কিন রাজা এবং চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াংদির আগে একতাবদ্ধ চীনের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। কিন শি হুয়াংদিই সর্বপ্রথম শান্তিপূর্ণ চীন গঠন করেন এবং চীনের বিখ্যাত প্রতিরক্ষা প্রাচীর ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়না’ নির্মাণ করেন। তবে কিন শি হুয়াংদির বিভিন্নমুখী অবদান থাকলেও তার খামখেয়ালিপনা, স্বার্থপর ও অত্যাচারী মনোভাব ধীরে ধীরে সাধারণ জনগণের মনে ক্ষোভের জন্ম দিতে শুরু করে। তেমন কোনো যোগ্য উত্তরাধিকারীও তিনি প্রস্তুত করতে পারেন নি। তাই তার মৃত্যুর পর অল্প কয়েক বছরের মাঝেই চীনের আরেকটি রাজবংশ ক্ষমতায় আসার সুযোগ পায়, আর সেটি হলো হান রাজবংশ। একতাবদ্ধ চীন গড়ে ওঠার আগেও হানদের রাজত্ব ছিলো নির্দিষ্ট এলাকায়। তবে নতুন গঠিত চীনকে শাসন করবার উদ্দেশ্যে আবারো হানদের ক্ষমতায়ন পৃথিবীর ইতিহাসে একটি স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিলো।

খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীতে হান রাজবংশের সম্প্রসারণ দেখানো মানচিত্র।

হান সাম্রাজ্যের পর্যায় দুটি- প্রাথমিক হান যুগ এবং পরবর্তী হান যুগ। প্রাথমিক হান যুগের প্রথম সম্রাট ছিলেন লিউ ব্যাং। কিন সাম্রাজ্যের শাসনের বিরুদ্ধে দানা বেঁধে ওঠা বিদ্রোহের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। তবে লিউ ব্যাং ছাড়াও বিদ্রোহী দলের আরো একজন নেতা ছিলেন, জিয়াং ইউ। তারা দুজনই চীনের সম্রাট হতে চেয়েছিলেন। তাই কিন শাসনের অবসান ঘটাতে একসাথে কাজ করলেও পরবর্তীতে তারা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হন। খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২০২ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর জিয়াং ইউ এবং লিউ ব্যাং পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। অবশেষে গাইজিয়ার যুদ্ধে লিউ ব্যাং পরাজিত করেন জিয়াং ইউকে। জিয়াং ইউ পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন এবং লিউ ব্যাং এর মাধ্যমেই সূচনা হয় চীনের হান সাম্রাজ্যের প্রাথমিক পর্যায়ের।

দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়না’র একাংশ

লিউ ব্যাং চীনের একজন শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান সম্রাট ছিলেন। চীনের বহু উন্নয়নমূলক কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। পূর্বতন কিন সাম্রাজ্যের প্রণীত সবগুলো অনিয়ম তিনি পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি হান সম্রাট গাওজু নামেও পরিচিত ছিলেন।

লিউ ব্যাং এর মৃত্যুর পর তার ছেলে লিউ ইয়িং সম্রাট হন, যিনি হান সম্রাট হুই নামেও পরিচিত। তবে সাম্রাজ্যের মূল শাসনভার এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিষয়গুলো পরিচালনা করতেন লিউ ব্যাং এর স্ত্রী ডোওয়াগার লু। লিউ ইয়িং এর পর তার এক ছেলে কিয়ানশাও এবং তারপর আরেক ছেলে হাউশাও হান সম্রাট হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সময়েও সাম্রাজ্যের মূল শাসন পরিচালনার কাজ করতেন ডোওয়াগার লু। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০ সালে মৃত্যুবরণ করবার আগ পর্যন্ত এই গুরুদায়িত্ব তিনি নিজেই পালন করে গেছেন।

প্রাথমিক হান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন য়ু। তিনি তার দীর্ঘ ৫৪ বছরের রাজত্বকালে চীনকে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত করেছেন। দক্ষিণে ভিয়েতনামের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত, পূর্বে কোরিয়ার পেনিনসুলা পর্যন্ত এবং পশ্চিমে কাজাখিস্তানের পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত চীনের সীমানা প্রসারিত করেছিলেন য়ু। তার শাসনামলে চীনের শিল্প-সংস্কৃতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিলো।

