নিকোপলিসের ক্রুসেডে খ্রিস্টান বাহিনীকে তুলোধনা করে ইতিমধ্যে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিলেন সুলতান বায়েজিদ। ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর এ যুদ্ধে অটোমান বাহিনীর কাছে দাঁড়াতেই পারেনি ক্রুসেডাররা। এ বিজয় সুলতান বায়েজিদের খ্যাতির জন্য সুখকর ছিল৷ একে একে ইউরোপের অবাধ্য অঞ্চল বাধ্য হচ্ছিল সুলতান বায়েজিদের দূরদর্শিতায়। ঠিক একই সময় পৃথিবীর অন্য প্রান্তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন খোড়া পায়ের বিজেতা তৈমুর লং৷ ইতিমধ্যে তার প্রতিষ্ঠিত তিমুরীয় সাম্রাজ্য বেশ সুখ্যাতিও পেয়ে গেছে৷ তৈমুর লং এবার নজর দিলেন ইউরোপের দিকে৷ পত্র পাঠালেন বায়েজিদের কাছে। নিকোপলিসের ক্রুসেড জয়ে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি এও স্মরণ করিয়ে দিলেন তৈমুরের সাথে লাগতে আসলে কেউ কোন ছাড় পায়না৷ বায়েজিদ এমন পত্রপাঠে স্বাভাবিকভাবেই খুশি হলেন না। এমন এক ঘোরতর সময়ে তার কিছু আমির বিদ্রোহী হয়ে তৈমুরের কাছে আশ্রয় নিলেন। জালায়িরীদ বংশের সুলতান আহমেদ এবং ক্বারা ক্বয়োনলু নামের এক শিয়া অঘুজ তুর্কী গোত্রের প্রধান ক্বারা ইউসুফ এই দুইজন ছিলেন তৈমুরের শত্রু। তারা পালিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যে আসলে তাদের আশ্রয় দেন সুলতান বায়েজিদ। এতে তৈমুরও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। তৈমুরের পত্র পাঠ করে সুলতান বায়েজিদ নিজের ক্ষোভ সংবরণ করতে পারলেন না। আপাতত একটি আক্রমণ করে তিনি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করলেন। আর এ কাজে বেছে নিলেন পুত্র সুলায়মান সেলেবিকে। ১৩৯৯-১৪০০ সালের দিকে তার পুত্র সুলায়মান সেলেবিকে আর্মেনিয়ায় একটি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়ে পাঠান। তৈমুরের ঘনিষ্ঠ মিত্র এর্জিনকানের তাহার্তেন ছিলেন আর্মেনিয়ার শাসক। সুলায়মান কামাখ নামের একটি শহর দখল করে পিতার আস্থার প্রতিদান দেন। তবে মিত্রের ওপর আক্রমণকে নিজের ওপর আক্রমণ বলেই মনে করলেন তৈমুর। আর এর প্রতিশোধ হিসেবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন তিনি। বায়েজিদের শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে নিজেকে শক্তিশালী করেন তৈমুর। ১৪০২ সালের নতুন বছরে পৃথিবীতে আরো একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধের তাণ্ডবলীলা শুরু হওয়ার মঞ্চ তৈরি হলো।
ক্রোধান্বিত বায়েজিদের সাথে তৈমুরের এবার একটি যুদ্ধের অবতারণা হতে আর বেশ বেগ পেতে হল না। প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হতে থাকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুই যোদ্ধার মধ্যে। এ যুদ্ধ ইতিহাসে অঙ্গোরার যুদ্ধ নামে পরিচিত।
মুখোমুখি তৈমুর-বায়েজিদ
১৪০২ সালের ২৮ জুলাই অটোমান ও তৈমুরের বাহিনী অঙ্গোরা (বর্তমান আংকারা) শহরে উপস্থিত হয়। তৈমুরের ১ লক্ষ ৪০ হাজার সৈন্যের বিপরীতে সুলতান বায়েজিদের ছিল ৮৫ হাজার সৈন্য৷ অবশ্য সৈন্য সংখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বেশ বিভক্তি লক্ষ্য করা যায়৷ তৈমুরের শক্তিশালী সেনাবহর দেখে অনেক বিদ্রোহী ও প্রতিপক্ষ গোষ্ঠী তার বাহিনীতে যোগ দেন৷ এদের মধ্যে ছিল পারস্য, ভারত, চাগতাই তুর্কির সৈন্যরা৷ তৈমুরের বাহিনীতে ছিল ভারতীয় বিখ্যাত যুদ্ধ হাতি। বায়েজিদের বাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ ছিল তুর্কি জেনিসারি বাহিনী। এই জেনিসারি বাহিনীর মাধ্যমেই নিকোপলিসের ক্রুসেডে অটোমানরা বিজয় নিশ্চিত করেছিল। এরপরও সুলতান বায়েজিদ নিজের মিত্রদের বুঝিয়ে শুনিয়ে তার পক্ষে নিয়ে আসেন। ফলে অটোমান বাহিনীও একটি ভীতিকর শক্তিতে রূপ নেয়। অঙ্গোরার প্রান্তরে যুদ্ধ শুরুর আগে অঙ্গোরা আসতেই অটোমান বাহিনী সময় নেয় প্রায় ৮ দিন। তৈমুর কৌশলে তাদেরকে এই ফাঁদে ফেলেন। তৈমুর তার বাহিনী নিয়ে দক্ষিণ পশ্চিমে নিজেদের অবস্থান নেন। ২৭ জুলাই তারিখে যখন বায়েজিদের বাহিনী প্রথম তাঁবু গাড়ে তখন সেনারা ছিল ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত। সুলতানের বিশেষজ্ঞরা নিজেদের রণনীতি উপস্থাপন করেন। তারা বায়েজিদকে বুঝান যে এই পরিস্থিতিতে আক্রমণাত্মক না হয়ে বরং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কিন্তু প্রতিশোধপরায়ণ সুলতান তার সেনাদের আক্রমণাত্মক হওয়ারই নির্দেশ দেন। যুদ্ধের ময়দানে উভয় বাহিনীই নিজেদের সৈন্য ফরমেশন করে। অটোমান বাহিনীর ডান ভাগের দায়িত্ব দেয়া হয় বায়েজিদের পুত্র সুলায়মান সেলেবিকে।
