের অসীম শক্তি এবং জীবিত মানুষের কল্যাণ তখনই হবে, যখন মৃত পূর্বপুরুষেরা তাদের উপর প্রচুর আশীর্বাদ বর্ষণ করবে। নিজেদের ফেলে যাওয়া সাম্রাজ্য ও সন্তানের ভালোর জন্য মৃতরা মৃত্যুর পরও কাজ করে যেতে সক্ষম –এমন ধারণাই ছিলো শ্যাং-দের মনে। এ ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্মচিন্তার সাথে শ্যাং-দের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তারাও মানতো যে, মৃত্যুর পরেও জীবন আছে এবং পূর্বপুরুষদের আত্মা অবিনশ্বর। তাই পূর্বপুরুষের কৃপা বা সাহায্য পাওয়ার জন্য তারা সব সময় তাদের পূজা করতো।
পূর্বপুরুষের প্রতি শ্যাং-দের অগাধ শ্রদ্ধা ছিলো। বিভিন্ন সমাধিতে ব্রোঞ্জের তৈরী অসংখ্য পাত্রে পাওয়া গিয়েছে তাদের পূর্বপুরুষের নাম। মৃত পূর্বপুরুষের জন্য বিশেষ খাবারও তৈরী করতো শ্যাং-রা। পাশাপাশি মদও নিবেদন করা হতো তাদের প্রতি। শুধু তা-ই নয়; নতুন ফসল লাগানো, যুদ্ধের প্রস্তুতি -সমস্ত বিষয়ে পরামর্শ নেয়া হতো পূর্বপুরুষদের। ভাবছেন, এ আবার কি করে সম্ভব? আসলে বিশেষ এক প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে তারা এই পরামর্শ পেতো বলে বিশ্বাস ছিলো।
শাং যুগে রাজাই ছিলো সর্বোচ্চ পুরোহিত। তারা বিশ্বাস করতো যে, রাজার সাথে দেবতাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অসংখ্য ওরাকল হাড় খুঁজে পেয়েছেন, যাতে মূলত বিশেষ কিছু প্রাণী, বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাছিমের হাড় ব্যবহার হতো। ওরাকল হাড়ের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকভাবে নির্দেশনা প্রাপ্তির এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষ পুরোহিতদের কাছে আসতো বিভিন্ন জিনিস জানার উদ্দেশ্যে; যেমন, বৃষ্টি কখন হবে, কোনো অঞ্চল আক্রমণ ও দখলের উপযুক্ত সময় কোনটি, ফসল রোপণ ও ফসল কাটার জন্য কোন সময়টি সর্বোত্তম হবে ইত্যাদি। বিশেষ হাড়টির উপর প্রশ্ন লিখা হতো এবং পুরোহিতরা ঐ প্রশ্ন পড়ার পর হাড়টিকে ভীষণ লাল-গরম ধাতু দিয়ে আঘাত করতো। এতে বেশ কিছু সূক্ষ্ম শব্দ হয়ে হাড়ে ফাটলের সৃষ্টি হতো। আর সেই ফাটল পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে শ্যাং-রা তাদের পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া উত্তরগুলো খুঁজে নিতো। রাজধানী অ্যানিয়াং-এ শাসকদের তালিকা সম্মিলিত ওরাকল হাড় পাওয়া গিয়েছে।
ছোট ছোট চোখ, ফ্যাকাশে গাত্রবর্ণের শ্যাং-রা ছিলো ভীষণ সচেতন এক জাতি। তাদের সামরিক দক্ষতা ছিলো অসাধারণ। সেই সাথে গণিতবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যায় তাদের পারদর্শিতা ছিলো অবাক করবার মতো। প্রথম লিখিত ভাষাও শুরু হয়েছিলো তাদের মাধ্যমেই। ধারণা করা হয়, ওরাকল হাড়ের মাধ্যমে পূর্বপুরুষ বা দেবতাদের সাথে যোগাযোগের উদ্দেশ্যেই এই লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলো শ্যাং-রা। তবে শুধুমাত্র ধর্মীয় উদ্দেশ্যেই পুরোহিতরা লিখতেন শ্যাং সমাজে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজেই অভ্যস্ত ছিলো শ্যাং-রা। সাধারণত পরিবারের ছেলেরাই উত্তরাধিকার সূত্রে রাজা হতো। তবে এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেতো রাজার ভাই। ভাই না থাকলে শুধুমাত্র তখনই রাজার ছেলেকে রাজা বানানো হতো। শ্যাং-দের রাজনৈতিক চিন্তাধারাও ছিলো বেশ উন্নত। তারা কখনোই নিজেদের ব্যক্তিগত আনন্দকে প্রাধান্য দিতো না। প্রজাদের উপর খুব সামান্য কর ধার্য করতো শ্যাং শাসকরা। সব সময় প্রজাদের সার্বিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা থাকতো তাদের মাঝে।
বিত্ত-বৈভবের প্রাচুর্য অনেকাংশেই শ্যাং জাতির পতন ডেকে আনে। খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ সালে পশ্চিমের যোদ্ধা জাতি চৌ রাজবংশের শক্তিশালী আগ্রাসন ও ক্রমাগত যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে দুর্বল শ্যাং বংশের রাজারা পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যায়।