সম্রাট য়ু এর সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে বিখ্যাত বাণিজ্যিক পথ সিল্ক রোডের ক্রমবিকাশ, যা সুদূর পশ্চিমের রোমান সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত ছিলো। তিনিই প্রথম সিল্ক রোডের মাধ্যমে চীন থেকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন ঝাং কিয়ান নামের একজন ব্যক্তিকে। তখন সিল্ক রোড ছিলো ভীষণ বিপদসংকুল। ঝাং কিয়ান তার বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আক্রমণাত্মক আদিবাসীদের সাথে তো সুসম্পর্ক স্থাপন করেনই, সেই সঙ্গে নিজস্ব লোকদের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সাথেও একটি কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। ফলে চীনের বাণিজ্য সিল্ক রোডের পথ ধরে পশ্চিমা বিশ্ব পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এই ঘটনাই চীনকে অতি দ্রুত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়েছিলো।

লিউ ব্যাং এবং সাদা পাইথনের মূর্তি

সম্রাট য়ু এর মৃত্যুর পরও সমৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত ছিলো। কিন্তু অল্প কিছু সময়ের জন্য হান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রাথমিক হান যুগের শেষ সম্রাট ছিলেন একজন শিশু, যিনি হান সম্রাট রুজি নামে পরিচিত। হান সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে রাজদরবারেরই একজন কর্মকর্তা ওয়্যাং ম্যাং সম্রাট রুজিকে অপসারণ করে নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন এবং জিন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ওয়্যাং ম্যাং এর মৃত্যুর সাথে সাথেই নতুন গঠিত জিন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন তিনি। এরপর হান রাজবংশের একজন বিদ্রোহী নেতা লিউ জুয়ান হন চীনের সম্রাট এবং এর মাধ্যমে আরও একবার হান যুগের সূচনা হয়।

লিউ জুয়ান পরিচিত হন হান সম্রাট জেংশি হিসেবে। নতুন হান যুগের উত্থানে ভূমিকা থাকলেও লিউ জুয়ান তেমন দক্ষ বা বুদ্ধিমান ছিলেন না, যার ফলে সিংহাসনে আরোহণের মাত্র দুই বছরের মাথায় শিমেই বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন তিনি। শিমেইরা লিউ পেনজি নামের একজন কিশোরকে পাপেট সম্রাট বানিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দেয় এবং সাম্রাজ্য চলতে থাকে তাদের ইচ্ছানুসারে।

ইতিমধ্যেই জিনদের পরাজিত করে নিজের দক্ষতার প্রমাণ দেয়া একজন হান রাজবংশীয় লিউ জিউ এই শিমেইদেরকে পরাজিত করেন এবং নিজে হান সম্রাট গুয়াংইউ হিসেবে সিংহাসনে বসেন। মূলত তার সময় থেকেই পরবর্তী হান যুগ প্রকৃতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সম্রাট গুয়াংইউ এর প্রায় এক দশক সময় লেগেছিলো পুনরায় চীনকে একতাবদ্ধ ও সুসংগঠিত করতে। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে সম্রাট ঝ্যাং এবং এরপর তার নাতি সম্রাট মিং সিংহাসনে বসেছিলেন। তাদের সম্মিলিত শাসনকালে চীনে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এবং হান সাম্রাজ্যের জন্য এটিই ছিলো একটি স্বর্ণযুগ।

একটি প্রাচীন চীনা বই থেকে হান সম্রাট উ এর ঐতিহ্যবাহী প্রতিকৃতি।

এই সময়কালেই জেনারেল বান চাও এর প্রচেষ্টায় যাযাবর জিওংনু উপজাতিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ক্যাম্পেইনগুলোর মাধ্যমে তারিম বেসিনে চীনের নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত হয়েছিলো। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, কারণ এই ঘটনাই পরবর্তী হান সাম্রাজ্যকে আবারো সিল্ক রোডের সাথে যুক্ত করেছিলো, যা শুধু বাণিজ্যেই নয়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো।

এই সময়ের পর থেকেই হান সাম্রাজ্য আবারো দুর্বল হতে শুরু করে। তার ওপর শক্তিশালী তিনটি দল- খোঁজাদের দল, হান রাজবংশীয় নারী ও সম্রাজ্ঞীগণ এবং দরবারে পন্ডিত আমলাদের দল ক্ষমতার ওপর নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার জন্য পরস্পরের সাথে অন্তঃর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। আর এই কারণে সাম্রাজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব আরও দৃঢ় হয়। আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন চাষীরা। ঠিক এমন সময়েই ভূমিকম্প, বন্যা, প্লেগসহ নানা রকম দুর্যোগ ও রোগ-শোক ঘিরে ধরে সাধারণ জনগণকে। ফলে চাষীরা ভাবতে শুরু করেন যে, হান সম্রাটদের ওপর আর স্বর্গীয় আশীর্বাদ নেই।

