প্রতিদ্বন্দ্বী নগর রাষ্ট্র এথেন্সের কাছে প্রথম পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধে বাজেভাবে পরাজয়ের পর স্পার্টার হর্তাকর্তারা নিজেদের নগর রাষ্ট্রে আরো সামরিকীকরণ জোরদার করেন। সমৃদ্ধ আর প্রগতিশীল নগর রাষ্ট্র এথেন্সের কাছে এমন পরাজয় স্পার্টার নাগরিকদের যেন ভাগ্যবিড়ম্বনায় ফেলে দেয়। কঠোর সামরিক আইন কানুন আর আগ্রাসী নীতিতে স্পার্টা খুব শীঘ্রই হয়ে উঠে পুরোদস্তুর সামরিক রাষ্ট্র। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে প্রাচীন গ্রিসে নগর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ইতিহাস বিদিত। আর প্রাচীন গ্রিসের কথা আসলেই অবধারিতভাবে চলে আসে দুই নগর রাষ্ট্রের নাম-স্পার্টা ও এথেন্স। এথেন্স শহরটিকে নিয়ে ইতিহাস উচ্ছ্বাস দেখালেও স্পার্টাকে ইতিহাস মনে রেখেছে অতি সামরিক একটি আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে৷ অতিকায় সামরিক হয়েও স্পার্টার পতন হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। ইতিহাসের গল্প বলে বেড়ানো স্পার্টা থেকে  ঘুরে আসা যাক। 

আধুনিক গ্রিসের দক্ষিণাঞ্চলের লেকোনিয়া শহরে ছিল প্রাচীন স্পার্টা শহরের  অবস্থান। গ্রিক মিথোলজি অনুসারে, প্রাচীন এই শহরটির প্রতিষ্ঠাতা জিউসের পুত্র লেসেডেমন। গ্রিক পুরাণের ঐতিহাসিক যুদ্ধ ট্রোজান যুদ্ধের গ্রিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র ছিল স্পার্টা। এমনকি স্পার্টার রাজা মেনেলাসই ট্রোজান যুদ্ধ শুরু করেছিলেন যখন ট্রোজান রাজকুমার প্যারিস স্পার্টার রাণী হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এই স্পার্টার প্রতিদ্বন্দ্বী নগর রাষ্ট্র ছিল পার্শ্ববর্তী এথেন্স। যার সাথে একাধিকবার যুদ্ধে জড়িয়েছিল এই সামরিক রাষ্ট্রটি।
স্পার্টা নগর রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল ধনিকতন্ত্র। উত্তরাধিকার সূত্রে এজিয়াড ও ইউরিপন্টিড নামের দুই পরিবার স্পার্টা শাসন করত। যারা নিজেদের হিরাকলসের উত্তরপুরুষ হিসেবে দাবি করত। দুই পরিবারই শাসনকাজে সমান কর্তৃত্ব প্রয়োগ করত। যার কারণে একে অন্যের সাথে শাসনকাজে তেমন বিরোধ দেখা দিত না। রাজারা ধর্মীয়, বিচারিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সর্বেসর্বা ছিল।

প্রথম পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধে এথেন্সের কাছে পরাজয়ের পর স্পার্টার শাসক প্রত্যেক সক্ষম পুরুষকে সৈনিক হিসেবে বাধ্যতামূলক রাষ্ট্রে সেবা দেয়ার নিয়ম চালু করেন।  ৭ বছর বয়স হলেই স্পার্টার ছেলেদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হত। স্পার্টান পুরুষদের ছিল একটিই পেশা, সেটি হল তাদের অবশ্যই সৈনিক হতে হবে। তাদেরকে কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। টিকে থাকার জন্য স্পার্টান সৈনিকদের খাবার চুরি করার শিক্ষাও দেওয়া হতো। এগোজ নামের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা, মিলিটারি প্রশিক্ষণে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক স্পার্টান পুরুষদের যেতে হত। এই এগোজ সিস্টেমে সৈনিকদের রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব, নিয়মানুবর্তিতা এবং সহনশীলতার শিক্ষা দেয়া হত। সব সৈনিকদের বিশ্বাস করানো হত সবার আগে রাষ্ট্র, এমনকি নিজের পরিবারের আগেও রাষ্ট্রের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে, এমনই কঠোর ছিল স্পার্টার উগ্র সামরিকবাদ। পার্শ্ববর্তী এথেন্সে যখন গণতন্ত্র ও সহনশীলতা নিয়ে একটি আধুনিক নগর রাষ্ট্রের পত্তন করছিল স্পার্টা তখন তাদের যুবকদের যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষ করে তুলছিল। যে স্পার্টান যুবক কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতো তাকে ক্রিপ্টেইয়া নামক গোপন পুলিশ বাহিনীর সদস্য করে নেয়া হতো । এই বাহিনীর দায়িত্ব ছিল হেলটদের(দাস শ্রেণী) নানা কায়দায় নির্যাতন করা এবং কেউ বিদ্রোহী হলে তাকে শায়েস্তার ব্যবস্থা করা। স্পার্টার পুরুষদের বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত ব্যারাকে কাটাতে হলেও নারীদের তুলনামূলক স্বাধীনতা ছিল। তারা সরকারিভাবে শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি সকল প্রকার গৃহস্থালি কাজকর্ম থেকে মুক্ত ছিল। স্পার্টায় থাকা পরাধীন শ্রেণী হেলট’রা মূলত দাস হিসেবে স্পার্টায় অবস্থান করত। তাই গৃহস্থালি কাজকর্ম থেকে শুরু করে সকল প্রকার কায়িক শ্রমই হেলটরা সম্পাদন করত। 

