“না…আমাকে মেরো না। ছাড়ো আমাকে! মূর্খের দল! জানো না আমি কে?”- সময়টা খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০ অব্দ। আর এই কথাগুলো ছিল মগধের হর্য্যঙ্ক বংশের শেষ পরাক্রমশালী রাজা অজাতশত্রুর (রাজত্ব: খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯২- খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০)। সিংহাসন বড়ই মায়ার। সবার আকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে থাকে যে আসন, সে আসন পাবার পথ কতটা হীন, লালসাময় আর রক্তাক্ত হতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাজা অজাতশত্রুর জীবন। চলুন, তবে ঘুরে আসি সেই রাজার জীবন থেকে, বংশের সফলতম শাসক হয়েও অদৃষ্টের লিখন যার পিছু ছাড়েনি।

 প্রতাপশালী বিম্বিসার

ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম প্রতাপশালী রাজা বিম্বিসারের (রাজত্ব: খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪২- খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯২) পুত্র ছিলেন অজাতশত্রু। বৌদ্ধমতে, রাজা অজাতশত্রুর মাতা ছিলেন কোশলরাজ মহাকোশলের কন্যা কোশল দেবী। অন্যদিকে জৈনমতে, বৈশালীর রাজা চেতকের কন্যা চেলেনা। জৈন সূত্র মতে, গর্ভবতী অবস্থায় রানি চেলেনার নিজ স্বামীর “হৃৎপিন্ড ভাজা” খেতে খুব ইচ্ছা হয়। একথা শুনে রাজা বিম্বিসার ও রানি নন্দের বুদ্ধিমান রাজপুত্র অভয়কুমার হৃৎপিন্ডের মতো দেখতে এক বুনো ফল এনে ভেজে রানির চেলেনার হাতে দেন। সেটি খাওয়ার পর রানির অনুশোচনা হয় এবং তিনি অনাগত সন্তানকে রাজবংশের জন্য অশুভ মনে করেন। জন্মের কিছু মাস পর তিনি শিশু অজাতশত্রুকে প্রাসাদের বাইরে ফেলে দেন। রাজা বিম্বিসার এ ঘটনা শুনে দ্রুত গিয়ে দেখেন, একটি মোরগ রাজপুত্রের আঙ্গুল ঠুকরে রক্ত বের করে ফেলেছে। তিনি রাজপুত্রকে কোলে তুলে আঙ্গুলের রক্ত শুষে নিলেন যতদিন না সেরে যায় এবং শিশু অজাতশত্রুর ডাকনাম দিলেন “কুনিক”(ক্ষতযুক্ত আঙ্গুল)।

রাজা অজাতশত্রু

রাজা বিম্বিসারের এতো আদরের রাজপুত্র অজাতশত্রু আসলেই এক সময় তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। গৌতম বুদ্ধের প্রিয় বন্ধু এবং শিষ্য ছিলেন রাজা বিম্বিসার। বুদ্ধের খ্যাতি দেখে হিংসা করে বুদ্ধেরই সংঘত্যাগী ভিক্ষু দেবদত্ত রাজপুত্র অজাতশত্রুকে পিতৃহত্যা করে সিংহাসন দখল করতে প্ররোচিত করতে থাকে। অবশেষে ৪৯২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অজাতশত্রু বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক বিম্বিসারকে হত্যার চেষ্টা করেন। বুদ্ধের মতাদর্শে বিশ্বাসী রাজা বিম্বিসার এই ঘটনায় তাঁর পুত্রকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু আবারো দেবদত্তের প্ররোচনায় অজাতশত্রু বিম্বিসার ও তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীকে গৃহবন্দী করে নিজেকে মগধের শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ৪৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৃহবন্দী অবস্থায় বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে অথবা অজাতশত্রু আদেশ দিয়ে পিতাকে খুন করেন।

অজতাশত্রুর রাজ্য

“অবদান-শতক” গ্রন্থ থেকে জানা যায়, প্রথম জীবনে অজাতশত্রু বৌদ্ধ ধর্মের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর পিতা রাজা বিম্বিসার ছিলেন গৌতম বুদ্ধের ভক্ত। তিনি তাঁর অন্তঃপুরে বুদ্ধের পায়ের নখ ও চুলের উপর একটি স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। অজাতশত্রু রাজা বিম্বিসারের মৃত্যুর পর এই স্তূপে পূজা বন্ধ করে দেন। এক দাসী গোপনে পূজা দিতে গেলে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর তিনি প্রজাদের  গৌতম বুদ্ধের কাছে যাওয়া নিষেধ করে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পিতাকে হত্যা করার জন্য দারুন মনোকষ্টে ভুগতেন। অনুশোচনায় দগ্ধ অজাতশত্রু শান্তিলাভের আশায় বিভিন্ন ধর্ম উপদেষ্টা ও দার্শনিকের শরণাপন্ন হন। কিন্তু তাঁদের উপদেশে শান্তিলাভে ব্যর্থ হয়ে রাজবৈদ্য জীবকের উপদেশে পিতৃহত্যার কথা স্বীকার করে তার প্রতিকার প্রার্থনা করে গৌতম বুদ্ধের শরণাপন্ন হলে বুদ্ধ তাঁকে ত্রিপিটকের সূত্রপিটকের দীর্ঘনিকায় অংশের “সামঞ্ঞফলসুত্ত” ব্যাখ্যা করেন।

রাজা অজাতশত্রু ও বুদ্ধা

বৌদ্ধ মতে, বিম্বিসার-এর স্ত্রী এবং অজাতশত্রুর মা কোশল দেবী ছিলেন কোশল-রাজ প্রসেনজিৎ-এর বোন। বিম্বিসারের বন্দীত্ব ও মৃত্যুর ঘটনায় ক্রুদ্ধ কোশল রাজ প্রসেনজিৎ একসময় উপহার হিসেবে রাজা বিম্বিসারকে দেওয়া কাশী রাজ্য পুনরায় নিজের অধীনে নিয়ে মগধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই সুযোগে বৈশালীর বৃজি ও পাবার মল্লরাও মগধের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু বিম্বিসার-এর গড়া বিশাল সুদক্ষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো বাহিনীই জয়লাভ করতে সক্ষম হয় নি। পরাজয় অনিবার্য মেনে প্রসেনজিৎ শেষ পর্যন্ত অজাতশত্রুর সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। সন্ধির শর্ত অনুসারে প্রসেনজিৎ তাঁর কন্যা বজিরার সাথে অজাতশত্রুর বিয়ে দেন। এই সময় বিয়ের যৌতুক হিসেবে প্রজেনজিৎ কাশী অঞ্চলকে অজাতশত্রুর হাতে অর্পণ করেন। অজাতশত্রু যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন। এমনকি তিনি দুটি অনন্য যুদ্ধাস্ত্রের আবিষ্কারক। তার মধ্যে একটি হলো “রথমুসল” (তরবারির মতো ফলাযুক্ত রথ), অন্যটি “মহাশিলাকন্টক” (বড় পাথর ছুঁড়ে মারার অস্ত্র)। দুটি অস্ত্রই অনেকটা “বাহুবলী” সিনেমায় দেখানো যুদ্ধাস্ত্রের মতো।

রাজগীরের অজতাশত্রু স্তূপ

কোশল-রাজ প্রসেনজিতের সাথে দ্বন্দ্ব মিটে যাওয়ার পর, অজাতশত্রু বৈশালীর বৃজি ও পাবার মল্লদের শায়েস্তা করার জন্য উদ্যোগ নেন। বুদ্ধঘোষের বর্ণনা অনুযায়ী, গঙ্গা নদীর তীরবর্তী একটি বন্দর এলাকার অর্ধেক অংশ অজাতশত্রুর অধিকারে এবং অর্ধেক অংশ বৃজি মহাজনপদের অধিকারে ছিল। এই বন্দরের নিকটবর্তী একটি পাহাড়ে প্রাপ্ত “গন্ধভাণ্ড” নামক এক ধরনের সুগন্ধী দ্রব্যের অধিকার নিয়ে মগধ ও বৃজি মহজনপদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বেশ কয়েক বার অজাতশত্রুর পূর্বেই লিচ্ছবিরা সম্পূর্ণ গন্ধভাণ্ড অধিকার করে নিজের দেশে চলে গেলে অজাতশত্রু প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করেন। দীঘনিকায়ের মহাপরিনিব্বানসুত্ত অনুসারে, তিনি তাঁর মন্ত্রী বস্সকারকে গৌতম বুদ্ধের নিকট প্রেরণ করে লিচ্ছবিদের পরাজিত করার উপায়ের সন্ধান করতে বলেন। গৌতম বুদ্ধ মত দেন যে, যতদিন লিচ্ছবিরা সম্মিলিত ভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করে একত্রিত ভাবে মতগ্রহণ করবেন, নিজের দেশের আইন ও জেষ্ঠ্যদের উপদেশ মেনে চলবেন, নারীদের বিরুদ্ধে কোন হিংসামূলক অপরাধে জড়িত থাকবেন না, ধর্মস্থান ও অর্হতদের সম্মান করবেন, ততদিন কোন বৈদেশিক শক্তি তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এই উপদেশের ফলে অজাতশত্রু এরপর সামরিক শক্তির বদলে লিচ্ছবিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে সফল হন এবং মগধের সেনা বৃজি মহাজনপদ অধিকার করতে সক্ষম হয়।

