একসময় জরথ্রুস্টিয়া ধর্ম ইরানে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ধর্ম ছিল। জরথ্রুস্টিয়া বা পারসিক ধর্মের প্রবর্তক জরথ্রুস্টিয়, তার নাম অনুসারেই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় এই ধর্মের নাম হয়েছে “জরোয়াস্ট্রিয়ানিজ্ম” বা জরথ্রুস্টিয়বাদ। তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম অবেস্তা বা আবেস্তা বা জেন্দাবেস্তা।

সাদা পোশাক এবং একটি দীর্ঘ দাড়ি দিয়ে এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা চিত্র। Image source: Wikipedia

পারসিক ধর্মের অনুসারীরা অগ্নি-উপাসক। আগুনের পবিত্রতাকে ঈশ্বরের পবিত্রতার মতো মনে করেন পারসিক জরথ্রুস্টিয়ানরা। জরাথ্রুস্ট্রবাদে পানি এবং আগুন হল ধর্মীয় পবিত্রতার প্রতিনিধি। আগুনকে একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি অর্জিত হয়, এবং পানিকে সেই জ্ঞানের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আগুনের বিষয়টিকে তারা ব্যাখ্যা করেছে এভাবে, জ্বালানো আগুন সবসময় উপরদিকের দূষিত জিনিষগুলি পুড়িয়ে ফেলে।

ইরানের জোরোস্ট্রিয়ান মন্দিরে আগুন জ্বলছে। Image source: Wikipedia

‘’সাদে” এবং “চহারশনবা-এ-সূরী” হল ইরানের সবচেয়ে বড় উৎসব, আগুনের সাথে সম্পর্কিত এই উৎসব দুটি সেই যুগের রীতিতেই উৎযাপন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে আগুনকে পারসিক ধর্মে শুদ্ধতা, ন্যায় ও সত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এমনকি তাদের অগ্নি-মন্দিরেও। জরথুস্ত্রীয় সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ি আগুন এবং পানিকে জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করা হয়, এবং আগুন ও পানি দুটিকেই অগ্নি-মন্দিরের চারপাশে প্রতীকী হিসাবে তুলে ধরা হয়।

সাদেহ উৎসব; Image Source: Yazd.today

একসময় খনিজ তৈল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের অফুরন্ত ভাণ্ডার ছিলো আজারবাইজানে। আজারবাইজানের আবশেরোন পেনিনসুলা, তিনদিকে কাস্পিয়ান সাগর দিয়ে ঘেরা অপূর্ব সুন্দর একটি জায়গা। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রাচীন মন্দির—অগ্নিদেবতার মন্দির। এই মন্দিরে প্রার্থনা করতে আসতেন একই সাথে জরথ্রুস্টিয়ান বা পার্সি এবং হিন্দু। এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ৭৩০ খ্রিস্টাব্দের রচনায়। এই প্রাচীন অগ্নিমন্দির ঐতিহ্যের পাশাপাশি তুলে ধরে ভারতের সঙ্গে প্রাচীন পারস্যের সুসম্পর্কের ধারা |

বাহরাম অগ্নি মন্দিরের ছবি। Image source: Wikipedia

পার্সি বা জরথ্রুস্টিয়ানরা মনে করেন এই উপাসনার জায়গাটা প্রাচীন অগ্নিমন্দির বা অতেশগ, এখানেই পবিত্র অগ্নিশিখা কয়েকশো বছর ধরে জ্বলেছিলো। আর ওই অগ্নিশিখাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল অগ্নিদেবতার মন্দির | আসলে ঐ আগুনের উত্‍স ছিল মাটির নীচের প্রাকৃতিক গ্যাস। ওই অগ্নিমন্দিরের নিচেই আছে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎস, এবং সেটাই পবিত্র অগ্নিশিখার উত্‍স | ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এখনকার কাঠামোটা পরে তৈরি করা হয়েছে | মুসলিম অভিযানকারীদের হামলায় অগ্নিমন্দিরের আদি রূপ আগেই ধ্বংস হয়েছে। এই অগ্নিমন্দিরের মন্দিরের গায়ে শিব, গণেশ ও হনুমান স্তোত্র খোদাই করা শিলালিপি আছে।

প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য ও জরথুস্ত্রীয়বাদের প্রতীক ফরুহার। Image source: Wikipedia

উনিশ শতকের শেষদিকে বম্বে ও গুজরাত থেকে পার্সিরা গেলেন সেখানে।তারা ওই মন্দিরে একজন জরথ্রুস্টিয়ান পুরোহিত বহাল করেন। ১৯৬৩ সালে সোভিয়েতের অতিরিক্ত খনিজ তৈল উত্তোলনের কারনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার শেষ হবার কারনে ওই অগ্নিশিখা নিভে যায়। আজও ওই স্থাপত্য দাঁড়িয়ে আছে ‘ অতেশগ টেম্পল স্টেট হিস্টোরিক্যাল আর্কিটেকচারাল রিজার্ভ ‘ -এর অংশ হয়ে। অনির্বাণ অগ্নিশিখা আর নেই, কিন্তু আছে শাশ্বত সম্প্রীতি যা মানুষকে ভালবাসতে শেখায়। এখনো একই জায়গায় দুই ধর্মের মানুষকে উপাসনা করতে দেখা যায়।

বাকুর অগ্নি মন্দিরে চিরন্তন শিখা যা বকুর আতেশগাহ নামে পরিচিত। Image source: Wikipedia

সাধারণত পার্সি বা জরথ্রুস্টিয়ানদের টেম্পল অফ ফায়ারে অন্য ধর্মের মানুষের প্রবেশ ও প্রার্থনা নিষিদ্ধ। এমনকী পার্সি মেয়েরা অন্য ধর্মে বিয়ে করলেও তাদের আর অগ্নির উপাসক বা সাগ্নিক বলে ধরা হয় না। ফলে তারাও অগ্নিমন্দিরে প্রবেশ করতে পারে না। আবার অন্য ধর্মের মেয়ে পার্সি পরিবারে বিয়ে করলেও অনেক সময় জরথ্রুস্টিয়ান বলে মানা হয়না।সেদিক দিয়ে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আজারবাইজানের এই মন্দির।

কলকাতার পার্সি জোরাস্ট্রিয়ানরা খুবই সঙ্ঘবদ্ধ। পারস্য থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পর গুজরাটে প্রথম নোঙর ফেলেছিল পার্সি শরণার্থীদের জাহাজ। গুজরাটের ভাষাকেই আপন করে নিয়েছে তারা। প্রভাবশালী ভারতীয়দের তালিকায় বিরাট জায়গা জুড়ে রয়েছেন পার্সিরা। টাটা, গোদরেজ, শাপুরজি-পালোনজি, সিরাম ইনডাস্ট্রিজ— ভারতীয় শিল্প মানচিত্রের রথী-মহারথীদের একের পর এক নাম পার্সি পরিবারের। নামী সুরকার, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, স্বনামধন্য আইনজীবী— ভারতকে অনেক কিছুই দিয়েছে এই সম্প্রদায়। সেই সমৃদ্ধি ধরে রাখার প্রশ্নে ভারতীয় পার্সিরা বেশ যত্নবানও।

পশ্চিম ভারতে একটি আধুনিক জুরোস্ট্রিয়ান অগ্নি মন্দির। Image source: Wikipedia

তথ্যসুত্র
উইকিপিডিয়া
ইন্টারনেট