স্পার্টা একটি সামরিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে উদারতার বালাই ছিল না এই নগর রাষ্ট্রে। ফলে সমাজব্যবস্থায়ও বৈষম্যের ছাপ পাওয়া যায়। স্পার্টার সমাজব্যবস্থা তিনটা শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। প্রথম শ্রেণী ছিল স্পার্টান যোদ্ধা। ৭ বছর বয়সে প্রশিক্ষণ শুরু করে ২০ বছর বয়সে তারা একজন পরিপূর্ণ স্পার্টান যোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করত। ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত রাষ্ট্রকে তারা সেবা দিয়ে যেত। অন্য শ্রেণী ছিল দাস, এদেরকে বলা হত হেলট৷ গ্রিসের লেসোনিয়া ও মেসোনিয়া থেকে ধরে এনে জোরপূর্বকভাবে স্পার্টানরা এদের দাস বানিয়ে পরাধীন করে রাখত। স্পার্টান সমাজে হেলটদের অবদান ছিল খুব বেশি কিন্তু বিপরীতে তাদের মূল্যায়ন করা হত স্রেফ দাস হিসেবেই। স্পার্টার সকল প্রকার কাজ হেলটরাই করে দিত। তারপরেও এই হেলটদের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হত। কখনো কখনো স্পার্টান যোদ্ধারা তাদের মদ খেতে বাধ্য করত এবং তারা মাতাল হয়ে গেলে ভরা সমাজে হাসাহাসি করত। স্পার্টানরা নিজেদের ইচ্ছামাফিক হেলটদের হত্যাও করতে পারত।  তৃতীয় শ্রেণী ছিল পেরুচি। এরা পূর্ণ নাগরিকের সম্মান না পেলেও স্পার্টায় এদের অবস্থান খুব বেশি খারাপ ছিল না। এরা স্পার্টানদের জন্য অস্ত্র তৈরি ও ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছিল।

স্পার্টার নারীরা অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করত। তাদের গৃহস্থালি কাজ করতে হতো না। যেহেতু এই কাজ দেখভালের জন্য হেলটরা ছিল।  রাষ্ট্রীয় শিক্ষা নেয়ার পাশাপাশি তাদেরকে এথলেটিক প্রতিযোগিতায় নেয়া হত। এখান থেকেই স্পার্টান যোদ্ধারা নিজেদের সঙ্গীনী বাছাই করে নিত। নারীরা নাচ গানের মাধ্যমে স্পার্টান পুরুষদের আকৃষ্ট করতে চাইত। স্পার্টায় বিবাহ প্রথা খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হত৷ কেননা রাষ্ট্রের প্রয়োজন লোকবল আর সক্ষম পুরুষ। তাই রাষ্ট্র নিজে উদ্যোগী হয়ে যে পুরুষ বেশি ছেলে জন্ম দিত তাকে পুরস্কৃত করত। আবার যে বিয়ে করত দেরি করত তাকে সবার সামনে অপদস্থ করত। বিয়ের আগে স্পার্টার নারীরা তাদের মাথা ন্যাড়া করে দিত এবং বিয়ের পর চুল ছোট করে রাখত। অনূর্ধ্ব ৩০ বয়সী স্পার্টান যোদ্ধাদের স্ত্রীর সাথে থাকার নিয়ম ছিল না। রাতে ব্যারাক থেকে পালিয়ে গিয়েই তবে স্ত্রীদের সাথে তারা দেখা করত। 

পার্শ্ববর্তী এথেন্স যখন তার নাগরিকদের উদার আচরণ দেখাচ্ছে বিপরীতে স্পার্টার নাগরিকরা পোহাচ্ছে রাজ্যের খড়গ। অতিকায় সামরিক আচরণ স্পার্টাকে নিরাপদ রাখতে পারেনি। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১ অব্দে লুক্ট্রার যুদ্ধে গ্রিসের আরেক নগর রাষ্ট্র থিবসের কাছে স্পার্টার ভূমিধস পরাজয় ঘটে। স্পার্টায় সামরিক অভিযান চালানো থিবসিয়ান জেনারেল এপামিনোনডাস হেলটদের স্বাধীনতা প্রদান করেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী দাস হিসেবে কাটানো হেলটরা মুক্তি পায়। এই যুদ্ধের পরও স্পার্টা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ১৮৩৪ সালে গ্রিসের রাজা অত্তো স্পার্টায় আধুনিক যুগের শাসনপ্রণালী চালু করেন। আর এতেই প্রাচীন গ্রিসের সেই সামরিক রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে। স্পার্টা এবং স্পার্টান যোদ্ধারা শত সহস্র বছর ধরে পশ্চিমা বিশ্বের আলোচনা ও অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি এই যুগে এসেও হলিউডে স্পার্টা ও স্পার্টান যোদ্ধাদের নিয়ে সিনেমা তৈরি হচ্ছে এবং সেই সিনেমাগুলোতে স্পার্টা ও স্পার্টানদের প্রতাপকেই তুলে ধরা হচ্ছে।

তথ্যসূত্র
https://courses.lumenlearning.com/boundless-worldhistory/chapter/sparta/

https://www.worldhistory.org/sparta/

https://www.google.com/amp/s/www.history.com/.amp/topics/ancient-history/sparta

https://www.britannica.com/place/Sparta