‘হলুদ পাগড়ি বিদ্রোহ’ নামের একটি বড় কৃষক বিদ্রোহ সাম্রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ১৮৪ সালে। হান শাসকেরা সেই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত দমন করতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ততোদিনে সাম্রাজ্যের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো প্রায়। ২২০ সালে শেষ হান সম্রাট জিয়ানকে পদচ্যুত করেন ওয়েই রাজ্যের রাজা চাও পাই।

হান সাম্রাজ্যকে বার বার দুঃখজনক পরিণতি বরণ করে নিতে হয়েছে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে, পৃথিবী ও চীনের ভবিষ্যত সফলতার অনেক বড় কৃতিত্ব হানদের। হান যুগেই সেনাবাহিনী মোতায়েনে সুশৃঙ্খল নিয়ম-কানুনের প্রচলন হয়। লোহার তৈরী হাতিয়ার, বর্ম ও তলোয়ার তৈরীতে অসাধারণ পারদর্শিতা দেখা গেছে হানদের সময়ে। তীর-ধনুক এবং ঘুড়ি ওড়ানোর মাধ্যমে দূরত্বের পরিমাপ ও বার্তা আদান-প্রদানের অভিনব কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন হানরা।

সীসার উপরে হান শিলালিপি

হানদের সময়েই সর্বপ্রথম কনফিউসিয়ানিজম ধারণার ভিত্তিতে একটি আদর্শ সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যেখানে বংশপরিচয়ের মাহাত্ম্য বিবেচনায় না এনেই জনগণের অধিকার সুনিশ্চিত করা হতো। ব্যুরোক্রেসি বা পিরামিড প্রকৃতির সরকার গঠন হানদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিলো, যেখানে পিরামিডের সর্বোচ্চ উচ্চতায় স্বয়ং সম্রাটের অবস্থান ছিলো এবং নিচের দিকে ছিলো পদমর্যাদা অনুযায়ী বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অবস্থান। তবে সবচেয়ে চমৎকার বিষয়টি হলো, বর্তমান কালের মতো সেই সময়েও কর্মকর্তাদের নিয়োগের জন্য সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রচলন ছিলো। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, যোগ্যতাবিহীন কাউকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হতো না।

কৃষিকাজের সুবিধার জন্য চেইন পাম্প এবং লোহার লাঙলের ব্যবহার তারাই প্রথম শুরু করেছিলেন। চীনা বাণিজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সিল্ক দিয়ে বস্ত্র তৈরীর জন্য হানরা পা-চালিত মেশিন আবিষ্কার করেছিলেন। হান যুগেই চীনারা লবণ উত্তোলনের কৌশল আয়ত্ত করেছিলো এবং লবণের মাধ্যমে মাংস ও সবজি সংরক্ষণের উপায় শিখেছিলো।

কাগজ আবিষ্কারের আগে চীনারা সিল্কের ওপর লিখতেন। কিন্তু সিল্ক অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিলো বলে তারা অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়সাপেক্ষ উপাদান হিসেবে কাগজ উদ্ভাবন করলেন; যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের এক অবিচ্ছেদ্য উপকরণ। এমনকি ক্যালিগ্রাফিক আর্টও সর্বপ্রথম হান যুগেই শুরু হয়েছিলো।

কাগজ উৎপাদন

চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসাধারণ কিছু উদ্ভাবন হয়েছে হান যুগে। শুধু উন্নত ঔষধ আবিষ্কারেই নয়, বরং মাথা ব্যথার মতো সমস্যা সারানোর ক্ষেত্রে আকুপাংচার কিংবা সূঁচের ব্যবহারও হানরাই আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। তা ছাড়া মানুষের শরীরের বিষাক্ত উপাদান, যা ব্যথার সৃষ্টি করে তা অপসারণে প্রয়োগকৃত মক্সিবাসশন পদ্ধতিও হানদেরই আবিষ্কার।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে হানদের অবদান অবাক করবার মতো। হান যুগে জ্যোতির্বিদরা এই তত্ত্ব আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছিলেন যে, চাঁদ মূলত সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়। এ ছাড়াও ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য সিসমোগ্রাফ যন্ত্র এবং দিক নির্ণয়ের জন্য ম্যাগনেটিক কম্পাসও হান যুগে তৈরী হয়েছিলো।

বহু বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হান সাম্রাজ্যে এতো অল্প সময়ে যে সমৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে তাদের যোগ্যতার পরিচায়ক। পৃথিবীকে হান সম্রাটরা যেসব বহুমূল্য উপহার দিয়ে গেছেন, তার জন্য আমরা তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।

হান সমাধি থেকে একটি ম্যুরাল

 

রেফারেন্সঃ