প্রখর রৌদ্রতাপের মধ্যেই সকাল ১০ টার দিকে তুর্কি বাহিনী তৈমুরের বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। যুদ্ধের প্রথমদিকে উভয় বাহিনীই প্রাণপণ যুদ্ধ করে নিজেদের শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে থাকে। সুলতান বায়েজিদের মিত্র সার্বিয়ান রাজপুত্র স্টেফান লাজারেভিচ ও তার যোদ্ধারা তৈমুরের বাহিনীর ভেতরে গিয়ে নিজেদের আক্রমণ শাণাতে থাকে। এর আগে তৈমুর উসমানীয় বাহিনীর পানির উৎস করায়ত্ত করে তাদেরকে বিপদে ফেলে দেন। যুদ্ধের মাঝখানে উসমানীয় বাহিনী পানিত তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ে।
এসময় ডানদিক থেকে প্রবল বিক্রমে তৈমুরের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে অটোমান সেনারা। তবে তিমুরীয় বাহিনীর অনবরত ছোঁড়া তীরের মাঝখানে পড়ে বেশ সুবিধা করতে পারেনি তারা। অপরদিকে বামদিকে থাকা খ্রিস্টান নাইটরা অটোমানদের পক্ষে বেশ সাহসের সাথে তৈমুরের বাহিনীকে কোণঠাসা করে রাখে। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি যখন অনিশ্চিত মনে হতে লাগল তখনই হঠাৎ করে পরিস্থিতি ভিন্ন এক বাঁক নেয়। সহসাই তুর্কি বাহিনীর তাতার যোদ্ধারা দলত্যাগ করে নিজেদের স্বজাতি অর্থাৎ তিমুরীয় বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। বায়েজিদের সৈন্যসংখ্যার এক চতুর্থাংশ এসব তাতার যোদ্ধাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তুর্কি বাহিনী দুর্বল হয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। চরম হতাশ আর বিশৃঙ্খল অটোমান বাহিনী হারার আগেই হারতে বসে গেল। উপায় না দেখে বায়েজিদ তার পুত্র সুলেমানকে বাম বাহু হতে আক্রমণের নির্দেশ দেন। কিন্তু তিমুরীয় বাহিনীর অনবরত তীর নিক্ষেপের কারণে সুলেমান তার আক্রমণ আর জোরালো করতে পারলেন না। ওদিকে ধূলির কবলে পড়ে তুর্কি সৈন্যরা বেসামাল হয়ে মারা পড়তে লাগল৷ তুর্কিদের বিচ্ছিন্নতার সুযোগে তৈমুরের সেনাপতি নুরুদ্দিন এ বাহিনীকে পুরো বিধ্বস্ত করে দেন। অবস্থা বেগতিক দেখে যুদ্ধের ময়দান থেকে সুলেমান পালিয়ে যান। সুলতান বায়েজিদ তার জেনিসারি বাহিনী নিয়ে পাহাড়ে প্রতিরক্ষা নেন। কিন্তু বায়েজিদকে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়। তিনি ঘোড়ার পিঠে প্রকাণ্ড এক কুঠার হাতে যুদ্ধ চালিয়ে যান। এ যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ঐতিহাসিক আরাবশাহ ও শেরিফুদ্দিন সুলতান বায়েজিদের রণনিপুণতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ক্লান্ত সুলতান এক পর্যায়ে তীরবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন৷ সন্ধ্যা নাগাদ বায়েজিদ তৈমুরের হাতে বন্দি হোন। তার পুত্র সুলায়মানকেও বন্দি করা হয়।
বায়েজিদের সাথে কেমন ব্যবহার করেছিলেন তৈমুর?
বায়েজিদের সাথে তৈমুরের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে পরস্পরবিরোধী অনেক মতবাদ প্রচলিত৷ কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন তৈমুর বায়েজিদের সাথে অত্যন্ত সৌজন্যমূলক আচরণ করেছিলেন আবার অনেকেই মনে করেন তৈমুর তা করেননি। ইবনে আরাবশাহ এ বিষয়ে বলেন, বায়েজিদকে বিদ্রুপ করার জন্য প্রতিদিন তাকে লোহার খাচায় করে তৈমুরের সামনে আনা হত। তবে তার এ বক্তব্য সত্য বলে মনে হয়না। বন্দি হওয়ার দিনই তৈমুর বায়েজিদের সাথে সৌজন্যবোধ দেখিয়ে তার পাশে বসতে দেন। তবে বায়েজিদ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে কড়া প্রহরে আটকে রাখা হয়৷ বন্দি হওয়ার আট মাসের মাথায় হতাশ সুলতান ১৪০৩ সালের মার্চ মাসে প্রাণত্যাগ করেন। এই যুদ্ধ উসমানীয় ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ও পীড়াদায়ক স্মৃতি হিসেবে রয়ে গিয়েছিল। সুলতান বায়েজিদই ছিলেন প্রথম কোন অটোমান সুলতান যিনি যুদ্ধে বন্দি হয়েছিলেন। এই যুদ্ধের পর সুলতানের পুত্রদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। প্রায় ৫০ হাজার তুর্কি সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল।