বিশ্ব চলচ্চিত্রে সাসপেন্স-থ্রিলার এবং অ্যালফ্রেড হিচকক একে অপরের পরিপূরক। সাসপেন্স-থ্রিলার জঁর সিনেমা হিচককের হাত ধরেই হাঁটতে শিখেছে, প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েছে। এক কথায় ‘মাস্টার অফ সাসপেন্স’ বলা যায় এই ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালককে। অবশ্য শুধুমাত্র ‘মাস্টার অফ সাসপেন্স’-এর পরিধিতে সীমাবদ্ধ রাখলে এই কিংবদন্তী পরিচালকের প্রতিভার প্রতি অবমাননা হবে। দীর্ঘ চার দশকে তাঁর কাজের ব্যাপ্তি, সিনেমায় নতুন ভাষা ও শৈলীর উদ্ভাবন, তৎকালীন এবং সমকালীন সময়েও চলচ্চিত্রে তাঁর প্রভাব তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।
‘রহস্যময়তা’কে মুল উপাদান করে হিচকক তাঁর চলচ্চিত্রে যে ধারার সৃষ্টি করেছেন, তাতে রহস্য, রোমাঞ্চ, ভয়, ভীতি, উদ্বেগ, যৌনতা, নাটকীয়তা, টান টান উত্তেজনার পরতে মিশে সিনেমাকে দিয়েছে এক অন্য মাত্রা; সঙ্গে তাঁর ব্যতিক্রমী সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী ক্যামেরার কাজ যে নান্দনিকতাকে ছুঁয়েছে তা আজও দর্শককে বিহ্বল করে রাখে। সাদাকালো নির্বাক থেকে শুরু করে সবাক হয়ে রঙিন- তাঁর প্রতিটি সিনেমাই এক একটি মাস্টারপিস।
১৮৯৯-এর ১৩ই আগস্ট ইংল্যাণ্ডের লেটনস্টোনে এক ধার্মিক ক্যাথিলিক পরিবারে জন্মে ছিলেন অ্যালফ্রেড হিচকক। মা এমা এবং বাবা উইলিয়ামের দ্বিতীয় সন্তান অ্যালফ্রেড। জেসুইট স্কুলে প্রাথমিক পাঠের পর সেন্ট ইগনাটিয়াস কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং ও লন্ডনের কান্ট্রি কাউন্সিল স্কুলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর, ১৯১৪ সালে ডব্লিউ টি হেনলির টেলিগ্রাফ ওয়ার্কস কোম্পানিতে একজন ড্রাফটসম্যান হিসেবে কাজে যোগ দেন। পরে বিজ্ঞাপন বিভাগে যুক্ত হন। টেলিগ্রাফে কর্মরত সময়ে হিচকক টেলিগ্রাফ পত্রিকার জন্য বেশ কিছু গল্পও লেখেন যেগুলো ছিল মুলত নারী কেন্দ্রিক। যেমন- ‘গ্যাস’, ‘দ্য ওমেন পার্ট’ ‘দ্য হিস্ট্রি অফ পি ইটিং’ ‘সরদিদ’, ‘অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ নো রেইনবো’, ‘ফেডোরা’ ইত্যাদি। ১৯২০ নাগাদ লণ্ডনে ফিল্ম প্রোডাকশনে কাজ করা শুরু করেন। প্যারামাউন্ট পিকচারের লণ্ডন শাখায় তিনি টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। এরপর তিনি ‘ইসলিংটন স্টুডিও’-তে কাজে যুক্ত হন। এরপর টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে করতে প্রথমে আর্ট ডিরেক্টর, পরে প্রোডাকশন ডিজাইনার, এডিটর, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর এবং স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবেও কাজ করেন; অবশেষে আত্মপ্রকাশ করেন চিত্রপরিচালক হিসেবে।
যদিও পরিচালক হিসেবে হিচককের শুরুটা মোটেই ভালো ছিল না। ‘নং ১৩/ মিসেস পিবডি’ (১৯২২) নামের একটি ছবির কাজ মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায় টাকার অভাবে। এই বছরেই নিজের লেখা চিত্রনাট্যে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ‘উওমেন টু উওমেন’ নামের ছবিতে। অবশেষে ১৯২৫-এ একক পরিচালনার সুযোগ পান ‘দ্য প্লেজার গার্ডেন’ ছবিটিতে। কম বাজেটের এই ছবির বিষয় ছিল পরকীয়া ও খুন, মেলোড্রামায় ভরপুর এই ছবিটি খুব ভালো সাড়া ফেলতে না পারলেও হিচককের পরবর্তী কাজের প্রাথমিক রূপরেখা তৈরী করে দিয়েছিল। এরপর ‘দ্য মাউন্টেন ঈগল/ ফিয়ার গড’ নামের একটি মাঝারি মানের কমেডি ছবির পর ১৯২৬-এর ‘দ্য লজার: এ স্টোরি অব দ্য লন্ডন ফগ’ ছবিটিতে প্রথম হিচককের প্রতিভা ও হিচককীয় শৈলীর স্ফুরণ ঘটে। মুখ্য চরিত্র নির্দোষ জোনাথন ড্রিউ একটি ভয়াবহ খুনের দায়ে পালিয়ে বেড়ায় এবং কীভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে- এই ছিল ছবির মূল উপজীব্য বিষয়। পরবর্তী দুবছর ‘ডাউনহিল’, ‘ইজি ভারচু’, ‘শ্যাম্পেন’-এর মত আরও কিছু মাঝারি মানের ছবির পর ১৯২৯ সালে হিচকক তৈরী করেন ‘ব্ল্যাকমেইল’। এটি ছিল হিচককের এবং ইংল্যাণ্ডের প্রথম সবাক ছবি। ছবির গল্প এক তরুণীকে নিয়ে, যে এক উঠতি ফচকে শিল্পীকে ছুরির আঘাতে হত্যা করবে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে। প্রথম সবাক ছবি এবং বিষয়বস্তুর জন্য ছবিটি দর্শকমহলে বেশ সাড়া ফেলেছিল পাশাপাশি ব্যবসায়িকভাবেও সফল ছিল। যদিও চলচ্চিত্রটি প্রথমে নির্বাক ছবি হিসেবেই তৈরি হয়, কিন্তু পরে প্রযোজকদের উৎসাহে কিছু অংশ ডাব করে ও বাকি অংশে শব্দ সংযোজনা করে ছবিটি তৈরি করেন।
১৯৩০ সালে হিচকক ‘অ্যান ইলাস্টিক অ্যাফেয়ার’ ও ‘এলস্ট্রি কলিং’ নামে দুটো স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি তৈরি করেন – সংরক্ষণের অভাবে এই ছবি দুটির ফিল্ম নষ্ট হয়ে যায়। এই বছরেই তিনি ক্লিমেন্স ডেনের ব্রিটিশ নাটক ‘এন্টার স্যার জন’ অবলম্বনে ‘মার্ডার’ ও বিখ্যাত আইরিশ নাট্যকার শন ও’কেসির মঞ্চসফল নাটক ‘জুনো অ্যান্ড দ্য পেকক’ নামে আরেকটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন। ১৯৩১-এর ‘রিচ এন্ড স্ট্রেঞ্জ’, ‘দ্য স্কিন গেম’ এবং ১৯৩২-এর ‘নম্বর ১৭’-এর পর ১৯৩৪এর ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’ ছবিটি দিয়ে হিচকক থ্রিলার ছবি নির্মাণে নিজের পারদর্শিতা আরও এক ধাপ উপরে নিয়ে যান। এই ছবিটি হিচককের আন্তর্জাতিক মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি। পরে এই ছবিটি ১৯৫৬ সালে একই নামে আবার তৈরী করেন। ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’ ছবিটি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ এবং অত্যন্ত সার্থক ছবি। এই ছবিগুলো থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারি রোমাঞ্চকর গল্প বলার পারদর্শিতা হিচককের জন্মগত। অল্প কথায় হিউমার সহ অহেতুক আবেগপ্রবণতাকে বর্জন করে ঘটনাকে পরিবেশন করতে হিচককের জুড়ি মেলা ভার।
১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’ ছাড়াও রহস্য-রোমাঞ্চ মোড়কে তৈরি করলেন আরও কয়েকটা ছবি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দ্য থার্টি-নাইন স্টেপস’ (১৯৩৫), ‘দ্য সিক্রেট এজেন্ট’ (১৯৩৬), ‘স্যাবোটাজ’ (১৯৩৬), ‘ইয়াং অ্যান্ড ইনোসেন্ট’ (১৯৩৭) ও ‘দ্য লেডি ভ্যানিশেস’ (১৯৩৮)। এর মধ্যে ‘দ্য থার্টি-নাইন স্টেপস’ (১৯৩৫) ও ‘দ্য সিক্রেট এজেন্ট’ (১৯৩৬) মূলত রোমান্টিক-থ্রিলার। সামারসেট মমের লেখা গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরী ‘দ্য সিক্রেট এজেন্ট’ পরবর্তীতে এস্পেনিয়েজ বা স্পাই মুভির পথপ্রদশক বলা যায়। ছবির মুখ্য চরিত্র একজন ইংরেজ লেখক, যাকে ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা একটি সরকারী তথ্য সংগ্রহের কাজে সুইজারল্যাণ্ডে পাঠাবে যদিও তাঁর আগে এই ইংরেজ লেখকের নকল মৃত্যুকে জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠা করা হবে। ‘স্যাবোটাজ’ ছবিতে ‘মাস্টার অফ সাসপেন্স’ হিচকক বেশ টান টান উত্তেজনা তৈরী করেন যখন দেখি এক কিশোর অজান্তেই একটি প্যাকেজ নিয়ে ভিড় বাসে ওঠে, যে প্যাকেজে লুকানো আছে মানবঘাতী বোমা, নানা কারণে বাসটি তার নির্দিষ্ট সময়ে কিছুতেই ছাড়তে পারছে না, শেষ পর্যন্ত এক অপত্যাশিত ঘটনা ঘটে। যদিও ছবিটি তেমন সফল হল না। ‘দ্য লেডি ভ্যানিশেস’(১৯৩৮) ছবিতে দেখা যায় একটি সুন্দরী ভ্রমণপিপাসু ব্রিটিশ তরুণী ট্রেনে ইউরোপ ভ্রমণের সময় লক্ষ্য করলেন যে তাঁর পাশের মহিলা যাত্রীটি নিখোঁজ। ওয়াশরুমে অন্য বগিতে খুঁজেও তার হদিস পাওয়া গেল না। চলন্ত ট্রেন থেকে জলজ্যান্ত একজন মহিলা নিখোঁজ। এই ছবিটি ইংল্যাণ্ড এবং আমেরিকা দুজায়গাতেই বেশ ভালো চলেছিল। ছবিটির প্রথম দৃশ্যটিতে হিচককের সৃজনশীল ক্যামেরার কাজ দেখা যায় – একটি টপ শট, রেলওয়ে স্টেশনের ওপর দিয়ে প্যান করে ক্যামেরা এসে পৌঁছায় প্রতীক্ষালয়ে। আশ্চর্যের বিষয়, ক্রেনের ব্যবহার ছাড়াই হিচকক এই দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধরেছিলেন! দফেন দ্যু মারিয়ার উপন্যাস জ্যামাইকা ইন নিয়ে সবে কাজ শুরু করেছেন এমন সময় প্রযোজক রবার্ট সেলজনিক হলিউডে ছবি তৈরির জন্য প্রস্তাব দেন। হলিউডে যাবার আগে হিচককের শেষ ছবি ছিল ‘জ্যামাইকা ইন’।
১৯৪০ সালে দফেন দ্যু মারিয়ার উপন্যাস অবলম্বনে হিচককের প্রথম হলিউড ছবি রেবেকা। যদিও এই ছবির পটভূমি হিচককের পরিচিত ইংল্যাণ্ড। লরেন্স অলিভিয়ের ও জোয়ান ফনটেইনের অভিনয়ে সমৃদ্ধ রেবেকা সহজেই দর্শকমন জয়ে সমর্থ হল। ছবিতে দেখি মেনডারলির বাগানঘেরা প্রাসাদোপম বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায় সন্ত্রস্ত নায়িকা। হিচককের ক্যামেরা সাথে দর্শকও নায়িকাকে অনুসরণ করে। ছবিটি সে বছর সেরা ছবির জন্য অস্কার পুরস্কার লাভ করে আর হিচকক লাভ করেন সেরা পরিচালকের জন্য প্রথম অস্কার মনোনয়ন। পরের বছর ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস স্মিথ’ ছবিটিও ভালোই সফল হয়েছিল।
এ সময় চারদিকে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। মহাযুদ্ধের দাবিতে দুটো প্রচারে ছবিও তৈরি করলেন হিচকক। ১৯৪১-১৯৪৩ সালে একে একে মুক্তি পায় সাসপিকন, স্যাবোটিয়ার এবং শ্যাডো অব ডাউট। ক্যারি গ্রান্ট ও জোয়ান ফনটেইন অভিনীত সাসপিকন ছবির জন্য জন ফনটেইন সেরা অভিনেত্রীর অস্কার পুরস্কার পান ১৯৪১-এ। হিচকক দর্শকদের একটু ভিন্ন স্বাদের সন্ধান দিলেন শ্যাডো অব ডাউট (১৯৪৩) ছবিতে। যুদ্ধের বাজারে সুদর্শন চার্লি চাকরি খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই। তাই বড়লোক বিধবাদের বিয়ে পর তাদের হত্যা করে সম্পত্তি আত্মসাৎ করার সহজ পেশা বেছে নিল চার্লি। চ্যাপলিনের মঁসিয়ে ভের্দুর সাথে মিল পেলেও অনেকাংশেই আলাদা এই ছবি।
একটি লাইফবোটকে কেন্দ্র করে তৈরী ছবি ‘লাইফবোট’ (১৯৪৩) সমালোচকদের মাঝে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। সাইকোলজিক্যাল মিস্ট্রি ‘স্পেলবাউন্ড’ (১৯৪৫), মুখ্য ভূমিকায় গ্রেগরি পেক ও ইনগ্রিড বার্গম্যান। ছবির শিল্প নির্দেশক ছিলেন স্যুরিয়ালিস্ট শিল্পী সালভাদোর দালি। একটি স্বপ্নদৃশ্যের সেট তৈরী করা হয়েছিল, যা সত্যি হতবাক করে দেয়। দালির তৈরি সেট ও আকর্ষণীয় নায়ক-নায়িকার স্বাভাবিক অভিনয় এবং হিচককের পরিচালনা সাধারণ দর্শককে মাতিয়ে তুলেছিল। এই ছবি হিচকককে অস্কারে সেরা পরিচালকের মনোনয়ন এনে দিলেও ছবিটি নিয়ে হতাশ ছিলেন পরিচালক। পরের বছর হিচকক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি করলেন নটোরিয়াস (১৯৪৬) প্রধান চরিত্রে ইনগ্রিড বার্গম্যান ও ক্যারি গ্রান্ট। ছবিতে মাতাহরির মতোই এক নায়িকাকে দেখা যায় যে জার্মান গুপ্তচরদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিচ্ছে।
‘দ্য প্যারাডাইন কেস’ নামের কোর্টরুম ড্রামা ছিল প্রযোজক সেলজনিক ও হিচককের শেষ ছবি। এরপরই হিচকক নিজের চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা ‘ট্রান্সআটলান্টিক পিকচারস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘ট্রান্সআটলান্টিক পিকচারস’র প্রথম ছবি ‘রোপ’ (১৯৪৮)। ছবিটি ১৯২৪ সালের কুখ্যাত ‘লিওপোল্ড হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে তৈরি হয়েছিল। বাস্তব কাহিনীর উপর ভিত্তি করে তৈরি ছবিটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। আশি মিনিটের পুরো ছবিটি দেখলে মনে হবে পুরো ছবিটি একটি শটে শেষ করা হয়েছে! কলেজের অধ্যাপক রুপার্টের দেওয়া ‘আর্ট অব মার্ডার’ লেকচার শুনে অনুপ্রাণিত ব্রাণ্ডনের মনে খুন করার প্রবণতা জাগে। একসময় সে তার সহপাঠী ডেভিডকে খুন করে। এই সময় ব্রাণ্ডনের সঙ্গে ছিল বন্ধু ফিলিপ। ডেভিডের লাশকে লুকিয়ে রাখা হয় একটি এন্টিক বাক্সে। তারপর তারা পার্টির আয়োজন করে। যেখানে নিমন্ত্রিত ডেভিডের বাবা, তার মাসি, ডেভিডের প্রেমিকা, এবং কলেজের অধ্যাপক রুপার্ট। যে বাক্সে ডেভিডকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, সেটি ডিনার টেবিল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এভাবে শুরু হয় ভয়াবহ স্নায়ুযুদ্ধের খেলা।
১৯৫০ সালে হিচকক ওয়ার্নার ব্রাদারসের সাথে যুক্ত হয়ে তৈরী করেন ‘স্টেজ ফাইট’ যা সমালোচকদের হতাশা করে। তবে পরের বছর সাসপেন্সে ভরপুর ‘স্ট্রেঞ্জার অন এ ট্রেন’ ছবিটি মুক্তি পায়। এরপর ১৯৫৪ সালে মুক্তি পায় হিচককের আরো একটি মাস্টারপিস থ্রিলার ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’ যার মুখ্য ভুমিকায় রে মিল্যাণ্ড ও গ্রেস কেলী। টনি ওয়েণ্ডিসের স্ত্রী মার্গট রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখক মার্কএর সাথে পরকীয়ায় মত্ত। টনি স্ত্রীর পরকীয়া প্রেম সম্পর্কে জেনে ফেলেন আর ঠাণ্ডা মাথায় স্ত্রীকে খুন করার নিখুঁত পরিকল্পনা করেন। ছোটবেলার সহপাঠিকে ব্ল্যাকমেইল করে স্ত্রীকে খুন করার জন্য। ঠিক হয় খুনের সময় টনি থাকবে টেলিফোনের একপাশে আর একপাশে তার স্ত্রী। এই পাশ থেকে তার স্ত্রীকে খুন করা হবে টনি ওপর পাশ থেকে শুনবে তার আর্তনাদ। যাকে বলে একদম সুপরিকল্পনা।
১৯৫৪-র ‘রিয়ার উইণ্ডো’-তে প্রধান চরিত্রে জেমস স্টুয়ার্ট ও গ্রেস কেলী, এই ছবির জন্যও হিচকক সেরা পরিচালকের মনোনয়ন পান। ১৯৫৫ সালের ‘দ্য ট্রাবল উইথ হ্যারি’ ছবিটি ব্যক্তিগতভাবে হিচককএর পছন্দের হলেও র্দশকের পছন্দ হয়নি। হ্যারি মারা গেছে। এখন তার মৃতদেহ নিয়ে ঠিক কী করা উচিত, তা নিয়ে হ্যারির পরিবার পরিজনের ভিন্ন ভিন্ন মতামতের কারণেই সমস্যা তৈরী হয়েছে। হিচককের ছবিতে অনিবার্য হিচককীয় উপাদান এখানে নেই চুড়ান্ত ‘অ্যান্টি হিচককীয়’ এই সিনেমাটিতে রয়েছে নিখাদ বিনোদনের ভাণ্ডার।
১৯৫৮-এর জেমস স্টুয়ার্ট অভিনীত ‘ভার্টিগো’ হিচককের অন্যতম পছন্দের ছবি হলেও সেই সময়ে এটি না দর্শক না সমালোচক কারোরই পছন্দ হয়নি, যদিও সমকালীন সময়ে এটিকে একটি অন্যতম সেরা ছবি বলা যায়। উচ্চতায় ভীতি সান ফ্রান্সিসকোর সাবেক গোয়েন্দা স্কটির। এক বাল্যবন্ধু স্কটিকে আমন্ত্রণ জানায়, হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া তার স্ত্রী মেডালিনের খোঁজখবর নিতে। বন্ধুর স্ত্রীর খোঁজ করতে গিয়ে নিজেই এক জালে ফেঁসে যায় গোয়েন্দা, গোয়েন্দার বান্ধবী, বন্ধু, বন্ধুর স্ত্রী- সব মিলিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েনের পাশাপাশি জটিল এক চক্রান্তের গল্প ‘ভার্টিগো’। এই ছবিতে পরিচালক ডলি জুম নামের এক উদ্ভাবনী ক্যামেরার কাজ করেছিলেন। ভার্টিগোর ব্যর্থতা দ্রুত পাশ কাটিয়ে ১৯৫৯ সালে হিচকক পরিচালনা করলেন রোমান্টিক থ্রিলার ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট’।
১৯৬০ সালে হিচকক পরিচালনা করলেন তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বিস্ময়কর ছবি ‘সাইকো’। এই ছবি মুক্তির পর সাড়া পড়ে যায়। বাকরুদ্ধ সমালোচক আর ভীত বিহ্বল দর্শক! ৪৫ সেকেন্ডের একটি স্নানের দৃশ্যের জন্য ৭৮টি ক্যামেরা একসাথে ব্যবহার হয়েছিল। এটি একটি মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনির গল্প। মেরিয়ন ক্রেন ৪০ হাজার ডলার চুরির করে, আসলে ঐ টাকা মেরিয়নের বয়ফ্রেণ্ডের ঋণের টাকা যেটা শোধ করার জন্য ব্যাঙ্কে জমা না দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মেরিয়ন, আত্মগোপন করে বেটস মোটেলে। সেখানেই খুন হয় মেরিয়ন। এভাবেই ছবির কাহিনী উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দোটানার মধ্য দিয়ে এগোয়। সাইকোর পর হিচককের উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ‘দ্য বার্ডস’ (১৯৬৩), মার্নি (১৯৬৪)।
বড় পর্দার পাশাপাশি টেলিভিশনেও একজন সফল পরিচালক ছিলেন হিচকক। ১৯৫৫-১৯৬০ সাল পর্যন্ত বি.বি.সি নেটওয়ার্ক ও পরবর্তীতে ১৯৬০-১৯৬২ পর্যন্ত এন.বি.সি নেটওয়ার্কে প্রচারিত হয় অ্যালফ্রেড হিচকক পরিচালিত শো ‘অ্যালফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস’। ১৯৬২-র জুন থেকে ‘অ্যালফ্রেড হিচকক আওয়ার’ নামে শো টি প্রচারিত হতে থাকে। ১৯৬৫ পর্যন্ত চলা এই সিরিজে মোট ৩৬১টি পর্ব প্রচারিত হয়। প্রতিটি এপিসোডের ওপেনিং শটে দেখা যেত হিচকককে, নিজেই সেদিনের কাহিনীর সারসংক্ষেপ করতেন।
তাঁর চলচ্চিত্র এবং নির্মাণকৌশল প্রভাবিত করছে পরের প্রজন্মের বহু বিখ্যাত পরিচালকদের। যদিও একটা সময় তাঁর চলচ্চিত্রের নিজস্ব দর্শন নান্দনিকতা সমালোচকরা ইতিবাচকভাবে নেয়নি। হিচককের কপালে খুব একটা পুরস্কারও জোটেনি। বহু বার মনোনীত হয়েও অস্কারের সেরা পরিচালকের তকমা জোটেনি। আবার এটা ঠিক, পুরস্কার কোনো ছবির ভালো মন্দের মাপকাঠি হতে পারে না। আর কে না জানে কিংবদন্তীদের ইতিহাস মনে রাখে!
লেখা ও ডিজাইন – বাপ্পাদিত্য
লেখাটি প্যারালাল ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া