গৌতম বুদ্ধের নির্বাণলাভ অর্থাৎ মৃত্যুর পর, অল্প দিনের ভিতরে মতাদর্শগত বিভেদ প্রকট হয়ে ওঠে। তাছাড়া এই সময়ের ভিতরে বুদ্ধের যোগ্য শিষ্যদের অনেকে মৃত্যুবরণও করেন। বুদ্ধের বাণী এবং তার ব্যাখ্যা বিলীন হওয়া বা বিকৃত হওয়ার আশংকা তীব্রতর হয়ে উঠে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, ৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মগধের মহারাজ  অজাতশত্রুর সহায়তায় মহাকাশ্যপ এক বৌদ্ধসভার আয়োজন করেন। কথিত আছে, মহারাজ অজাতশত্রু রাজগৃহের “সপ্তপর্ণ” নামক গুহায় এই সভায় যোগদান করেছিলেন। এই সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য আনন্দের নেতৃত্বে সংগৃহীত হয়েছিল ধর্মাংশ এবং আর বুদ্ধের অপর শিষ্য উপালি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিনায়ংশ। পরে এই দুই সংগ্রহকে বিষয়ানুসারে ভাগ করে, তৈরি করা হয়েছিল বিনয়পিটক ও সূত্রপিটক। পরে সূত্রপিটকের একটি অংশ পৃথক করে অভিধম্মপিটক নামক তৃতীয় পিটক তৈরি করা হয়। এই তিনটি পিটকের সংকলনই হলো ত্রিপিটক।

অজতাশত্রু স্তূপের অবশেষ

একই সাথে তিনি জৈন ধর্মে বিশ্বাস করতেন। তিনি বহুবার সপরিবারে জৈনগুরু মহাবীরের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।

পালি সাহিত্যে “জাতকের গল্প” থেকে জানা যায় যে, অজাতশত্রু নিষ্ঠুর প্রকৃতির রাজা ছিলেন। অন্যদিকে, গৌতম বুদ্ধের অনুসারী হয়ে তিনি রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তৃতি আর উন্নয়নও করেছিলেন।

কথায় আছে, “শেষ ভালো যার, সব ভালো তার”। কিন্তু বৌদ্ধমতে, ঠিক পিতা রাজা বিম্বিসারের মতোই মহারাজ অজাতশত্রু নিজ পুত্র উদয়ভদ্রের হাতে নিষ্ঠুরভাবে খুন হন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, তাই মহারাজ অজাতশত্রুকেও কর্মফল ভোগ করতে হয়েছে। অবাক ব্যাপার হলো মহারাজ অজাতশত্রুর পুত্র উদয়ভদ্রেরও (রাজত্ব: ৪৬০ খ্রিষ্টপূর্ব -৪৪৪ খ্রিষ্টপূর্ব) মৃত্যু হয় নিজ পুত্র অণুরুদ্ধক এর হাতে। এই বংশের শেষ রাজা নাগদাসকে হত্যা করে তাঁর মন্ত্রী শিশুনাগ মগধের সিংহাসন অধিকার করেন। এভাবেই শেষ হয় উপমহাদেশের ইতিহাসের সর্বপ্রথম ধারাবাহিক ঐতিহাসিক রাজবংশের।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, গুগল