সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি রহস্যময় কামরূপ কামাখ্যার কথা। কথিত আছে সেখানে ডাকিনী-যোগিনীরা গিজগিজ করছে, যারা যাদু বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী।সেই জাদুর নগরীতে কোন পুরুষ গেলে সে আর ফিরে আসে না, সেখানকার জাদুকরিরা তাকে বন্দী করে বিভিন্ন কাজ করায়, নয়তো গরু–ছাগল বা ভেড়া বানিয়ে রাখে। সেই পুরুষকে সারাজীবন সেই সব যোগিনীদের দাস হয়ে থাকতে হয়। কেউ কেউ বলে কামরূপে নাকি কোনো পুরুষ নেই, সবাই নারী।এইধরনের নানা কল্পকাহিনী রয়েছে চালু আছে কামরূপ কামাখ্যা নিয়ে।

কামাখ্যা মন্দির, গুয়াহাটি , Image source: Wikipedia

আবার এমনও শোনা যায় যে, কিছু পুরুষ অনেক সময় নিছক কৌতুহলের বশে বা তন্ত্রমন্ত্র শেখার জন্য সেখানে যায়। কিন্তু সেখান থেকে মন্ত্র শেখার পর বের হবার আর কোন রাস্তা খুঁজে পায়না, তখন ডাকিনী- যোগিনীদের দাস হয়ে দিন কাটাতে হয়।বহু সাধনার পর হয়তোবা কেউ কেউ পথ খুঁজে বের হয়ে আসতে পারে আর যারা বের হয়ে আসেন তারা অনেক বড় তান্ত্রিক হয়ে যান তাঁর সাধনা বলে। আসলে কামরুপ কামাখ্যা কোথায় এবং জায়গাটা কেমন এটা জেনে নেওয়া যাক—আসলেই কি এটি জাদুর রাজ্য? কামরূপ ভারতের আসাম রাজ্যের একটি জেলার নাম, মেঘালয় সীমান্তে অবস্থিত। তবে কামরূপ আসলে ছিল একটি রাজবংশ। কামরূপ রাজত্ব খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সাল থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত আসাম, পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ, বিহার, ভুটান ও বাংলাদেশের কিছু অংশ জুড়ে ছিল।ব্রহ্মপুত্র নদীর উপত্যকা জুড়ে প্রসারিত ছিল কামরূপ রাজাদের রাজত্ব। ষোড়শ শতাব্দীতে অহম রাজা কামরূপ দখল করে নেয়। তবে আসাম রাজ্যের একটি জেলা এখনও সেই নাম ধারণ করে আছে।

মন্দিরচত্বরে গাছে হলুদ–লাল দাগা বাঁধছেন এক পুণ্যার্থী। ছবি: Prothom Alo

কামরূপ জেলার সঙ্গে যাদুবিদ্যা বা তন্ত্রমন্ত্রের কোন সম্পর্ক নেই। তবুও নামটা আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি যে, এটি জাদুর রাজ্য! কোন পুরুষ মানুষ একবার সে দেশে গেলে মায়াবিনীরা যাদুবিদ্যা দিয়ে তাদেরকে ভেড়া বানিয়ে আজীবন সেখানে রেখে দেয়। ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের নীলাচল পাহাড় চূড়ায় রয়েছে কামাখ্যা মন্দিরটি। একধারে পাহাড়ের দেয়াল। সেই দেয়ালের মাঝে মাঝে টেরাকোটার কাজ করা আছে, কামাখ্যা সত্য যুগের কিংবদন্তি ও আসামের ঐতিহ্য। আরেক ধারে অন্য পাহাড়ের গা ঘেঁষে রংবেরঙের সব ঘরবাড়ি। কাজেই সেখানে শুধু জাদুকর বা নারীরা নয়, সব ধরনের মানুষেরই বসতি আছে। কথিত আছে, এখানে অনেক আগে মহাশক্তিধর কিছু তান্ত্রিক ছিলেন, তাঁরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারতেন। হয়তো তার উপর ভিত্তি করে রটনাটি হয়েছিল।

মন্দিরের দেয়ালে পাথুরে ভাস্কর্য। ছবি: Prothom Alo

হিন্দুপুরানে আছে, কামাখ্যা হচ্ছে সতী বা পার্বতী আর তার স্বামী শিব দেবতার মিলিত হবার স্থান। সত্য যুগে দক্ষ রাজার কন্যা সতীদেবী দক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ‘যোগী’ মহাদেবকে বিয়ে করায় দক্ষ ক্ষুব্ধ হন। মহাদেবের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দক্ষ রাজা বৃহস্পতি নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। রাজা দক্ষ, মহাদেব ও তাঁর কন্যা সতীদেবী ছাড়া প্রায় সব দেব-দেবীকে নিমন্ত্রণ করেন। এদিকে বাবার বাড়িতে যজ্ঞের আয়োজন, মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতীদেবী মহাদেবের অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কিন্তু সতীদেবী আমন্ত্রিত অতিথি না হওয়ায় তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেন না দক্ষ, তার ওপর তিনি মহাদেবকে অপমান করেন। অভিমানী সতীদেবী তাঁর স্বামীর প্রতি পিতার এ অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন।

কামাখ্যা মন্দিরের অধিষ্ঠান, এটির থেকে অনূমিত হয় মূল মন্দিরটি নাগারা স্থাপত্যশৈলীর মন্দির ছিল।, Image source: Wikipedia

শোকাহত মহাদেব প্রচন্ড রাগ হয়ে দক্ষর যজ্ঞ ভন্ডুল করেন এবং সতীদেবীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। ফলে বিশ্বময় প্রলয় শুরু হয়। দেবতারা অনুরোধ করেন মহাদেবকে এই নৃত্য থামানোর জন্য। কিন্তু মহাদেবের নৃত্য না থামালে বিষ্ণু দেব তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীদেবীর মৃতদেহ ছেদ করে মহাদেবকে নিরস্ত্র করেন। এতে সতীদেবীর দেহটা খন্ড- বিখন্ড হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। মোট একান্নটি জায়গায় সতীর দেহের অংশ ছড়িয়ে পড়ে।যার নিদর্শন আমাদের বাংলাদেশের চারটি স্থান বা মন্দিরেও আছে। গৌহাটির কামাখ্যা মন্দির একান্ন পীঠের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পীঠ। যা পরে হিন্দুদের পবিত্র পীঠস্থান (শক্তিপীঠ) হিসেবে পরিচিতি পায় ও পূজা করা হয়। শিবের তরুণী স্ত্রী সতীদেবীই কামাখ্যা নামে পরিচিত। আটশ’ শতাব্দীতে তৈরি করা এই কামাখ্যা মন্দিরটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরটি দেয়ালে খোদাই করা ভাস্কর্য শিব-পার্বতীর ভালবাসার কথা মনে করিয়ে দেয়। মূল অংশটি মন্দিরের মধ্যে পাহাড়ের গুহায় অবস্থিত। একটি অসাধারণ স্থাপত্যকলার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই মন্দির।

মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্য, Image source: Wikipedia

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নীলাচল পাহাড়ে মঙ্গল আক্রমণে প্রথম তান্ত্রিক কামাখ্যা মন্দিরটি ধ্বংস হয়েছিল। এরপরও আরো অনেকবার মন্দিরটি আক্রমণ করা হয়েছে। পরে আবার সেটি নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের চারপাশ ও দেয়ালে অবস্থিত বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তির গড়ন দেখেই তা বোঝা যায়। বর্তমান মন্দিরভবনটি অহম রাজাদের রাজত্বকালে গড়া।  এখানে যখন উৎসব হয়, সে সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তান্ত্রিকসাধুরা এসে জমায়েত হন কামাখ্যায়, নিজেদের শক্তি–ক্ষমতা বাড়াতে। প্রাচীনকাল থেকেই সাধু, সন্ন্যাসী আর তান্ত্রিকদের সাধন- ভজনের জন্যই হয়তো কামাখ্যার এত কিংবদন্তি। এই মন্দিরে দুর্গাপূজাসহ আরো বেশ কিছু বড় উৎসব পালিত হয়। তার মধ্যে অম্বুবাচী মেলা উল্লেখযোগ্য। লোকবিশ্বাসমতে, আষাঢ় মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী বা ধরিত্রী মা ঋতুময়ী হয়। এই সময়টিতে কামাখ্যাদেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঘটনাকে উদ্‌যাপন করা হয়। এই সময় মূল গর্ভগৃহের প্রস্রবণের জল (বিজ্ঞানমতে, আয়রন অক্সাইডের প্রভাবে) লাল হয়ে থাকে। তখন এখানে বড় অম্বুবাচী মেলা বলে একটি বড় উৎসব হয়। সেসময় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু তীর্থযাত্রী ও সাধু–সন্ন্যাসী জমায়েত হন। কেউ আসেন তাঁর ইচ্ছা পূরণের আশা নিয়ে,কেউ নিজের তান্ত্রিকশক্তি বাড়ার আশায়।

কামাখ্যার সাধু। ছবি: Prothom Alo

লোকবিশ্বাস অনুসারে, শক্তিপীঠ নামাঙ্কিত তীর্থগুলোতে সতীদেবীর দেহের নানান অঙ্গ ও অলংকার রাখা আছে। ফলে শক্তিপীঠ মন্দিরের পূজিত মূল ভিত্তিগুলো পূর্ণাঙ্গ মানুষ আকৃতির মূর্তি হয় না। ভারতীয় উপমহাদেশের নানান স্থানে এই শক্তিপীঠগুলো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। সতীদেবির হাতের তালু ও পায়ের পাতা পড়েছিলো বর্তমান বাংলাদেশের শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুরে। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, যশোরেশ্বরী ভীষণামূর্তির রূপ সত্যযুগের পরিচয় বহন করছে। যশোরেশ্বরীর মুখ ছাড়া অন্য অংশগুলো নেই। সেই নিরেট পাথরখণ্ডটি মাটির নিচে গাঁথা আছে। বাংলাদেশে সতীদেবীর অঙ্গ ও গয়না পড়েছে এমন শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিত বগুড়ার ভবানীপুর, সিলেটের শ্রীশৈল, কালাজোড় গ্রাম ও জয়ন্তিয়া, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথমন্দির এবং বরিশালের সুগন্ধা। তবে সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী বাংলার অন্যতম শক্তিপীঠগুলোর একটি। ধর্মীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি প্রত্নতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রস্তরীভূত শক্তিপীঠ আমাদের অঞ্চলের প্রাচীন মানববসতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এগুলো আমাদের ভূখণ্ডের মানব ইতিহাস অনুসন্ধানে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হয়।

কামাক্ষ্যা মন্দিরে স্থানীয় গায়কদের ধর্মীয় সংগীতের অনুষ্ঠান, Image source: Wikipedia

তথ্যসূত্র

বাংলা ট্রিবিউন

প্রথম আলো